‘বাবার যৌন হয়রানি থেকে বাঁচতে আদালতে দুই মেয়ে, মিলছে না বিচার।’ শিরোনাম পড়ার পরেই হয়তো আপনার একরকম গা ঘিনঘিনে অনুভূতি হবে। পুরো খবরটি পড়ার রুচি হবে না। যদি আপনি প্রাপ্তবয়স্ক কোনো মেয়ের বাবা হন, তাহলে আপনার হয়তো নিজের উপরেই ঘৃণা হবে। পুরুষ হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও নিজেকে অপরাধী মনে হবে। হচ্ছে? যদি না হয়, তাহলে গুগলে সার্চ দিয়ে পুরো খবরটি পড়ুন।
খবরের সারাংশ হচ্ছে, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর মায়ের কাছেই শৈশব কাটে দুই বোনের। কিন্তু পড়াশোনার তাগিদে একটা পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তারা ওঠেন রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে বাবার নতুন সংসারে। কিছুদিন যেতেই বাবার আচরণ দুই বোনের কাছে আপত্তিকর ঠেকতে থাকে। তাদের অভিযোগ, বাবা তাদের বলেছেন, ‘আমি যে টাকা দেবো, তাতে আমার লাভ কী? তোমরা আমার কাছে আসো, আমি সব দেবো।’ এরপর তিনি তার বড় মেয়েকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে ফ্রি হও, যা করতে বলি তাই করো, তোমার কোনো অভাব রাখব না। তোমার নামে ফ্ল্যাট লিখে দেব। কাছে না আসলে কিছুই দিতে পারব না।’
নিজের ঔরসজাত সন্তানকে যিনি এই কথা বলতে পারেন, তিনি কি সেই মানুষ, যারা নিজেদের আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব বলে গর্ব করে? তিনি কি সেই বাবা, যার সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই!’
খবরে বলা হচ্ছে, বাবার কথা শোনার পর এক মেয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছোট বোন তাকে রক্ষা করেন। এরপর বাবার বাসা থেকে তারা বেরিয়ে যান। কিন্তু তাতেও নিস্তার মেলেনি। হুমকি, লোকলজ্জা, আর্থিক, যৌন ও মানসিক অত্যাচারের শিকার দুই বোন দ্বারস্থ হন আদালতের। আদালত কী সিদ্ধান্ত দেবেন, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু গণমাধ্যমে যে খবর এসেছে, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে- এটি লজ্জার, ঘৃণার এবং পৃথিবীর সকল বাবার জন্য অপমানের, অসম্মানের। তিনি নিজেকে আর যা-ই হোক, বাবা দাবি করতে পারেন না।
এরকম ঘটনা দেশে যে এই প্রথম ঘটল, তা নয়। বরং আগেও এরকম অনেক শিরোনাম হয়েছে। যেমন: ১. বগুড়ায় সৎ মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে বাবা গ্রেফতার। ২. রামগতিতে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে বাবা গ্রেফতার। ৩. রাজধানীতে বন্ধুদের দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ। ৪. ১০ বছর ধরে বোনকে ধর্ষণ করছে ভাই। ৫. নারায়ণগঞ্জে বোনকে ধর্ষণ ইত্যাদি।
তার মানে যে পরিবার একজন নারী ও শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত, সেখানেও সে হিংস্রতার শিকার। স্বয়ং বাবা ও ভাইয়ের কাছেও যে নারী বা যে শিশু নিরাপদ নয়, তাকে দেশের কোন আদালত সুরক্ষা দেবে? রাষ্ট্রের কোন অঙ্গ তার পাশে দাঁড়াবে?
বাবার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ কিংবা বন্ধুদের দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ করানোর যে লোমহর্ষক ঘটনার খবর বেরিয়েছে, সেটি মূলত বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, তথা সমাজে নারীর অবস্থান এবং নারীকে দেখার যে ভঙ্গি, তারই প্রতিফলন। কারণ স্ত্রীর সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে পারিবারিক বিরোধ থাকলে তা সুরাহার অনেক পথ রয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণের জন্য বন্ধুদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
আসলেই ঘটনাটি এরকম ঘটেছে নাকি অভিযোগটি মিথ্যা—সেটি আদালতেই প্রমাণিত হবে। প্রশ্ন হলো, আদৌ প্রমাণিত হবে কি না? নাকি ঘটনা ঘটলেও নানাবিধ চাপে শেষ পর্যন্ত আপসরফা হবে এবং আদালতে দাঁড়িয়ে ওই ভুক্তভোগী নারী গিয়ে বলবেন যে, স্বামীর বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই, বরং তিনি স্বামীর সঙ্গেই থাকতে চান।
এ বিষয়ে হয়তো ওই নারীর উপর তার নিজের পরিবার থেকেও চাপ আসবে। অর্থাৎ, আমরা যে সমাজবাস্তবতা গড়ে তুলেছি, সেখানে নারীরা ভিকটিম হতে থাকবে এবং এই সমাজ এবং ভুক্তভোগী নারীদের পরিবারই তাকে চুপ করে যেতে বা মেনে নিতে বাধ্য করবে। কারণ সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষমতার মাধ্যমে। সেই ক্ষমতা কখনো রাজনীতির, কখনো অর্থের, কখনো সামাজিক প্রতিপত্তির। আবার এই মেনে নেয়া বা সমঝোতার পেছনে ভীতি ও অনিশ্চয়তা এবং ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কাও বড় কারণ।
বলা হয়, পুরুষমাত্রই ‘ধর্ষকামী’। যখন সে বোঝে অপরাধ করেও পার পাওয়া যাবে অথবা তার ভেতরে যদি অপরাধবোধ বলে কিছু না থাকে, তখন সুযোগ পেলেই সে ধর্ষক হয়ে ওঠে। এমনকি তার ভেতরে মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত হতে থাকলে একপর্যায়ে নিজের মেয়েকে যৌনসঙ্গী হিসেবে ভাবতে পারে!
বাবার বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগের সবগুলো সত্যি নাকি এগুলো পারিবারিক বিরোধের জের— সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। নেই বলেই ধর্ষণের প্রতিটি অভিযোগের তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হয়। কারণ যদি সত্যিই কোনো পিতা তার সন্তানকে ধর্ষণ করে থাকেন, তাহলে তার এই জঘন্য অপরাধের কঠোর শাস্তি যেমন প্রয়োজন, তেমনি যদি তিনি ধর্ষণ না করে থাকেন, যদি পারিবারিক বা অন্য কোনো বিরোধের জেরে তার বিরুদ্ধে এরকম একটি অভিযোগ আনা হয়, তাহলে সেটিও জানানো দরকার। কারণ তিনি ন্যায়বিচার না পেলে সন্তানের ধর্ষক হিসেবেই সমাজে চিহ্নিত হয়ে যাবেন। অর্থাৎ কেউ ধর্ষণ করলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি যেমন কাম্য, তেমনি কারো বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয় বা অন্য কোনো বিরোধের জেরে তাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে, সেটিরও শাস্তি হওয়া দরকার। কারণ, একজন অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার চেয়ে একজন নিরপরাধ মানুষের শাস্তি পাওয়া অনেক বেশি ক্ষতিকর, ভয়ংকর। সেইসঙ্গে লঘু অপরাধে কাউকে গুরুদণ্ড দেয়ারও সুযোগ নেই।
পরিশেষে, সবার উপরে মানুষ সত্য। কিন্তু মানুষ যা করে, সেরকম জঘন্য কাজ পশুরাও করে না। পশুদের খারাপ বিবেচনা করে আমরা খারাপ কাজকে অনেক সময় ‘পাশবিকতা’ বলে মন্তব্য করি। কিন্তু পশুরা নিজের সন্তানদের সঙ্গে যৌনকর্ম করে বা করার জন্য উদ্যত হয়, এমন কথা শোনা যায় না। মানুষ এটা করে। সুতরাং আমরা যে কাজকে ‘পাশবিকতা’ বলি, পশুরা সেটাকে কী বলবে, ‘মানবিকতা’?