বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিল্প-সংস্কৃতিবান্ধব বঙ্গবন্ধু

  • আতাউর রহমান   
  • ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ ১৩:২৩

আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক জন খাঁটি বাঙালির জীবনাচরণ ও বাঙালির হাজার বছরের পুরানো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সুকৃতিকে ধারণ করে তিনি নিজ অন্তরে স্থাপন করেছিলেন। কালে কালে তিনি শিল্প, সাহিত্য, দেশীয় সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ এক পরিপূর্ণ বাঙালি যুবক হিসেবে বর্ধিত হন।

আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্তিকালগ্ন শিল্প-সংস্কৃতি ও কৃষ্টিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি শিকড় থেকে উৎসারিত, মনে প্রাণে ও হৃদয়ে এক জন বাঙালি ছিলেন। টুঙ্গিপাড়ার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা বাবা-মায়ের আদরের ছেলে খোকাই কালে কালে হয়ে উঠলেন বাঙালির ত্রাতা এক মহামানব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংগ্রাম, প্রজ্ঞা এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ইতোমধ্যে বহু আলোচনা হয়েছে, যা আজ সকল বিশ্বমানবের জ্ঞাত। তার ৭ মার্চের ভাষণসহ, দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে উৎসর্গকৃত জীবন সংগ্রামের কাহিনি আজ আর কারো অজানা নেই। শেখ মুজিবুর রহমানের একক সত্তা আর বাঙালির সামগ্রিক পরিচিতি মিলেমিশে আজ এক দেহে লীন হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাই বাঙালির সকল সুকৃতি, বীরত্ব, দৃঢ়-চিত্ত সংকল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিলেন।

আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক জন খাঁটি বাঙালির জীবনাচরণ ও বাঙালির হাজার বছরের পুরানো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সুকৃতিকে ধারণ করে তিনি নিজ অন্তরে স্থাপন করেছিলেন। কালে কালে তিনি শিল্প, সাহিত্য, দেশীয় সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ এক পরিপূর্ণ বাঙালি যুবক হিসেবে বর্ধিত হন। পরবর্তীকালে তার সামগ্ৰিক রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে তার প্রতিভাস পরিলক্ষিত হয়। তার জীবন ও রাজনৈতিক সাধনার মূলমন্ত্র নিহিত ছিল বাঙালির হাজার বছরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গৌরবময় ঐতিহ্যের মধ্যে। তিনি দ্বিজেন্দ্রলালের গানের কথার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐকমত্য পোষণ করতেন বলে আমি মনে করি। সেই গানের নির্যাস কথাটি হলো­– ‘সকল দেশের রাণী সে যে, আমার জন্মভূমি’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শ্রুতিধর। যা একবার তিনি দেখতেন, পড়তেন অথবা শুনতেন তা কখনো ভুলতেন না। বাংলদেশের কয়েক হাজার মানুষকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, এমনকি তাদের পারিবারিক ইতিবৃত্তও জানতেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা তার মুখস্থ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান ও কবিতার লাইন তিনি প্রায়ই আওড়াতেন। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্দ্বিধায় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। তার সামনে আরও পছন্দের সংগীত ছিল, কিন্তু অন্য সংগীত বাদ দিয়ে তিনি এই বিশেষ গানটিকেই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

আমি ধারণা করি, আমাদের জাতির পিতা জানতেন যে; তরুণ বয়সে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতার আদেশে তখনকার পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, পতিসর ও সাজাদপুরে প্রায় সাত বছর বসবাস করেছিলেন তাদের পৈতৃক সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করার জন্য এবং এই সময়ের মধ্যে রবীদ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে বসে তার বিখ্যাত পত্রগ্রন্থ ‘ছিন্নপত্র’ রচনা করেছিলেন। এই সময়ে তিনি মহাত্মা লালন ও গগন হরকরার গান শুনে বিমোহিত হয়েছিলেন। গগন হরকরার লেখা বাউল গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’, রবীন্দ্রনাথের কলমে রূপান্তরিত হয়ে রচিত হলো ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

পরবর্তীকালে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটি রচনা করেছিলেন। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থভাবে মনের অন্তর্গত আকর্ষণে পূর্ব বাংলার মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত গানটিকেই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অনন্য প্রতিভাবান এক জন মানুষ। তিনি ৭ মার্চ এ জগৎকাঁপানো এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন তখনকার রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান), যা বিশ্ব ইতিহাসে সর্বকালের সেরা এবং সর্বাধিকবার শ্রুত বক্তৃতার দুর্লভ স্বীকৃতি পেয়েছে। পৃথিবীতে অনেক গণনায়কের বক্তৃতা যুগ যুগ ধরে আমাদেরকে আন্দোলিত ও অনুপ্রাণিত করেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ছিল তুলনাহীন। এই বক্তৃতা পাকিস্তানিদের দাসত্ব ও শৃঙ্খল ভাঙার জন্যে লক্ষ-কোটি বাঙালির মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। যারা আধুনিক যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে কিছু জানত না তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জীবনপণ যুদ্ধে, সামান্য ঘরোয়া অস্ত্রকে সম্বল করে। প্রাণ দিয়েছিল ৩০ লাখ বাঙালি এবং সম্ভ্রম হারিয়েছিল প্রায় ২ লাখ মা-বোন। আশ্চর্যজনকভাবে ষোড়শ শতকের বিশ্বখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার ও কবি উইলিয়াম শেকস্‌পীয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের মার্ক এ্যাস্টনির বক্তৃতার অনন্য বিষয়বস্তু ও কাব্যিক দ্যোতনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যেন স্বর্গ থেকে প্রেরিত ৭ মার্চের কথামালার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্যেই আমরা প্রমোদকর ছাড়া মঞ্চে নাট্যাভিনয় করতে পারি। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকার সময় নাটকের ওপর থেকে প্রমোদকর বাতিল করেছিলেন। তারই সুযোগ্য কন্যা, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে ‘সেন্সরশিপ’ তথা নাটকের পাণ্ডুলিপির ওপর থেকে ছাড়পত্র নাকচ করে দেন। ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এফডিসি)-এর প্রতিষ্ঠাও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে) বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল।

নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি জিয়া হায়দারসহ বর্তমান লেখক (প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক) বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত বাড়িতে একাধিকবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, আমাদের নানা আবদার ও তদবির নিয়ে। শেষবার গিয়েছিলাম একটি যাত্রাপালা বিদেশভ্রমণের তদবির নিয়ে। দলপ্রধান থাকবেন জিয়া হায়দার এবং উপনেতা হিসেবে আমি। এই ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাদের নিবেদন। বঙ্গবন্ধু তখন বিরোধী দলের প্রধান হিসেবে সমগ্র দেশে অসহযোগ আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর মালেক সাহেব ছিলেন পাকিস্তান সরকারের ক্ষমতাহীন এক পুতুলের মতো। মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন কিন্তু তার সত্যিকার রূপকার ছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে আমি দু’বার দেখেছিলাম বাঙালির আটপৌরে পোশাকে। পরনে ছিল সাদা চেক-চেক লুঙ্গি এবং গায়ে হাতাওয়ালা সাদা গেঞ্জি। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত কবি বেগম সুফিয়া কামালের বাড়িতেও আমি তাকে দেখেছি এই ঘরোয়া পোশাকে। বেগম সুফিয়া কামালকে তিনি ‘বুবু’ বলে ডাকতেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি এবং বিদেশি লেখক ও কবিদের ভক্ত ছিলন। বঙ্গবন্ধুকে আমি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ‘ধন ধান্যে পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ নিজকণ্ঠে গাইতে শুনেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতা তার মুখস্থ ছিল এবং আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বিদ্রোহীসত্তা ও লেখার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবির উচ্চাসন অলংকৃত করেন। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিলেত ও ভারত হয়ে ঢাকার পুরোনো তেজগাঁও এয়ারপোর্টে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম। তিনি আগের তুলনায় কৃশকায় হয়ে গিয়েছিলেন এবং তার সহকর্মীদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন এবং আবৃত্তি করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ থেকে–

‘নমোনমো নমঃ সুন্দরী মম, জননী বঙ্গভূমি!গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি’।

আমার এই সামান্য লেখার ইতি টানব এই বলে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি সুযোগ ও সময় পেতেন তাহলে তার লেখা ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম চার্চিলের মতোই বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পেত। সামান্য উদাহরণ হিসেবে তাঁর রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজ নামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়া চীন’-এর নাম উল্লেখ করতে হয়। এমন সহজ, সুন্দর ও নান্দনিক গদ্য রচনায় আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি সব বড় প্রথিতযশা লেখকের সহজ-সুন্দর ভাষা ও ভাব প্রকাশের ভঙ্গি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। তার জীবনের একটা বিরাট অংশ যদি কারাগারে না কাটাতে হতো, তাহলে আমরা বাংলা সাহিত্যের আরও এক জন প্রথিতযশা লেখককে পেতাম, যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান; যিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। আমি এই মহান সংস্কৃতি-মনা ও লেখক সত্তায় সমৃদ্ধ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহান স্মৃতির প্রতি প্রণতি জানাচ্ছি। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারই জয় হয়েছে।

লেখক: মঞ্চসারথি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

এ বিভাগের আরো খবর