বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অরুণাচলে কি চীন-ভারত সংঘাত বাড়বে?

  • সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন    
  • ২৬ জানুয়ারি, ২০২১ ১৮:১৫

আপাতদৃষ্টিতে দু’পক্ষকেই দেখা যাচ্ছে যে যার অবস্থান থেকে এক বিন্দু নড়তে অটল। গত বছর লাদাখ নিয়ে কাটানোর পর এ বছর দু’পক্ষেরই চোখ অরুণাচলে। আসল নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপাশে চীন অংশে এতবছর লোকবসতির তেমন প্রমাণ না পাওয়া গেলেও গত বছর থেকে এলাকাগুলোতে বেসামরিক নাগরিকদের প্রতিস্থাপন শুরু করেছে। এ নিয়ে টানটান উত্তেজনার বাতাস বেইজিং থেকে দিল্লিতে এসে পৌঁছেছে।

এবার ভারতের অরুণাচল প্রদেশে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে বসতি নির্মাণ শুরু করেছে চীন। এরই মধ্যে ১শ’র অধিক পাকা ঘর নির্মাণ করা হয়ে গেছে সুবানশ্রী জেলার পাশ থেকে প্রবাহিত তশ্রী চু নদীর অববাহিকায়। এরকম আরও ছয় শ’ ২৪টি গ্রাম তৈরি করতে ২০১৭ সালে একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল বেইজিং। বসতিটি এই প্রকল্পের প্রথম সফল কর্মসূচি। চীনের ইচ্ছে নিয়ন্ত্রণ রেখার এই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত করা। এ ক্ষেত্রে বেইজিং বেছে নিয়েছে তিব্বতের নিরীহ জনগণকে। তিব্বত থেকে তাদের তুলে এনে এই ৬ শ’ ২৪টি গ্রামে প্রতিস্থাপন করতে পারলে অরুণাচলের ওই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে তাদের দখলদারিত্ব আরও জোরদার হবে, এমনটাই মনে করছে চীনের শাসকগোষ্ঠী। বিশ্লেষকরা এটিকে চীনের আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদের আরও একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছেন।

ভারতের লাদাখ সীমান্তে আসল সীমারেখা নিয়ে টানটান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে ২০২০ সাল পাড় করেছে চীন। সেখানে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকবার। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ভারতের অরুণাচল সীমান্তরেখার বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে ১ শ’টির বেশি বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে তিব্বত থেকে লোক নিয়ে এসে থাকার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে চীন। ভারতীয় সামরিক বিশ্লেষকদের দাবি এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে নতুন দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হবে; এটা সংঘাতের মধ্যে উস্কানি বৈ অন্য কিছু নয়।

সদ্য প্রকাশিত উপগ্রহের চিত্র অনুসারে, ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দাবি ‘চীন মূল তিব্বত থেকে লোকজন এনে অরুণাচলের বিরোধপূর্ণ ভারতের সুবানশ্রী জেলার পাশ থেকে প্রবাহিত তশ্রী চু নদীর অববাহিকায় তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করছে। এর পেছনে চীনের দুরভিসন্ধি হচ্ছে তারা সীমান্তে বেসামরিক নাগরিকদের সমাবেশ করে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়; বিরোধপূর্ণ এ অঞ্চলে চীন দখল বাড়াতে তিব্বত থেকে বেসামরিক লোকজন ধরে নিয়ে এসে এই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছে । এজন্য আরও নতুন ৬ শ’ ২৪টি নতুন গ্রাম তৈরি করতে যাচ্ছে। উল্লিখিত গ্রামটি তাদের সেই পরিকল্পনার প্রথম পর্ব।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিযোগ করছে, গালওয়ান উপত্যকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওএসি) মেনে চলার জন্য গত বছর দু’পক্ষের মধ্যে যে ঐকমত্য হয়েছিল; অরুণাচলে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে বসতি নির্ধারণ করে চীন তার প্রতিশ্রুতি আবারও ভঙ্গ করেছে।

১৯৬২ সালে ইন্দো-চীন যুদ্ধের পর থেকেই অরুণাচল প্রদেশের এ অঞ্চলটি চলমান সীমান্তবিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে তোলা স্যাটেলাইট চিত্রগুলোতে এ অঞ্চলকে তৃণভূমি হিসেবে দেখা গেলেও এখন সেখানে সারি সারি এক তলা পাকা ঘর। সিনহুয়ার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ বাড়িই গত বছরের অক্টোবরে নির্মিত হয়েছে। এ সমন্ধে চীনা কর্মকর্তা ও পর্যবেক্ষকরা বলেছেন যে, এই উন্নয়ন বেইজিংয়ের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের একটি অংশ।

অরুণাচল ভারতের প্রদেশ হলেও বেইজিংয়ের ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে দক্ষিণ তিব্বত হিসেবে তাদের এলাকা বলে দাবি করে আসছে।

আসল নিয়ন্ত্রণ রেখা নিয়ে কয়েক দশক ধরে চীন ও ভারত সীমান্তবিরোধে রয়েছে এবং গত বছরের জুনে দু’পক্ষের সেনারা গালওয়ান উপত্যকায় মারাত্মক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই এই এলাকায়ও অস্বস্তি ও উত্তেজনা দেখা দেয়। এরপর থেকে দুপক্ষই সামরিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত হয়। কিছুদিন এভাবে চলার পর চীন তাদের কৌশলে পরিবর্তন আনে। এরপর থেকে এ অঞ্চলে সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি তিব্বত থেকে লোকজন এনে এলাকায় পুনর্বাসনের কাজ শুরু করে।

গত সপ্তাহের শেষদিকে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চুনিং নির্মাণ কার্যক্রম সবটুকুই চীনের ভূখণ্ডের মধ্যে করা হয়েছে দাবি করে বলেন, ‘২০১৭ সালে গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণে বেইজিংয়ের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই গ্রামটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের জন্য নতুন রাস্তাগুলোর উন্নয়নের ফলে স্থানীয় দরিদ্র তিব্বতদের পুনর্বাসনে ভাল কিছু করার সুযোগ ছিল’।

সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ সাউথ এশিয়া স্টাডিজের পরিচালক ঝাং জিয়াডং বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও ভারত উভয়ই এই বিবদমান অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল।

তিনি বলেন, ‘এর উপায়গুলোর মধ্যে বাসিন্দাদের সীমান্তের কাছাকাছি থাকতে এবং রাস্তাঘাট, সেতু এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো তৈরি করার কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল।’

তিনি বলেন, উভয়পক্ষই সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার চেষ্টা করছে এবং উভয়ই ছাড় দিতে রাজি নয়।

লানজু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ঝু ইয়ংবিয়াও বলেছিলেন নতুন এই স্থাপনা আগে থেকেই ছিল। চীন সেখানকার জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে অবকাঠামো উন্নীত করেছে, যোগাযোগের ব্যবস্থা ও জল স্যানিটেশন সুবিধার মতো নতুন সুবিধাদি তৈরি করেছে।’

দিল্লির একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের কৌশলগত স্টাডির অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানী বলেছেন, বিতর্কিত হিমালয় অঞ্চলে বেইজিংয়ের গ্রাম-নির্মাণ কার্যক্রম তার আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদের আরও একটি প্রমাণ।

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা কর্নেল সৌমিত্র রায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বায়ুসেনার উপস্থিতি অরুণাচলে বেশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে গত কয়েক বছরে। নতুন রাস্তা এবং রেললাইন তৈরি হচ্ছে সীমান্ত বরাবর। আগে এই সড়ক ও রেলপথ তৈরির কাজ এবং এলাকায় অন্যান্য পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ ইচ্ছাকৃতই করা হতো না বলে কর্নেল রায়ের দাবি।

তার কথায়, ‘ভারতীয় সেনা যেহেতেু আগে শুধু আত্মরক্ষার নীতি নিয়ে চলত, সেহেতু চিন সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চল পরিকাঠামো বাড়ানো হতো না। কারণ আমরা মনে করতাম, চীন যদি কোনোভাবে ভিতরে ঢুকে আসে, তা হলে ওই সব সড়ক ও রেলপথ ব্যবহার করে চীন আরও সহজে ভারতের অনেক ভিতরে ঢুকে পড়বে। কিন্তু এখন নীতি অন্য রকম। প্রতি-আক্রমণ নীতি নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। তাই দ্রুত পরিকাঠামো বাড়ানো হচ্ছে অরুণাচল সীমান্তে।’

শুধু যোগাযোগ পরিকাঠামো কিন্তু নয়, প্রত্যক্ষ রণসজ্জাও দ্রুত বাড়ানো হচ্ছে অরুণাচল প্রদেশে। গত কয়েক বছরে অরুণাচল সীমান্তের কাছাকাছি বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড বা সীমান্তবর্তী বিমানঘাঁটি তৈরি করেছে ভারত। এই বিমানঘাঁটিগুলোর অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়। কিন্তু ১৯৬২-র যুদ্ধের পর থেকে সেগুলো মোটের উপর পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেগুলোরই মেরামতি এবং ব্যাপক আধুনিকীকরণ ঘটিয়ে চারটি অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড ইতোমধ্যেই অরুণাচলে বানিয়ে ফেলেছে ভারত। জিরো, আলং, মেচুকা এবং ওয়ালং— এই চারটি জায়গায় অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে। এতটাই আধুনিক করে গড়ে তোলা হয়েছে পাসিঘাট বিমানঘাঁটিকে যেসব ধরনের আধুনিক যুদ্ধবিমান এবং সুপার হারকিউলিক ১৩০জে-এর মতো দৈত্যাকার বিমানও ওঠানামা করতে পারবে সেখান থেকে। চীন সীমান্ত থেকে মাত্র ১ শ’ কিলোমিটার দূরে এই পাসিঘাট। সড়ক তৈরি, পরিকাঠামো বৃদ্ধি এবং এই পাঁচটি অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড তৈরি করেই থেমে থাকছে না ভারত। আগামী আট-ন’ মাসের মধ্যেই টুটিং এবং তাওয়াং-এ খুলে যাচ্ছে আরও দু’টি সীমান্তবর্তী বিমানঘাঁটি। অর্থাৎ অরুণাচল প্রদেশে চীনের সামনে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর তৈরি করে ফেলছে ভারত।

আপাতদৃষ্টিতে দু’পক্ষকেই দেখা যাচ্ছে যে যার অবস্থান থেকে এক বিন্দু নড়তে অটল। গত বছর লাদাখ নিয়ে কাটানোর পর এ বছর দু’পক্ষেরই চোখ অরুণাচলে। আসল নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপাশে চীন অংশে এতবছর লোকবসতির তেমন প্রমাণ না পাওয়া গেলেও গত বছর থেকে এলাকাগুলোতে বেসামরিক নাগরিকদের প্রতিস্থাপন শুরু করেছে। এ নিয়ে টানটান উত্তেজনার বাতাস বেইজিং থেকে দিল্লিতে এসে পৌঁছেছে।

এতে দীর্ঘ দিন ধরে মুখ ফিরিয়ে রাখার পরে ভারত অরুণাচলে তার সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি ওই অঞ্চলের জনগণের সুবিধার জন্য অবকাঠামো উন্নয়েনর দিকে নজর দিয়েছে। নির্মিত হচ্ছে নতুন রাস্তাঘাট স্কুল হাসপাতাল। তবে এটা নিশ্চিত দু’পক্ষই চেষ্টা করছে সম্ভাব্য সব সংঘাত এডিয়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করা।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর