মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং সর্বোপরি মুক্তির স্পৃহা যা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতে জনমনে সংহতি নির্মাণ করেছিল, যে গুণাবলি দেশের জন্য শীর্ষ ত্যাগে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তার অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় স্বাধীনতার পর পর। এর একটি বড় কারণ হলো- যুদ্ধের সময়টাতে অর্থবিত্তের সঙ্গে শেকড়বিহীন জনগণের অবস্থান এবং ভৌগোলিক ভূমির চেয়ে মনোজাগতিক ভূমির নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন। যে মঙ্গলময় চিন্তা ও আকাক্সক্ষা আপন আত্মার ক্ষুদ্র বলয়কে ছিন্ন করে, ব্যক্তিকে সর্বজনীন আবর্তে নিয়ে গিয়েছিল, তা স্বাধীনতার পর পর যেমন ছিন্নপত্রের মতো ভেসে যায় তেমনি, বাস্তবতার চাপে, স্বার্থান্ধ চিন্তার আবর্তে, ব্যক্তির শুদ্ধ অবস্থান ও মূল্যবোধ গভীর অতলে হারিয়ে যায়।
বৃহত্তর চাওয়ার মাঝে যে ক্ষুদ্র চাওয়া এবং সংকীর্ণ চিন্তাগুলো চাপা পড়েছিল, সেটাই স্বাধীনতার পর মুখ্য হয়ে ওঠে। এতে গৌণ হয়ে ওঠে সর্বজনীন liberty এবং ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা। শক্তি ও ঔদ্ধত্যের কাছে, arrogance of power-এর কাছে পরাভূত হয় মানুষের অধিকার ও মর্যাদা; গৌণ হয়ে ওঠে শান্তির অন্বেষণ। যে আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে দর্শনের চিন্তাগুলো আবর্তিত হয়, তা ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কারণে constructive দর্শন তৈরি অসম্ভব হয়ে ওঠে। এটা ঠিক যে শূন্যতার মাঝে, নাস্তির মাঝে দর্শনের বিকাশ হতে পারে যেটা হয়েছিল ইউরোপে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। সেটি না হয়ে স্বাধীনতা-উত্তর সমাজে, শূন্যতা, হতাশা, anarchy ও arrogance of power বা সংঘাত সহিংসতার নেতিবাচক দর্শনের চর্চা শুরু হয়। পশ্চাৎপদ চিন্তা ও মনের শূন্যতা মৌলবাদী কর্মের পথকে সুগম করে দেয়। বিচারের প্রতি, জীবনের প্রতি এবং সামগ্রিক জীবনের ইতিবাচক প্রবাহের প্রতি আস্থা হারিয়ে, হতাশাগ্রস্ত জাতি কেবল আত্মপরিচয়ের সংকটে নয়, অস্তিত্ব¡ সংকটেও নিমজ্জিত হয়। জীবনের সংগ্রাম এবং অসম প্রতিযোগিতায় নিম্নবর্গের মানুষ তেমনি সব হারিয়ে শেকড়ছাড়া, গৃহছাড়া অনিকেত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এ ধারায় পথভ্রষ্ট মানুষ মিথ্যে শ্লাঘার জগৎ নির্মাণ করে নানা অনুচিৎ ভূমিতে, আপনসীমা অতিক্রম করে।
যে প্রেম ও মানবতা নানামুখী ভেদজ্ঞানকে নিম্নপর্যায়ে এনে বেদনার বাঁধন মাঝে মানবসত্তাকে সমুজ্জ্বল করেছিল, সেই প্রত্যক্ষ বেদনা নিম্নস্তরে নেমে আসায় বহিরাগত শত্রæ অলক্ষ্য ছায়া মানুষ হয়ে ওঠে, আর আপন মানুষগুলোই স্বার্থের টানাপড়েনে নতুন শত্রু হয়ে ওঠে। আশ্চর্যজনকভাবে যে নষ্টচিন্তা, মৌলবাদী দর্শন এবং পশ্চাৎপদ চিন্তা অন্তরে ধারণ করে শত্রæপক্ষ বাঙালিনিধনে মত্ত হয়েছিল, গণহত্যার মতো নিকৃষ্ট কাজে হয়েছিল ব্যাপৃত, সেই দর্শন ও ঘাতকের বাণীকেই অনেকে আপন করে নেয়। যে নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় ঘাতক নিরীহ মানুষদেরকে হত্যা করেছিল, যে পৈশাচিক বিকারগ্রস্ত চিন্তাকে আপন করে নিয়ে বাঙালি নিধনকর্মকে সহজ করে নিয়েছিল, ওই কর্ম ও চিন্তাকে দেশের জনগণের একটি অংশ মনোজগতে আপন করে নিয়ে নিজ অস্তিত্ব ও ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নেয়। এতে এক কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা, এক রজ্জুতে বাঁধা মৃত্যুসঙ্গীর হিন্দু পরিচয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে।
আর ওই সাম্প্রদায়িকতা ও ভেদজ্ঞানের আবর্তে হারিয়ে যায় মানুষের মানব পরিচয়। যে আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী একাত্তরে সমগ্র জাতিসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল তা আবারও দেয়ালের ওপারে গহীন বনের বাসিন্দা হয়ে ওঠে, দেয়াল উঠে যায় আমি, তুমি ও তাদের মাঝে। সেতুবন্ধ নির্মাণ হয় লুটেরার সঙ্গে লুটেরার, ভাগ বাটোয়ারা হয় অবাঙালি সম্পত্তি ও হিন্দু সম্পত্তি এক আধারে রেখে। এই প্রক্রিয়াতে যে লুটেরা অর্থনীতির উদ্ভব হয় তা বদলে দেয় সমাজচিন্তা এবং রাষ্ট্রের দর্শন। যাপিত জীবন, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয়, জীবনের নানা আকাঙ্ক্ষাসহ সাধারণের অর্থবিত্ত ও সম্পদের যে কাঠামো মানুষের দর্শন ও মূল্যবোধ নির্মাণ করে, সেই স্থানটি একটি চূড়ান্ত স্খলনের মুখে পড়ে।
প্রতিটি যুদ্ধই মানুষের স্মৃতি, অনুভব ও বোধকে এমনভাবে নাড়া দেয়, যাতে তার চিন্তার উপাদান ও অলিগলি সবই বদলে যায়। এ কারণে কখনো সে শতবর্ষ এগিয়ে যায় বোধের ভূমিতে, আবার কখনো পিছিয়ে যায় হাজার বছর। যুদ্ধের ধ্বংস, আঘাত এবং চাপিয়ে দেওয়া অনিকেত জীবন মুছে ফেলে মানুষের চিন্তার ভূমি; কখনো হারিয়ে যায় কয়েকটি প্রজন্ম।
এই পরিবর্তিত চিন্তা ও দর্শনের আবর্তে, যুদ্ধ-সংক্রান্ত নানা আঘাতের আবর্তে, প্রতিটি মানুষ নতুন করে খুঁজে নিতে চেষ্টা করে আপনসত্তা ও অনুভবের ভূমিকে। নতুন করে সে নির্মাণ করে আত্মপরিচয়। যে মূল্যবোধের কারণে গ্রামীণ নারীটি বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটি নিটোল, নিস্তরঙ্গ পবিত্র জীবনে অভ্যস্ত ছিল সেই হয়ে ওঠে বেপরোয়া। অভ্যস্ত হয় নতুন ও নোংরা জীবনে। বাস্তুচ্যুত এবং অভিবাসী মানুষগুলো ভুবনে হয়ে ওঠে পরবাসী। অভ্যস্ত হয়ে ওঠে অনিকেত জীবনে; তৈরি হয় নানা বর্ণের বহুমাত্রিক মনের আবাসভূমি।
নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোতে নবতর আকাক্সক্ষা ও অভাবের জীবনে অধিকাংশ মানুষ হয়ে ওঠে এমন নুড়িপাথর, যার কাছে শ্যাওলা ও শেকড়ের গন্ধময় হারানো জীবনটি বর্জ্য বৈ কিছুই নয়। লোভের আবর্তে, ভোগের আবর্তে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার অনুসন্ধানের স্পৃহা, নিজের অজান্তে সে হয়ে ওঠে ক্ষমতাবানদের ক্রীড়ানক এবং ভোগবাদী সমাজের পণ্য। যে আত্মজিজ্ঞাসা আদিম দর্শনের উদ্ভব ঘটিয়ে থাকে তা হয়ে ওঠে দূর চিন্তার বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর সব হারিয়ে মানুষগুলো একাকী বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ববাদী চিন্তায় যেমন মগ্ন হয়েছিল। তেমন চিন্তায় আধা সামন্তবাদী এই দেশের মানুষ আবিষ্ট না হলেও জীবনের প্রয়োজনে, স্বার্থের অনুপ্রেরণায়, বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হয়ে ওঠে। বিবাদের সময় যে মানুষগুলো ইতিবাচক চিন্তা ও বিশ্বাসের মাঝে মুক্তি খুঁজেছিলো, সেই মানুষগুলোর কেউ কেউ বিকৃত ও অসুস্থ চিন্তা এবং ততধিক বিকৃত নাস্তিক্যচিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে। সর্বোপরি, প্রাধান্য পায় স্বার্থচিন্তা ও ভোগবাদ। অধিকাংশ মানুষ ভোগবাদী সমাজের ক্রীড়নক ও খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। অদূরদর্শী চিন্তার কারণে গভীর চিন্তাগুলো ও আত্মার মৌলিক জিজ্ঞাসাগুলো গৌণ হয়ে ওঠে।
আঁধারময় এই শূন্যতার মাঝে, হতাশার মাঝে, স্বাভাবিকভাবে নড়বড়ে হয়ে ওঠে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস। এতে করে বিপন্ন মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে হাতড়িয়ে বেড়ায় একটি আস্থার ভূমি, বিশ্বাসের ভূমি এবং আশার সুবর্ণ রেখা। নানা অপ্রাপ্তিতে হতাশ হয়ে, ইহজাগতিক বিচার না পেয়ে, মানুষ যুক্তির পথ ছেড়ে অদৃষ্টবাদিতা এবং নানা কুসংস্কারের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়টাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনটাই ছিল সাধারণের মনের অবস্থা। যে ইতিবাচক ধর্মচিন্তা মানুষকে ইতিবাচক কাজে প্রণোদনা জোগায়, শুদ্ধ করে, সুন্দর করে তাও নানা কারণে, সঠিকভাবে কেলাশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। সামাজিক ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক চিন্তা অবলম্বন করে, শান্তিকে Paradigm of development and civilization মনে করে যে রাষ্ট্রচিন্তা আবর্তিত হয়, তাই হতে পারে আমাদের প্রার্থিত রাষ্ট্র দর্শন।
বাট্রান্ড রাসেল তার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধে উল্লেখ করেন- In dark days, men need a clear faith and a well grounded hope; which take no account of hardships by the way. এদেশে এই বিশ্বাসটি বিভ্রান্তের আবর্তে পরায় মৌলবাদের পুনরুত্থানটি সহজ হয়ে ওঠে।
’৭১-এর স্বাধীনতার পর পর যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়টাতে এটাই ছিল সত্য। সেই সময়টাতে কেউ ঘাড় ফিরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনটাকে যাচাই করতে যায়নি। সুফি সাধকদের উত্থান, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামীদের বিদ্রোহ এবং বাউল জাগরণের পর থেকে সংস্কৃতির পথ ধরে ভাষাভিত্তিক সত্তা নির্মাণ যে সর্বজনীনতার আবহ সৃষ্টি করে তার মাঝে ছাপার অক্ষরে লেখা যায়, এমন কোনো দর্শন খুঁজে না পাওয়া গেলেও সাধারণের যাপিত জীবনে অলক্ষ্য, অনুচ্চারিত একটি দর্শনের ছোঁয়া ছিল। ওই দর্শনটি মানুষের অন্তরে নির্মাণ করেছিল সহমর্মিতা ও মর্যাদাবোধ। তাই মানুষের ক্রোধ ও ভেদজ্ঞান কমিয়ে মানুষকে করে তোলে সহনশীল। যে সা¤প্রদায়িক চিন্তা ভিত্তি করে ভারত বিভাগ বাস্তবায়িত হয়, তা নিতান্তই হয়ে ওঠে অতীত বর্জ্য বিষয়। এ কারণেই ’৭১-এ জাতিধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সবাই আপন মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের একটি চূড়ান্ত সংগ্রাম তথা মুক্তির যুদ্ধে শরিক হয়। এই যুদ্ধের মাঝেই এদেশের মানুষ আরও পরিশিলীত হয়ে অধিকতর মানবিক ও অসা¤প্রদায়িক হয়ে ওঠে। এ কারণেই চুকনগরের মো. এরশাদ আলী মোড়ল, হিন্দু ঘরের শিশুকে নিসংকোচে আপন করে নেয় এবং হিন্দু পরিচয়ে প্রতিপালন করে। এ কারণেই যশোরের কাঠি হুজুর মাদরাসার সংকীর্ণচিন্তা অতিক্রম করে মন্দকে মন্দ বলে চিনিয়ে দেয় এবং ধ্বংসের মাঝে সুন্দর পৃথিবী খোঁজার চেষ্টা করে।
যেকোনো দেশের জনতার যুদ্ধ জীবনের অধিকার আদায়ের চূড়ান্ত রূপ। যুদ্ধের পেছনে রাজনীতির নানা ছায়া থাকলেও, কৃষকের আকাক্সক্ষা ও সাধারণের আকাক্সক্ষার কাছে তা পশ্চাৎপদ ওঠে।
যে চিন্তাগুলো আপন উপলব্ধির বলয় ছিন্ন করে বৃহত্তর ঐক্য নির্মাণ করে এবং Integration -এর মাধ্যমে একটি মানবতার মহাসমুদ্র সৃষ্টি করে তার মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মলিনতা গৌণ হয়ে ওঠে। স্বার্থের ক্ষুদ্র বলয়ে, রাজনীতির অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই লাভের হিসাব এবং পাপের মলিন ছোঁয়া প্রকট হয়ে ওঠে। সমষ্টির বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য যে রাজনীতির সূচনা হওয়া উচিত তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি অহংবোধ ও স্বার্থচিন্তার আবর্তে হারিয়ে যায়। ‘Agree to disagree’ বিষয়টি দূর চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। একজন মন্দ শিক্ষক তার আপন জ্ঞানকে যাচাই বাছাই না করে তা সত্য প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবেই স্বাধীন দেশে মুক্তচিন্তা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য Authoraterian চিন্তাভাবনার কাছে পরাভূত হয়। গুটিকয় মানুষের অহংপরিপুষ্ট স্বার্থান্ধচিন্তার কাছে গৌণ হয়ে যায় কোটি মানুষের মঙ্গলভাবনা। এতে, জাতি ব্যর্থ হয় সামষ্টিক চিন্তার সুফল পেতে। স্বার্থান্ধ চিন্তা, লোভ এবং শক্তির নির্বিচার প্রয়োগ জাতিকে শান্তি ও মঙ্গলভাবনা থেকে বহু দূরে নষ্ট দর্শনের দিকে ঠেলে দেয়। এই নষ্ট দর্শন ভিত্তি করে যে লুটেরা সংস্কৃতি ও পরজীবী অর্থনীতির বিকাশ হয় তা মানব চরিত্র নির্মাণে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুস্থ প্রাপ্তিতে মানুষের মধ্যে যে, সুখবোধ ও তৃপ্তি সৃষ্টি করে সেটি যখন অসুস্থ অর্থনীতির আবর্তে ক্ষতবিক্ষত হয় তখন স্বাভাবিকভাবে অরাজকতা ও নানা নষ্ট ভাবনায় আচ্ছন্ন হয় সাধারণ মানুষ।
ধর্ম ও Metaphysics-ভিত্তিক জিজ্ঞাসাগুলো মানব মনে জেগে ওঠে আত্মজিজ্ঞাসার মাঝে। আপন ও পরমকে খোঁজার মাঝে জীবনের চূড়ান্ত চাওয়া বা Purpose-কে খোঁজার মাঝে যে দর্শনের উদ্ভব তার নানা স্তর, নানা অবয়ব ও নানা প্রকাশ রয়েছে। Ur ও হিট্টিদের বোধের মাঝে, সুমেরীয় ও মিশরীয়দের চর্চিত জীবন ও অভিজ্ঞতার মাঝে যে দর্শন ও Code of Conduct কেলাশিত হয়, তাই Hellenstic দর্শনকে শক্ত মাটিতে প্রথিত করে।
বহু দেশ ও জাতি যখন ধর্মভিত্তিক দর্শনে পা রাখতে পারেনি সেই সময়টাতে অ্যারিস্টটল যে দর্শনের চিন্তা করেন, তার মাঝে Theoretical, Mathemetical, Metaphysical, Practical, Political ইত্যাদি সব দর্শনই ছিল। তিনি যে Logic অনুসরণ করে চিন্তার স্তরে প্রবেশ করতে চেয়েছেন অথবা Thought forms -কে বিভাজন করতে চেয়েছেন তা দীর্ঘ সময় অননুকরণীয় থেকে গেছে।
চিন্তার গভীরে পৌঁঁছাবার জন্য Kant যে যুক্তি ও পদ্ধতি প্রয়োগ করে এবং Transendetal logic-এ অনুপ্রবেশ করে। তা ক্রমে আমাদেরকে বিতর্কমুক্ত Mathemetical logic-এ নিয়ে যায়। ওই Mathemetical logic-ই সত্য-সংক্রান্ত নানা ধারণা ও বিজ্ঞানের ধারণাকে চূড়ান্ত অগ্রগামী অবস্থায় নিয়ে যায়। রস-কষহীন এই অঙ্কের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কেউ প্রকৃতি ও মনস্তত্তে¡র দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে মানব জাতির আকাক্সক্ষা, প্রাপ্তি ও চাওয়ার মাঝে সেতুবন্ধন নির্মাণ করে প্রাপ্তি, শান্তি ও স্বস্তির জায়গাটি নিশ্চিত করেছে। এই প্রাপ্তির পূর্ণতা বিষয়ক প্রশ্নগুলো বা প্রাপ্তির যথার্থতা আমাদেরকে Sceptic দের আবর্তে নিয়ে গেছে।
স্বাধীনোত্তর সময়ে, এসব চিন্তা অন্তরে ধারণ করে, স্টুয়ার্ট মিলের Liberty ও Utilitarianism অনুসরণ করে আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার অর্জনগুলোকে মূল্যায়ন করা উচিত ছিল। মূল্যবোধ ও Morals সুরক্ষা দেবার জন্যই এমন পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল। এটি কেবল আইন প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করা হয়ত সম্ভব ছিল না। তবে শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন এনে এটি প্রয়োগ করা আজও সম্ভব। এ কাজটি সুচারুভাবে করতে না পারার কারণে জাতি আজ সংঘাত, সহিংসতা, অবিচার ও নিষ্ঠুরতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে প্রকৃত সাম্য ও শান্তির ভূমি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হচ্ছে।
উৎপাদন ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না এনে সমাজতন্ত্রের চিন্তায় বিভোর তরুণরা জাতিকে পেছনেই ঠেলে দিয়েছে। মৌলবাদী এবং তাদের সমর্থকগণ আমাদেরকে নিয়ে গেছে অন্ধকার বিবরে।
প্রাণের গভীরে প্রথিত আকাক্সক্ষা, অন্তর্গত নানা চাওয়া, প্রেরণা, পরিবার ও সমাজের সামষ্টিক স্বপ্ন আমাদের মনন ও সত্তাকে নির্মাণ করে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রবণতা ও জৈবিক ইচ্ছার বাইরে আমাদের স্বপ্ন ও আত্মপরিচয়ই চলার পথ নির্মাণ করে। এই আত্মপরিচয়ই ব্যক্তির দিকনির্দেশনা নির্মাণ করে।
বিশ্বজগৎ সম্পর্কিত আমাদের ধারণা এবং আমাদের দর্শনই আমাদেরকে চালিয়ে নেয়। আমরা তাই হয়ে উঠি, যা আমরা ভাবি এবং স্বপ্ন দেখি। মানুষের একটি বড় অংশ এই চলার পথে আপন অনুভব ও সাধারণ জ্ঞানকেই প্রাধান্য দেয়। কিন্তু অনুভবের বাইরে রয়েছে এক বিশাল জগৎ। এই ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অনুভব বিভ্রান্ত করে অনেককে। ক্ষুদ্র পরিসরে আহরিত সীমাবদ্ধ জ্ঞান এবং নির্বাচিত শর্তের উপরে গড়ে ওঠা অনুভব কতটা সত্যের কাছাকাছি তা ভাববার বিষয়। অলক্ষ্য নানা ঘটনাসহ ব্যক্তির নানা আকাক্সক্ষা, সামাজিক চাপ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব, নানা শক্তির প্রভাব, আমাদের পথচলাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্তরাত্মার চাওয়ার বাইরে পরিবেশের ভূমিকা এতে কম কিছু নয়।
জীবনের তৃষ্ণাতেই আমরা নানা ভাবনা, দর্শন ও ধর্মকে আঁকড়ে ধরি। আপন বিশ্বাস, আকাক্সক্ষা ও আচারের মাঝে আপনাকে খুঁজে নেওয়াটাই ধর্ম। পরমেশ্বর এবং আস্থার ভূমিটি খুঁজে পাওয়াই ধর্মের লক্ষ্য। প্রতিটি ধর্মের কেন্দ্রে রয়েছে ঈশ্বরভাবনা, শুদ্ধ ভাবনা ও নির্মলতার অনুসন্ধান; এর মাঝে রয়েছে মঙ্গলময় একটি ছায়ার জন্য অনন্ত তৃষা।
ভিন্ন আলোকে ধর্ম বলতে বোঝায় এমন চৈতন্য নিহারিকা যা আপন দীপ্তিতে পথ দেখায়- যে পথ জ্ঞানের। ধর্ম মানে জীবলোকের চরিত্র। যে বিশ্বাস অস্তিত্ব নির্মাণ করে, পথচলা নির্ধারণ করে, যা পূজা ও পূর্ণতার জন্য আদর্শ নির্মাণ করেÑ তাই ধর্ম। ভগবদ্গীতার ব্যাখ্যাকালে ড. রাধাষ্ণৃষ্ণণ বলেন, Dharma literally means mode of being. It is the essential nature of a being that determines its mode of behaviour. So long as our conduct it is in conformity with our essential nature, we are acting in the right way. Adharma is nonconformity to our nature. The Bhagavadgita, by Radhakrishnan - (page-155).
ধর্ম যেমন সিংহভাগ মানুষকে চালিত করে, তেমনি তা আত্মপরিচয় নির্মাণে অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করে।
মানুষের আত্মপরিচয় অনেকটা মালার মতোÑ অনেকগুলো পরিচয় বা পরিচয়ের সমাহার যেমন একসঙ্গে গেঁথে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আপন পরিচয় ধারণ করে, তেমনি কিছু বর্জন বা নতুন করে কিছু গ্রহণ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন সমধর্মী ও সমগোত্রীয় পরিচয়গুলো বৃহত্তর পরিচয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়, তেমনি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের সমাহার একটি একক পরিচয়ের মোড়কে ঠাঁই নেয়। জাতীয়তা বা লিঙ্গ এর উদাহরণ। কারা কোন পরিচিতি বেছে নিচ্ছে বা সংঘবদ্ধভাবে কাজ করছে তার সঙ্গে Belonging -এর প্রশ্নটি জড়িত।
উর্ধ্বমুখী চিন্তায় আচ্ছন্ন সাধারণ মানুষগুলো আত্মবীক্ষণ ও নিরন্তর অনুতাপ ও পরিতাপের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে শুদ্ধ করার চেষ্টার মাঝে খুঁজে পায় তাদের ধর্ম। আত্মার শূন্যতা, পূর্ণতার আকাক্সক্ষা ও শুদ্ধতার তৃষ্ণার মাঝে সেতুবন্ধন নির্মাণ করে ধর্ম। বিশ্বাসের বর্ম নিয়ে ভয়কে জয় করে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা এবং চিরজীবী হওয়ার জন্যই যুগে যুগে ধর্মকে আঁকড়িয়ে ধরেছে মানুষ। আর ক্ষমতাবানগণ ক্ষমতার চর্চা করার জন্য সাধারণের বিশ্বাসকে ব্যবহার করেছে।
নিঃসন্দেহে ধর্ম এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ব্যক্তিসমষ্টি, গোষ্ঠী ও জাতির ভাবনা ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। ধর্ম মানুষের জীবনে কতটুকু প্রয়োজনীয় কিংবা কতটুকু সত্য ও সঠিক এ বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ব্যাপকভাবে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। যদিও ভয়, হতাশা এবং ধ্বংস থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ সাধারণভাবে ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে, তারপরও এটি নির্মম সত্য যে, অনেকক্ষেত্রে ধর্ম নতুন করে ভয়, ঘৃণা ও ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে। এটি কেবল নিজের ধর্মকে সত্য এবং নিজের ঈশ্বরকে পরম মনে করার জন্য নয়, এটি অপরকে হীন ও দূরের মানুষ মনে করার জন্য।
যে আশা, বিশ্বাস এবং সাহস একটি ধর্ম সৃষ্টি করার কথা তা অনেকক্ষেত্রে ভুল পথে পরিচালিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ গোষ্ঠী বা রাজাধীরাজগণ নিজস্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে এবং ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা তৈরি করে। ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের অন্তর্গত দুর্বলতা ও বিশ্বাসকে। তারপরও পৃথিবীর অনেক মানুষ যেমন ধর্মে আস্থা স্থাপন করে, তেমনি অনেকেই ধর্মের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য নানামুখী ভাবনার আশ্রয় গ্রহণ করে। গান্ধী যখন বলেন, ‘By religion I mean-- that which brings a man to face creative reality.’ মার্কস অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেন ‘Religion provides an illusory happiness-- It is the opium of the poor--- The idea of God is the key- stone of a perverred civilization.’ গান্ধ যখন মনে করেন, ধর্ম নিতান্তই ব্যক্তির অভিজ্ঞতা তখন মার্কস একে সামাজিক সমস্যা বলে মনে করেন। গান্ধী যখন এর মাঝে একটি শুভ দিক খোঁজেন, মার্কস তখন এর মধ্যে অসুখ খুঁজে পান। মূলত ব্যক্তি ও সমাজের সমস্যার প্রেক্ষাপটেই ধর্মের সৃষ্টি। ন্যায়, অন্যায় বোধ, পাপ-পুণ্য চিন্তা, ঈশ্বর ও আত্মা নিয়ে ভাবনা, ভবিষ্যৎ ও পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তা, ধর্ম সৃষ্টি ও ধর্ম বিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
পরকালের চিন্তা করে মানুষ যখন ঈশ্বরকে ভালোবাসে তখন তা মূলত নিজেকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। স্বর্গভোগের লোভের মাঝে অথবা নরকের ভয়ে যে বোধের শুরু তার মাঝে ঈশ্বরকে শুদ্ধ করে ভালোবাসা এক কঠিন পরীক্ষা। এমন বোধোদয় থেকে গৌতম বুদ্ধ কর্মবাদী ধর্মের কথা চিন্তা করেন। জীবনে আকাক্সক্ষা এবং আপনসত্তার অবিসাধিত অবস্থানের মাঝে ধর্মবোধের আসনকে না বলে ‘Love of attachment’ থেকে ‘Love of detachment’ যাত্রা শুরু করেন সিদ্ধার্থ।
উপনিষদের চূড়ান্ত বিকাশ বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম সৃষ্টি করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে মগধ রাষ্ট্রসৃষ্টির সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি ঘটে। বৌদ্ধধর্ম মূলত মানবতা, সাম্য এবং ভালোবাসার ধর্ম।
শ্রী গৌতম বুদ্ধের অমোঘ বাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম বাণী হলো- ক. ‘মানুষের কামনা, বাসনা এবং আকাক্সক্ষা সীমাহীন; বেদনা এবং পরিতাপই এর পরিণতি।’
‘মূলত লোভ, ক্রোধ, নির্বুদ্ধিতা এবং অহংবোধ এ চারটি প্রবণতা মানুষের অন্তরকে দূষিত করবার জন্য যথেষ্ট। বর্ম দ্বারা শরীরকে বিষবাণ থেকে রক্ষা করা গেলেও মনের বিষ থেকে রক্ষা করা বড়ই কঠিন। এসব প্রবণতার কারণেই মানুষ মিথ্যা বলে, প্রতারণা করে এবং বিচ্যুত হয় ন্যায় থেকে। এ কারণে মানুষ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে এবং দ্বৈত চরিত্রে অবতীর্ণ হয়- এতে মানুষ ভঙ্গ করে প্রতিশ্রæতি এবং লিপ্ত হয় হত্যা, চুরিসহ অবৈধ যৌনকর্মে।’
ধর্মের আলোকে আপন আত্মার উন্মেষ ও বিস্তার খোঁজা, আত্মার জগতে ঈশ্বরের প্রবল ইচ্ছা ও ছায়া খোঁজা, পরমের মাঝে সমর্পণের পথ ও প্রেরণা খোঁজা- অনেক ক্ষেত্রে জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। নাস্তিময় বিশ্বে শান্তিময় ভুবন নির্মাণের মূল্য যুক্তিতর্কময় বিশ্বে অর্থহীন নয় কখনই। ভিন্নতার প্রতি মর্যাদা স্থাপন এবং ভিন্নতার ইন্টিগ্রেশনের মাঝে জীবনের অর্থ ও লক্ষ্য খোঁজাটাই কল্যাণময় এবং মানবিক।
হাজার বছর আগে যেসব সাধারণ মানুষ আত্মবীক্ষণ ও নিরন্তর অনুতাপ ও পরিতাপের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল, তাদের ধর্মটি অচিরেই ক্ষমতাবানদের কব্জায় আসে। ‘On the history of early Christianity’ শীর্ষক প্রবন্ধে কার্ল মার্কস এভাবেই ব্যাখ্যা করেন The history of early Christianity has notable points of resemblance with the modern working-class movement. Like the latter, Christianity was originally a movement of oppressed peoples:
শোষিত মানুষের আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও সাম্যভিত্তিক চিন্তাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয় ইসলামের চিন্তা। তবে সকল সুন্দর ভাবনাগুলো কলুষিত হয় ক্ষমতাবান ও পরজীবীগোষ্ঠীর স্বার্থচর্চার কারণে।
যে আকাক্সক্ষা ও উচ্চারণগুলো মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকে কোনো না কোনোভাবে অনুভবে এনেছে, তার প্রধান উপাদান বঞ্চিতের নানা অধিকার আদায়: সে অধিকার জীবনের সামনের মর্যাদা, অর্থবিত্তসহ নানা সুযোগের সমঅধিকার। যে শোষণ, বঞ্চনা, শাসন, পীড়ন ও অধিকার লঙ্ঘনকে কেন্দ্র করে এই চাওয়াগুলো অন্তরাত্মার আন্দোলন সৃষ্টি করে তার সঠিক প্রকৃতি ও চরিত্র যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়নি, তেমনি শাসক ও শোষকের শ্রেণিচরিত্র ও স্বার্থচিন্তা সূ²াতিসূ²ভাবে স্পষ্ট করা হয়নি।
ভিনদেশীয় উৎপাদকের সঙ্গে স্থানীয় উৎপাদকদের সম্পর্ক, দ্ব›দ্ব ও স্বার্থের মূল সংঘাতটি স্পষ্ট করা হয়নি কখনো। এতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ক্ষমতার পালাবদলে, নতুন শোষণের যাঁতাকলে পড়ে এবং নিজের অজান্তে সাম্রাজ্যবাদী শোষকের ক্রীড়নক হয়ে ওঠে।
মোটাদাগে ’৬৯ থেকে ’৭১ পর্যন্ত সময়টাতে বাঙালির আন্দোলনকে ফরাসি বিপ্লব এবং ইহুদীদের পিতৃভূমি আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
শেণিস্বার্থ সংশ্লিষ্ট যে ¯েøাগানগুলো উচ্চারিত হয়েছে ’৭১-এ, তা মহাশক্তিশালী ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগানের নিচে ডুবে এমন ধারণাটি প্রবল হয়। এদেশে কখনই প্রকৃত Marxism -এর চর্চা হয়নি। সমাজতন্ত্র কখনো ‘ইউটোপীয়’ বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি। গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের Computational Logic এবং এর প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ কখনোই আলোচিত হয়নি। এদেশে Arristocratic Conservatism-এর সুযোগ কখনোই ছিল না। এদেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল কৃষক তথা আধাসামন্তবাদী সমাজের মোড়ল, মাতবর এবং ফড়িয়া। এমন ভূমিতে নানা কারণে জাতীয়তাবাদ বিকাশের সকল উপাদান উপস্থিত ছিল।
এই প্রেক্ষিতে ফরাসি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে ঈশ্বর Giuseppe Mazzini (১৮০৫- ১৮৭২)কে সফলভাবে অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু দেশকে মানবতার ছোঁয়াসম্পন্ন Liberal Nationalism ঠেলে দেন। Mazzini যেভাবে দেশকে Protectionism এ নিয়ে যান তেমনি করে বঙ্গবন্ধু নানা পদক্ষেপ নেয়ায় অনেকেই ভ্রমাত্মকভাবে তাকে Totalitarian রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
এই জাতীয়তাবাদের হাত ধরে একদিকে যেমন উগ্র Zionism-এর উদ্ভব হয়, তেমনি অ্যাডলফ হিটলারের হাতে Resist nationalism-এর উদ্ভব হয়। এখানেই জাতীতয়তাদের সীমাবদ্ধতা। এতে সুপ্ত রয়েছে বিদ্বেষ, ভেদজ্ঞান, সহিংসতা, সংকীর্ণতা ও অমানবিক আচরণের নানা উপাদান।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষটাতে নিট্শে (Friedrich Nietzsche -The sick and gentle scholar despised weakness, praised the `strong virtues’- nobility and courage- and attacked christianity for being the enemy of vital living, for upholding meekness and charity) সাহস ও মহানুভবতা চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে ভেদজ্ঞানসম্পন্ন যে জাতীয়তাবাদী দর্শনের চিন্তা করেন তা শেষ বিচারে বিদ্বেষমূলক দর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়, তারপরও নাস্তি (nihilism) ও সৃষ্টিশীলতার প্রতি তার বিশ্বাস অস্তিত্ববাদীদের মাঝে একটি চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করে।
ফরাসি জাতীয়তাবাদী নেতা বা Nationallistic Prophet Mazzini -এর কথা আমরা ভুলে গেছি। তিনি ফরাসি জাতির প্রতি কর্তব্য নির্দিষ্ট করতে এমনটা বলেন Your first duties – first, at least, in importance – are as I have told you, to humanity. You are men before you are citizens or fathers. If you do not embrace the whole human family in your love, if you do not confess your faith in its unity consequent on the unity of God – and in the brotherhood of the Peoples who are appointed to reduce that unity to fact – if wherever one of your fellow-men groans, wherever the dignity of human nature is violated by falsehood or tyranny, you are not prompt, being able, to succor that wretched one, or do not feel yourself called, being able, to fight for the purpose of relieving the deceived or oppressed – you disobey your law of life, or do not comprehend the religion which will bless the future. (The Duties of Man - Duties to Country.) যুদ্ধ শুরু হয়, শেষ হয় না এর একটা রেশ থেকে যায়। এর নষ্ট প্রভাব রোধ করতে হলে যে প্রজ্ঞা ও কর্মযজ্ঞ প্রয়োজন তা দুর্লভ। Aldous Huxley তার Ends and Means গ্রন্থে উল্লেখ করেন - War is a purely human phenomenon… Every road towards a better state of society is blocked, sooner or later, by war, by threats of war, by preparations for War. That is the truth the odius and irescapable truth… War exists for a variety of reasons. One is intensification of nationalist sentiment to a point where most individuals are living in a state of chronic enthusiasm...Vanity and pride beget contempt and hatred. But contempt and hatred are exciting emotions - emotions from which people get a kick... Devotees of one religion enjoy getting the kick of hatred and contempt for other religion.
A principal cause of war is nationalism, and nationalism is immensely popular because it is psychologically satisfying to individual nationalists. Every nationalism is an idolatrous religion, in which the god is the personified state, represented in many instances by a more or less deified king or dictator.
মানবতা-কেন্দ্রিক Positivism -এর সীমাবদ্ধতা অনুভব করে Bergson যে বিভূতি, সৃষ্টিশীলতা, মানবতা ও মিস্টিসিজম-নির্ভর দর্শনের কথা ব্যক্ত করেন তা নানাভাবে এদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক ও প্রায়োগিক ছিল।
দরিদ্র বিশ্বের মনোভূমির সঙ্গে ধনাঢ্য বিশ্বের যোজন ব্যবধান রয়েছে। ব্যথাগ্রস্ত ও ব্যথাহীনদের বোধেরও ব্যবধান রয়েছে। এই আলোকে আপন বোধের সীমা অতিক্রম করে ব্যক্তিকে সর্বজনীনবোধে পা রাখতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন মানুষের জন্য মানুষের শর্তহীন ভালোবাসা, তার অনুভবযোগ্য প্রকাশ এবং ভাবনা বিকাশের পরিবেশ। যে সৃষ্টিশীল ও কর্মময় দর্শন এটি সম্ভব করে তোলে তাই হতে পারে আমাদের স্বপ্নের দর্শন।
নতুন দর্শন ও সুন্দর কথার উচ্চারণ যতটা সহজ তার প্রয়োগ ততটাই কঠিন।
‘অপরের অর্জন অপহরণ এবং আপনাকে শ্রেষ্ঠত্বে সমাসীন করাটি প্রচলিত প্রবণতা ও রোগ।’
‘The living are soft and yielding; the dead are rigid and stiff. (Tao Te Ching)’
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা