বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সড়কে মড়ক, সর্বনাশের শেষ কোথায়?

  • ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল   
  • ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ ১৮:১৫

আদতে এই জীবনের মূল্য কেউ কি নির্ধারণ করতে পারে না। যখন কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রাথমিক হিসাবের কিছু টাকা হয়তো তুলে দেয়া হয় ভুক্তভোগী পরিবারের হাতে, তাও অনেক সময় পৌঁছায় না । অধিকাংশ পরিবারগুলো একেকটা দুর্ঘটনায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে, পরিবারগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

এক জন টিভি সাংবাদিক গতকাল বুধবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, ঘরে তার দুই অবুঝ সন্তান আর জীবনসঙ্গী। প্রতিদিনকার মতোই তারা অপেক্ষা করছিলেন। তার আর ফেরা হলো না। কী তরতাজা প্রাণ, তার এক সহকর্মী সাইদুর রহমান বাবু ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘সহকর্মী ভিডিও এডিটর গোপাল সূত্রধর। অফিস শেষে বের হওয়ার সময় বিদায় নিয়ে গেলেন, তখনো বুঝতে পারিনি জীবনের শেষ দেখা, শেষ বিদায়!! ওপারে ভালো থাকবেন।’

ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে একই পরিবারের সাত জনের মৃত্যু, বেপরোয়া গাড়ির চাপায় মৃত্যু, গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে খুন, দুই গাড়ির প্রতিযোগিতায় চাপা পড়ে মৃত্যু, বাবার সামনে সন্তানের মৃত্যু- এমন হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাদের শুনতে হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? আদতে শেষ হবে কি কখনো?

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন চার হাজার ৪৩৯ জন। ২০১৯ সালে শুধু সড়ক দুর্ঘটনাই ঘটেছে চার হাজার ৭০২টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ২২৭ জন। আহত ছয় হাজার ৯৫৩ জন। সবচেয়ে বেশি, ৩০৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। নিসচার প্রতিবেদনে এসেছে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৯ জন বাসচালক ও সহকারী এবং ৭২ জন ট্রাকচালক ও সহকারী মারা গেছেন। এ ছাড়া দুই হাজার ৬৬১ পথচারী মারা গেছেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ।

২০২০ সালে সর্বমোট চার হাজার ৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন চার হাজার ৯৬৯ জন। এ ছাড়া এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৮৫ জন। গত বছরের জানুয়ারি মাসে বেশি ৪৪৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৪৯৫ জন নিহত ও ৮২৩ জন আহত হন। আর এপ্রিল ও মে মাসে সবচেয়ে কম যথাক্রমে ১৩২ ও ১৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটে।

এর পেছনের কারণ হিসেবে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে দেশে লকডাউন থাকায় দুর্ঘটনা কম হয়েছে। এ দুর্ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, রাস্তায় পথচারীরা গাড়িচাপায়, পেছন দিক থেকে ধাক্কাসহ বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনায় পড়েছে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা, রাস্তা চলাচল ও পারাপারে মোবাইল ব্যবহার, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, পদচারী-সেতু ব্যবহার না করা, যেখানে সেখানে পারাপারের ফলে পথচারীরা দুর্ঘটনায় পড়ছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ এই পাঁচ বছরে দেশে মোট ২৬ হাজার ৯০২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩৭ হাজার ১৭০ জন নিহত হয়েছেন ও আহত হয়েছেন ৮২ হাজার ৭৫৮ জন।

বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং বিপজ্জনক ওভারটেক বেড়ে যাওয়ার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে বলে ধারণা করা হয়। সমিতির আরেক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০১৯ সালে পাঁচ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৮৫৫ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ৩৩০ জন।

এ তো গেলো পরিসংখ্যানের হিসাব। কিন্তু এই জীবনের মূল্য কত? কে নির্ধারণ করে তা? আদতে এই জীবনের মূল্য কেউ কি নির্ধারণ করতে পারে না।

যখন কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রাথমিক হিসাবের কিছু টাকা হয়তো তুলে দেয়া হয় ভুক্তভোগী পরিবারের হাতে, তাও অনেক সময় পৌঁছায় না । অধিকাংশ পরিবারগুলো একেকটা দুর্ঘটনায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে, পরিবারগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তাদের সন্তানরা বঞ্চিত হয় শিক্ষা ও উন্নত জীবনের ময়দান থেকে। সরকারের সড়ক ও মহাসড়ক অধিদপ্তরের তথ্য মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় কর্মক্ষম ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতি ২৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা, আহত হলে আর্থিক মূল্যে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার টাকা, মারাত্মকভাবে আহত হলে আর্থিক মূল্যে ক্ষতির পরিমাণ একই সঙ্গে সাধারণ দুর্ঘটনায় আহত হলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৬০০ টাকা।

অন্যদিকে, প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় গড় ক্ষতির পরিমাণ (টাকায়) ৪৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা, প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ক্ষতির পরিমাণ দুই লাখ ৩৮ হাজার টাকা, আর সাধারণ দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ ১৪ হাজার টাকা।

এই হিসাবের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় একেকটি পরিবারে হারানোর বেদনা, তার যত কষ্টের পুরাণ। নিশ্চয়ই পৃথিবীর আর কোনো কিছু দিয়েই একটি জীবনের মূল্য আমরা নির্ধারণ করতে পারি না। যখন দুর্ঘটনা ঘটে আমরা সহসাই তার বিরুদ্ধে দাঁড়াই, আন্দোলন করি।

আবার সব আন্দোলন একই রকম হয় না, গাইবান্ধার প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তায় যে শিশুটি অটো রিকসা দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে, তার জন্য দাঁড়ায় না শহরের মানুষ। সড়কে এমন মড়ক থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব, এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি আধুনিক রাষ্ট্রে এই ধরনের সড়ক ও তার আইনি ব্যবস্থা থাকতে পারে না। পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের দেশের সড়কে মৃত্যু অধিক, এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর মৃত্যু হার থেকেও।

আমরা এ পরিস্থিতির অবসান চাই। আর এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। সরকারের আইনের ক্ষেত্রে কঠোরতার পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতা, সামাজিক নানা উদ্যোগ আর চোখে পড়ার মতন সাজার ব্যবস্থা। সড়কে চলতে হলে যেমন নাগরিকদের ট্রাফিক আইন মানতে হবে, একইভাবে যে বা যারা ট্রাফিক আইন অমান্য করে দুর্ঘটনা ঘটাবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আর কোনো বিকল্প নেই। আরেকটি কথা হলো, সড়ক ও মহাসড়কে সকল ভিআইপিগিরির অবসান হওয়া জরুরি। সত্যিকারের জিরো টলারেন্স দেখানোর সময় এখনই।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, পরিবেশ-সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর