বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নষ্ট রাজনীতির ঘুণপোকা

  • এ কে এম শাহনাওয়াজ   
  • ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ ১৫:৫২

আমাদের দেশের রাজনীতি যেভাবে ক্রমে দেশপ্রেম নির্বাসন দিয়ে গোষ্ঠীপ্রেমকে সামনে নিয়ে আসছে তাতে অগ্রগতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যি পৌঁছানো সুকঠিন। দেখে মনে হয়, দেশের উজ্জ্বল ঐতিহ্য ও ইতিহাস পাঠবিমুখ আমাদের রাজনীতির মানুষেরা। তাই এদেশের সরকারি ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের কোনোপক্ষই ঐতিহ্য থেকে প্রাণিত হন না। এভাবে তাদের অধিকাংশই এখন আর দেশকল্যাণে ব্রতী নন।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস থেকে তিনটি ছবি প্রথম উপস্থাপন করছি। পাশ্চাত্যের ইতিহাস বইতে গর্বের সঙ্গে বলা হয়, মধ্যযুগে ইউরোপে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন ধ্রুপদী সভ্যতার পতনের পর পাঁচ শতকের শেষদিকে নতুনভাবে বিশ্বসভ্যতার উত্থান ঘটে। এবার সভ্যতা উদ্ভবের প্রাণকেন্দ্র ইউরোপ। তবে মধ্যযুগের এই সভ্যতা প্রচীনকালের নগর সভ্যতার অনুরূপ নয়। ইউরোপের সভ্যতা ছিল সামন্ততান্ত্রিক গ্রামীণ-সভ্যতা। এ পর্যায়ে ক্ষদ্র জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে ইউরোপে।

নয় শতকে গল অর্থাৎ আধুনিক ফ্রান্সে শক্তিশালী রাজা শার্লামেন সিংহাসনে বসেন। শিক্ষার আলোহীন মধ্যযুগের ইউরোপে তিনি প্রথম গির্জা-কেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা করেন। এর ধারাবাহিকতায় বারো ও তেরো শতকে ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ আমরা অনেকেই ইতিহাসচর্চার দুর্বলতার কারণে খোঁজ রাখি না, এরও হাজার বছর আগে শিক্ষার আলো জ্বলেছিল বাংলায়। আট শতক থেকে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে থাকে এ ভূখণ্ডে। শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, সোমপুর মহাবিহার, বাসুবিহার, সীতাকোট বিহার সে সাক্ষ্য বহন করছে। প্রাচীন বাংলায় আসা চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ পরিসংখ্যান দিয়ে বিহারগুলোর ছাত্র-শিক্ষক সংখ্যা, পাঠক্রম ইত্যাদি নানা তথ্য দিয়েছেন। বিদেশি ছাত্রদের বাংলার এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসাটা আরাধ্য ছিল।

দ্বিতীয় ছবিটি এগারো শতকের। বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চায় বাংলা তখন উপমহাদেশে নেতৃত্বের জায়গায় পৌঁছেছে। এসময় নেপাল, তিব্বত, চীন প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধ ধর্ম ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল।

এসব দেশের পণ্ডিতসমাজ সিদ্ধান্তে এলেন বাংলার বৌদ্ধ পণ্ডিত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করকে একবার তাদের দেশে আনতে পারলে আবার বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনচর্চার প্রাণ ফিরে পেত। এই অনুরোধ রেখে চীনের রাজা বাংলার পণ্ডিতসমাজের কাছে পত্র দিয়ে প্রতিনিধি দল পাঠালেন। অনুরোধ করলেন অতীশকে কিছু দিনের জন্য যেন ধার দেয়া হয়। অনেক ভাবনাচিন্তার পর অতীশ দীপঙ্কর চীন রাজার আহবানে সাড়া দেন। পথে প্রথমে নেপাল, পরে তিব্বত ও সবশেষে চীনে যান তিনি। অতীশের পরিচর্যায় এসব দেশে বৌদ্ধ ধর্ম আবার জীবনী শক্তি ফিরে পায়। অতীশ আর ফিরতে পারেননি। চীনেই মৃত্যুবরণ করেন। কয়েক বছর আগে তার দেহভষ্ম কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারকে দান করে চীন সরকার।

শেষ ছবিটি সুলতানি বাংলার। চৌদ্দ শতকে সুলতানগণ বাংলায় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ধন, সম্পদ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার কারণে বাংলার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে। বস্ত্রশিল্প, বাণিজ্য ও শিল্পকলার সকল ক্ষেত্রে বাংলার অবস্থান অনেক বেশি উজ্জ্বল ছিল। এসময় আরব দেশগুলোতে তেল শক্তির খোঁজ মেলেনি। অর্থনৈতিকভাবে দীনহীন অবস্থা তখন এসব দেশের মানুষের।

চৌদ্দ শতকে সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে আসীন ছিলেন সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ। এসময় প্রতিবছর মক্কা, মদীনার মানুষ অধীর আগ্রহে আরব সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে থাকতো। কারণ বাংলার সুলতান জাহাজ বোঝাই রিলিফ পাঠাবেন তাদের জন্য। ঐতিহাসিক ইবন-ই-হুজর তাঁর ‘ইবনা উল গুমর’ গ্রন্থে স্পষ্টই দেখিয়েছেন বাংলার সুলতানের পাঠানো অর্থের ভাগ মক্কা মদীনার সকল মানুষ পেত।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার এমন অনেক মণিকাঞ্চনের সন্ধান দেয়া যায় ইতিহাসের পাতা থেকে। ইতিহাস এভাবেই প্রাণিত করে নতুন প্রজন্মকে। অনেক চড়াই উৎরাইয়ের পর আজ আমরা এসে দাঁড়িয়েছি এক কঠিন বাস্তবতায়। নানা নৈরাজ্যের ঘূর্ণিপাকে ঐতিহ্য ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে প্রজন্মের সামনে। অথচ বাংলার মানুষ ঐতিহ্যিক প্রণোদনা বিচ্ছিন্ন হয়নি কোনোদিন। স্বার্থপরতা ও গোষ্ঠীপ্রিয়তার চেয়ে দেশপ্রেমকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। না-হলে ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি পেয়েছিলেন কোথা থেকে!

ভাষা আন্দোলনের গৌরবগাঁথা রচনা করার সাহস এসেছিল কীভাবে! আর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার উদ্দীপনাই বা পেয়েছিলেন কেমন করে! এতসব ঐতিহ্যের শক্তি স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারতো অন্য এক উচ্চতায়। কিন্তু উলটে গেল সব হিসাবনিকাশ। যেখানে টগবগে ঘোড়ার শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে কোনো এক অশুভ শক্তি বাংলাদেশের পায়ে যেন ভূতের পা লাগিয়ে দিল। মালোয়েশিয়া যা পেরেছে তার চেয়ে অনেক বেশি পরার কথা ছিল বাংলাদেশের।

সাড়ে সাত কোটি জনসম্পদ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সে সম্পদ বেড়ে এখন সতেরো কোটি পেরিয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও খুব কষ্টের সঙ্গে ভাবতে হতো কী হতে পারতো এদেশ আর কী হচ্ছে এখন চারপাশে! অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা ও শ্রমে অন্তত অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে বাংলাদেশ।

কিন্তু চলমান রাজনৈতিক-সংকট আমাদের আতঙ্কমুক্ত করতে পারছে না। আমাদের দেশের রাজনীতি যেভাবে ক্রমে দেশপ্রেম নির্বাসন দিয়ে গোষ্ঠীপ্রেমকে সামনে নিয়ে আসছে তাতে অগ্রগতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যি পৌঁছানো সুকঠিন। দেখে মনে হয়, দেশের উজ্জ্বল ঐতিহ্য ও ইতিহাস পাঠবিমুখ আমাদের রাজনীতির মানুষেরা। তাই এদেশের সরকারি ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের কোনোপক্ষই ঐতিহ্য থেকে প্রাণিত হন না। এভাবে তাদের অধিকাংশই এখন আর দেশকল্যাণে ব্রতী নন। ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকা বা মসনদ দখল করার কুটিল অভিপ্রায়ে দেশ ও জনগণকেই জিম্মি করে ফেলছেন।

তাদের এমন মনোভাব বিভক্ত করে ফেলছে দেশের মানুষকে। বিভ্রান্ত করে ফেলছে তরুণ প্রজন্মকে। না-হলে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকালে যে দেশের তরুণ সমস্ত প্রলোভনকে পায়ে মাড়িয়ে জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে প্রাণশক্তির সঞ্চার করত আজ তাদেরই উত্তর পুরুষ চাঁদাবাজ, টেণ্ডারবাজ, ধর্ষক, সন্ত্রাসী ও খুনি হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। নষ্ট রাজনীতি সবার শুভ-চিন্তা ও চেতনাকে গ্রাস করছে।

তারুণ্য নির্লোভ শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হচ্ছে না। তারুণ্যের শুভ্র সৌন্দর্যকে ভূলুন্ঠিত করে চাঁদাবাজ দখলবাজ আর সন্ত্রাসী হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করছে।

রাজনীতিকদের সমালোচনা করলে তারা অস্বস্তিতে ভোগেন। বলেন, সমাজের অন্য শ্রেণি পেশার মানুষ অনাচার করে দেশকে কি পিছিয়ে দিচ্ছে না? কথা সত্য। তবে তারচেয়ে বড় সত্য অধিকাংশ অনাচারকারীর শক্তির খুঁটি সেই রাজনীতি অঞ্চলই। টেলিভিশন টকশোতে খুব হতাশার সঙ্গে লক্ষ করতে হয় প্রবীণ, আধাপ্রবীণ থেকে নবীন সাংবাদিক যাদের রাজনৈতিক পরিচয় কমবেশি জানা; তারা কীভাবে অন্ধত্ব দিয়ে যার যার দলের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। নিজ দলের চোর বদমাশদের সুপথ না দেখিয়ে- যৌক্তিক সমালোচনা না করে মাথায় তুলে রাখেন। অন্যপক্ষের মুণ্ডুপাত করেন। কারণ, নষ্ট রাজনীতি তো তাদের বুকের ভেতরের মুক্তচিন্তার জায়গাটির মৃত্যু ঘটিয়েছে অনেক আগেই। আইনজীবীরা দেশ ও সমাজে আইনের শাসন সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন এটাই ছিল প্রত্যাশা। কিন্তু এ অঞ্চলেও রাজনীতিকরণ সম্পন্ন হওয়ায় মুক্ত বিবেক নির্বাসিত হয়েছে।

সাংস্কৃতিক অঞ্চলের মানুষদের প্রতি একধরনের আস্থা ছিল বহুকাল ধরে। একটি নির্লোভ অবস্থানে থেকে তারা দেশের মানুষের মনোভূমিতে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সাধনে নিবেদিত থাকেন। কিন্তু এসব অঞ্চলের ক্ষমতাবানরাও এখন নানা রাজনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত। দলীয় তল্পিবাহকের ভূমিকা তাদের আত্মশক্তি বিকাশের সম্ভাবনা ক্রমে নিষ্প্রভ করে দিচ্ছে।

ইতিহাস বলছে, পাকিস্তান আমল থেকে যেকোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে মুক্ত বিবেক হিসেবে আবির্ভূত হতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি তারা ছিলেন আন্দোলনকারীদের গাইড-ফিলোসফার। কিন্তু এখন পালটে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দু’ ধরনের শিক্ষকের বাস। ক্ষমতাশালী দলটি শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন। আর অন্যদলটি শিক্ষক রাজনীতির বলয় বিচ্ছিন্ন। তাদের পরিচয় ‘সাধারণ শিক্ষক’ নামে। সাধারণ শিক্ষকরা মুক্ত ভাবনায় কণ্ঠ চড়ালেও তা ঢাকা পড়ে যায় রাজনীতির শিক্ষকদের দাপটে। তারা নিজেদের চিহ্নিত করেন নানা রঙে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে তারাও অনেক সময় অন্যায় অনাচার বৃত্তে নিজেদের যুক্ত রাখেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের চিন্তার বদলে নিজেদের স্বার্থচিন্তা এবং নিজদলীয় জাতীয় নেতা-নেত্রীদের আজ্ঞা বহনেই তাদের অধিকাংশ ব্যস্ত থাকেন।

এভাবে নষ্ট রাজনীতির ঘুণপোকা সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই ঝাঝরা করে দিচ্ছে। হতাশা বাড়াচ্ছে মানুষের মধ্যে।

তারপরেও আশাবাদী মানুষ ইতিহাসের অমোঘ নিয়মের সূত্রে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খোঁজে। তবে ভরসা এই যে, প্রয়োজনীয় সময়ে ইতিহাস ঠিকই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবে। জয় হবে মুক্তচিন্তার মানুষের এবং দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্মের। আজ যারা রাজনীতির স্বার্থচর্চা করতে গিয়ে জাতিকে চরম অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন হয় তারা আত্মচৈতন্যে ফিরে এসে মানবিক হবেন এবং দেশপ্রেমের টান অনুভব করবেন বুকের ভেতরে, দলের চেয়ে সত্যিই দেশকে বড় ভাববেন অথবা দেশপ্রেমিক মানুষের ইচ্ছেশক্তির জোয়ারে দিশেহারা হয়ে পায়ের নিচের মাটি হারাবেন। প্রত্যাশা করি রাজনীতির মাঠে সকল পক্ষের যত আস্ফালনই থাকুক, শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করার মতো মূর্খতা কেউ দেখাবেন না।

লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এ বিভাগের আরো খবর