বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়

  •    
  • ২৬ জানুয়ারি, ২০২১ ১৫:১৪

প্রকৃতপক্ষে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে ছাত্র আন্দোলন জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। কিন্তু মূল নেতৃত্ব থাকে কুশলী ছাত্রনেতা অনলবর্ষী বক্তা তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাতে। সে সময়ে আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ কয়েকটি দলের নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি বা ডাক পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র, সর্বজনীন ভোটাধিকার ও রাজবন্দিদের মুক্তিসহ আট দফা দাবিতে আন্দোলনে সামিল ছিল।

উনসত্তরের ছাত্র গণ-আন্দোলনকে যথার্থভাবেই ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সাল হিসেবে গণ্য করা হয়। দ্রুত গতিবেগ সঞ্চার করা অবিস্মরণীয় এই আন্দোলনে ১১টি দাবি তুলে ধরা হয়, যার প্রথমটি ছিল শিক্ষা-সংক্রান্ত।

‘ক’ থেকে ‘থ’ পর্যন্ত ১২টি ধারায় বিভক্ত ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়- সচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকীকরণ নীতি পরিত্যাগ ও জগন্নাথ কলেজসহ প্রাদেশিকীকরণকৃত কলেজসমূহকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। ‘ঢ’ ধারায় ছিল- যানবাহন, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আইডেনটিটি কার্ড দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ৫০ ভাগ কনসেশন।আমার মনে আছে, ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ১১ দফা আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করার সময় এই দাবিটিতে সবচেয়ে বেশি করতালি পড়েছিল। কিন্তু আন্দোলন শুরু হতে না হতেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সামনে আসে দুটি দাবি- পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন (তিন নম্বর অনুচ্ছেদে ৬টি ধারায় বিভক্ত) এবং ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে সকল রাজবন্দির মুক্তি।

লক্ষণীয়, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘোষিত স্বায়ত্তশাসনের অতি জনপ্রিয় কর্মসূচি ৬-দফার প্রতিটি দফা কর্মসূচিতে হুবহু স্থান পেলেও ৬ দফা শব্দটি উচ্চারিত হয়নি। একইভাবে জনপরিসরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিটিই মুখ্য হওয়ার পরও তার নাম বন্দিদের তালিকায় উল্লেখ করা হয়নি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদভুক্ত একাধিক ছাত্র সংগঠনের সংকীর্ণ মনোভাব এর পেছনে ছিল। একইসঙ্গে বৃহত্তর ঐক্যের জন্য সে সময়ের ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এমন ছাড় দিয়েছে, যা ছিল নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। রাজপথে নেমে ছাত্র-জনতা মূল দাবি সামনে নিয়ে আসতে ভুল করেনি।

১১ দফা আন্দোলনের সূচনা ঘটে ১৭ জানুয়ারি, বটতলায় ছাত্রসমাবেশের মধ্য দিয়ে। ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের নির্দেশে যখন কয়েকশ’ ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নামার চেষ্টা করে- প্রচণ্ড টিয়ারগ্যাস শেল ও লাঠিচার্জের মুখোমুখি হয় তারা। পরের দুই দিনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দৃশ্য- ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য যেকোনো বাধা মোকাবিলায় প্রস্তুত। ছাত্রসমাজ বাঁধ ভাঙে ২০ জানুয়ারি। বটতলা ও আশপাশের এলাকা হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায়। মূল দাবি সামনে আসে- ১৪৪ ধারা মানি না, আইয়ুবশাহী ধ্বংস হোক, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল কর।

ওই দিন মিছিলে গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় শহীদমিনার থেকে যে শোক মিছিল বের হয়, দৃপ্ত পদক্ষেপে তা এগিয়ে যায় পুলিশ-ইপিআর-এর ‘এক পা আগালেই গুলি’ হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে। পরের দিন ঢাকায় ডাকা হরতালে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে। ২৪ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী পূর্ণ দিবস হরতালে গোটা পূর্ব বাংলার জনগণকেই মনে হচ্ছিল রাজপথে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি ছিল অগ্নিগর্ভ।

২৪ জানুয়ারি ছিল শুক্রবার। হরতালের মিছিল ও পিকেটিংয়ের সময় ঢাকা শহরে গুলিতে ছাত্রসহ অন্তত চার জন নিহত এবং ১১ জন আহত হয়েছে। আরও দুজন নিহত হওয়ার পর পুলিশ লাশ নিয়ে গিয়েছে বলেও শোনা যায়।

দৈনিক আজাদ ও সংবাদ-এর বিবরণে হলা হয়েছে- শুক্রবার সমগ্র শহরটি বিক্ষোভের শহরে পরিণত হয়। প্রায় ৫ লাখ নাগরিক ঢাকার রাজপথে নেমে এসে পল্টন ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজায় যোগদান করে। রাস্তায় একটি সাইকেলও দেখা যায়নি। একটি দোকান খোলেনি। সংগ্রামী ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে আসাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য এই হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। মতিঝিল ও অন্যান্য এলাকার সরকারি ও বেসরকারি অফিসের হাজার-হাজার কর্মচারী অফিস ত্যাগ করে ছাত্রদের বিক্ষোভে যোগদান করে। এমনকি ওয়াপদা, ডিআইটি ও এডিসির চেয়ারম্যানগণও ছাত্রজনতার আহ্বানে অফিস ছেড়ে রাস্তায় বের হয়ে আসেন। টঙ্গী, হাজারীবাগ, তেজগাঁও প্রভৃতি শিল্প এলাকা হতে ধর্মঘটী শ্রমিকরা মিছিল সহকারে বেলা প্রায় ১০টার দিকে শহরে প্রবেশ করে এবং শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে স্টেডিয়ামে জানাজায় শরিক হয়।

ঢাকায় মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও প্রভৃতি এলাকার ছাত্ররাও মিছিল সহকারে শহরের বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। শ্রমিক-ছাত্রসহ সব মিছিলেই কালো পতাকা ছিল। বাণিজ্যিক এলাকা দিলকুশা-মতিঝিলের বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকবীমা কোম্পানি ও বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী দলে-দলে অফিস থেকে বের হয়ে ছাত্র মিছিলে যোগ দিতে থাকেন। ছাত্র-জনতা ওয়াপদা অফিস ঘেরাও করলে কর্মচারীরা স্লোগান দিয়ে বের হয়ে আসে। ওয়াপদার চেয়ারম্যান মাদানী সাহেব রাস্তায় নেমে বলেন, মিছিলে অংশগ্রহণ কর্মচারীদের ইচ্ছাধীন। এতে তার আপত্তি নেই। এরপর জনতার মিছিল ডিআইটি প্রাঙ্গণে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ডিআইটির চেয়ারম্যান আবুল খায়েরসহ কর্মচারীরা অফিস থেকে বের হয়ে আসেন। অতঃপর মিছিল এডিসি অফিসের কাছে এলে সেখানকার কর্মচারীরাও বের হয়ে আসেন। সেই সঙ্গে এডিসির চেয়ারম্যান এ কে এম আহসানও রাস্তায় বের হন। ক্রমান্বয়ে মিছিলগুলোতে ছাত্রর চেয়ে অফিস কর্মচারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।

একই সময়ে তোপখানা রোড দিয়ে এবং জিন্নাহ এভিনিউতে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) দুটি বৃহৎ মিছিল এসে স্টেডিয়ামের গেইটের কাছাকাছি উপস্থিত হয়। একই সময়ে ছাত্রদের আবেদনে কয়েকশ’ সরকারি কর্মচারী সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেট দিয়ে বের হয়ে আসেন। কিছুক্ষণ পরেই সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেট থেকে আরও কয়েকশ’ কর্মচারী বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ ভেতর থেকে গেট বন্ধ করে দেয়। পুলিশ সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে সমানে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। বিক্ষুব্ধ জনতা নিক্ষিপ্ত গ্যাসের শেল বুমেরাং করে পুলিশের দিকেই নিক্ষেপ করতে থাকলে তারা পালিয়ে যায়।

দুপুরের দিকে আদমজী ও ডেমরা শিল্পাঞ্চলের হাজার হাজার শ্রমিক মিছিল করে ঢাকায় আসে। পল্টন ময়দানে নিহতদের জানাজায় আশেপাশের সব এলাকা ছিল লোকারণ্য। সবার কণ্ঠে স্লোগান, শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। শেখ মুজিবের মুক্তি চাই। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মানি না। আইয়ুব-মোনায়েম ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।

বিক্ষুব্ধ জনতা পল্টন ময়দানের নিকটস্থ গভর্নর হাউস ও সচিবালয় জ্বালিয়ে দিতে চাইছিল। সে সময় তরুণ ছাত্রনেতারা অভাবনীয় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে মিছিলের গতিপথ পরিবর্তন করে তৎকালীন ইকবাল হলে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। সেখানে পরদিন হরতাল ঘোষণা করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টানা ৩৬ ঘণ্টা কারফিউ জারির খবর আসে। কিন্তু জনতা কোনো বাধা মানেনি। ঢাকায় কারফিউ ভেঙে মিছিল হয়। গোটা পূর্ব পাকিস্তানে পালিত হয় হরতাল। ছাত্রনেতারা জনগণের কাছে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠেন। তাদের প্রতিটি নির্দেশ এমনকি সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিসার ও সাধারণ কর্মীরাও পালন করতে থাকে হরতাল। বিমানবন্দরে আসা পশ্চিম পাকিস্তানের ক’জন সামরিক ও বেসামরিক অফিসার হরতালে আটকা পড়ে। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের বলেন- ‘তোফায়েল আহমেদের অনুমতি ছাড়া শহরে প্রবেশ করা যাবে না।’ ১১ দফায় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের দাবি যুক্ত করার জন্য আন্দোলনের কেন্দ্র ইকবাল হল, ডাকসু অফিস ও মধুর ক্যান্টিনে অগণিত নারী-পুরুষ হাজির হতে থাকে। ছাত্রসমাজের ওপর জনগণের আস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, কারখানায় শ্রমিক ও মালিকের দ্বন্দ্ব থেকে পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য মেটাতেও ছাত্রনেতাদের মধ্যস্থতা কামনা করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে ছাত্র আন্দোলন জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। কিন্তু মূল নেতৃত্ব থাকে কুশলী ছাত্রনেতা অনলবর্ষী বক্তা তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাতে। সে সময়ে আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ কয়েকটি দলের নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি বা ডাক পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র, সর্বজনীন ভোটাধিকার ও রাজবন্দিদের মুক্তিসহ আট দফা দাবিতে আন্দোলনে সামিল ছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে আশা-ভরসাস্থল হয়ে ওঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র রাজপথে যে জনতার ঢল নামে, তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং এ দাবির প্রধান কণ্ঠ হয়ে ওঠা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি। জনগণের অভূতপূর্ব আন্দোলন তাকে ক্যান্টনমেন্টের বন্দিশালা থেকে মুক্ত করে বরণ করে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার নয়নমণি।

উনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুথানের ধারাবাহিকতায় নতুন স্লোগান সামনে আসে- জয় বাংলা, পিন্ডি না ঢাকা ঢাকা, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। এ বছরের শেষদিকে ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রদেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। যা ছিল ‘প্রদেশ’, জনগণের অবিসংবাদিত নেতার কণ্ঠে ‘দেশ’ হিসেবে তা স্বীকৃত হয়ে যায় সে দিনটি থেকে। পরের বছর সত্তরের নির্বাচনে এই বাংলাদেশের জনগণ ৬ দফার প্রশ্নে ম্যান্ডেট প্রদান করে। একাত্তরের মহান মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ‘দেশ’ পরিণত হয় স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রে। ২৪ জানুয়ারি মহান গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য এভাবেই পূরণ হয়।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর