যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন জো বাইডেন। রোদমাখা দুপুরে বাইবেল ছুঁয়ে মাত্র ৩৫ শব্দের শপথবাক্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি। তার বয়স বর্তমান ৭৮ বছর।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আর ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে মার্কিনিদের সরাসরি যোগদানে নিরুৎসাহিত করা হয়। ৫০টি অঙ্গরাজ্যে জারি থাকে সতর্কতা। ওয়াশিংটন ডিসিও সেনাটহলের নগরীতে পরিণত হয়। ২১ হাজারের বেশি ন্যাশনাল গার্ড আর আটটি অঙ্গরাজ্য থেকে আনা পুলিশের নজরদারি চালু রাখতে হয়েছে ওয়াশিংটনজুড়ে। এই বিপর্যস্ত অবস্থা সৃষ্টির জন্য একমাত্র দায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ১৫০ বছরের ইতিহাসে তার মতো এত খারাপ অবস্থায় দেশকে রেখে যাননি আর কোনো প্রেসিডেন্ট।
আসলেই ডোনাল্ড ট্রাম্প গত চার বছরে রাজনীতিতে সৃষ্টি করেন পরিষ্কার বিভেদ। চারদিকে ছড়িয়ে দেন সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা আর সাদা-কালোর মধ্যে তীব্র বর্ণ-বৈষম্য। এর সঙ্গে ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর অন্যায়ভাবে আঘাত হানা। সর্বশেষে ক্যাপিটল হিলে সশস্ত্র হামলার উসকানিদাতা হিসাবে তিনি আমেরিকার ইতিহাসে কলঙ্কের কালো কালি লেপে দিয়েছেন। যে-রাষ্ট্র গোটা দুনিয়ায় গণতন্ত্রের কথা বলে বেড়ায়, সেই দেশের আইনসভায় হানাদারদের বেপরোয়া আক্রমণের ঘটনা বিশ্বব্যাপী রীতিমতো বিপুল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে কারো কারো অভিমত, ক্যাপিটলে হামলার ঘটনার পেছনে ছিল পরিষ্কার উসকানি ও পরিকল্পিত প্রস্তুতি। এরর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল হিংসা-বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা আর স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা।
প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হওয়ায় ট্রাম্পের বিচার এখন শুরু হবে সিনেটে। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাব গৃহীত হলে ট্রাম্প ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচনে অংশ তো নিতে পারবেনই না, এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও হারাবেন।
আসলে ট্রাম্প হলেন আপাদমস্তক বর্ণবাদী এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রতি অসহিষ্ণু এক ব্যক্তি। এক এক সময়ে এক এক ধরনের কথা বলেন। তা না-হলে গণতন্ত্রের দ’ শ’ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত যুক্তরাষ্ট্রের মাথা বিশ্ববাসীর সামনে এভাবে তিনি নত করে দিতে পারতেন না। খুবই উচ্ছৃঙ্খল ও খামখেয়ালি মানুষ ট্রাম্প। এক সময়ে তো রেসলিংয়ের রিংয়ের পাশে প্রায়ই হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে তাকে। তার এই উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল ছেলেবেলাতেও। নানা অপরাধ করে বেড়িয়েছেন তিনি। কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়েও তার বিরুদ্ধে আছে মস্ত বড় এক ‘কিন্তু’। পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ী ট্রাম্পকে কর ফাঁকি দেওয়ার মতো অপরাধের সঙ্গেও জড়িত থাকতে দেখা গেছে।
মানতেই হবে, এই নিন্দিত মানসিকতা কাজে লাগিয়ে বিভাজনের বিদ্বেষ ছড়িয়ে পুরো জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার উন্মত্ত খেলায় মেতে ছিলেন ট্রাম্প। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই সেসময়ে উদার গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী সমাজ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। যেখানে বর্ণবিভাজনের পর্ব পার হয়ে একটা স্বচ্ছ-সুন্দর পরিবেশ তৈরির প্রশংসিত উদাহরণ তৈরি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে ছড়িয়ে দেওয়া হয় জাতিগত বিভেদের দাহ এবং তা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ক্ষমতা হাতে পেয়ে ট্রাম্প কী-না করেছেন । তার বর্ণবাদী, ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক এবং আক্রমণাত্মক অরাজনৈতিক কথাগুলো বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর হানে মারাত্মক আঘাত। ট্রাম্পের পক্ষের লোকজন এতটাই সহিংস হয়ে ওঠে যে তারা মিসিসিপি রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকার একটি গির্জা ও অসংখ্য বাড়িঘরে আগুন পর্যন্ত ধরিয়ে দেয়।
ট্রাম্পের এসব কর্মকাণ্ড আর কথাবার্তা আপাতদৃষ্টিতে এক বেকুবের অসংলগ্ন আচরণ বলে মনে হতে পারে। এ নিয়ে হয়ত অস্থিরতা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। কিন্তু বিষয়টি এভাবে সরলীকরণের অর্থ হলো ট্রাম্পের মূল উদ্দেশ্য আড়াল করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, এসব প্রশ্ন তারাই বেশি তুলেছেন যারা ডেমোক্র্যাট, সমাজতন্ত্র ও উদারনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর সমর্থক। ট্রাম্পের উগ্র কথাবার্তা আর নোংরা জাত্যাভিমান ছড়ানোর পেছনে বিশেষ একটি পরিকল্পনা সক্রিয় ছিল। সেটি হলো তিনি সচেতনভাবেই চেয়েছেন মার্কিনিদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ বিভেদরেখা, বর্ণবিভাজনের গণ্ডি পরিষ্কার রূপ নিয়ে বিকশিত হোক। জাতিগত বিতৃষ্ণা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন ট্রাম্প। প্রায় ৭০ শতাংশ সাদা মানুষ ছিল তার লক্ষ্য। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন জাতিগত নিপীড়নের মধ্য দিয়ে সাদাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। মানুষকে উসকিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সত্যই তার জুড়ি মেলা ভার।
বাইডেনের কাছে সুস্পষ্ট ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার পরও, জনগণের ম্যান্ডেড না-মানার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প কার্যত তার উৎকট জবরদস্তি মানসিকতাকেই বড় করে তুলে ধরেছেন। শেষ অবধি তিনি নিজেকে এমন এক চরম জায়গায় নিয়ে গেছেন, যেখানে অর্থাৎ হোয়াইট হাউসে দাঁড়িয়ে তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে আপন ‘সমর্থক’ বাহিনীকে ক্যাপিটল হিলে আক্রমণে প্ররোচিত করা। ৬ জানুয়ারির উন্মাতাল লঙ্কাকাণ্ডই এর প্রমাণ।
যে বিষাক্ত বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে মার্কিনিদের ভিতরে, বাইডেনের আনুষ্ঠানিক অভিষেকের পর তার সমাপ্তি ঘটবে, এটা আশা করা কোনোমতেই ঠিক হবে না। সমাজের ভিতরে, বিশেষ করে শেতাঙ্গদের একটা বড় অংশের মানসিকতায় ট্রাম্প বিভাজনের বীজ বপন করে গেছেন। এই গভীর ও জটিল রোগ সারাবার দায়িত্ব বহন করতে হবে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এবং কংগ্রেসের দুই সভায় চালকের আসনে অধিষ্ঠিত ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধিদের। এটি একটি কঠিন পরীক্ষা। এর চেয়ে আরও বড় পরীক্ষার মুখোমুখি এখন রিপাবলিকান পার্টি।
এই দলের অনেক নেতাই ট্রাম্প ও তার বাহিনীর আচরণে তীব্র প্রতিবাদমুখর। তারা জানেন, ট্রাম্পের এই স্বৈরাচারী মনোভাবকে উৎখাত করতে না-পারলে নিজ নিজ এলাকার ভোটারদের কাছে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি তো হতেই হবে, এমনকি তাদের আস্থা হারানোর ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। তাই রিপাবলিকান পার্টির কোনো কোনো নেতা ট্রাম্পের দেখানো অসহিষ্ণু ও হিংসা-বিদ্বেষের পথ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন এবং গণতান্ত্রিক আমেরিকার ভবিষ্যৎ সুস্থ ও সুন্দর করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রের পক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। তবে একথা মানতেই হবে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার শিবিরের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমাগত লড়াই, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। তাই মার্কিন সমাজ-দেহে যে-বিষবৃক্ষ রোপিত হয়েছে, সেই অতিবিভাজনের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে খুব সতর্কভাবে পা ফেলে লক্ষ্যাভিমুখে এগিয়ে যেতে হবে জো বাইডেনকে।
সন্দেহ নেই, জো বাইডেন খুব সতর্ক। এজন্যে তাকে বেছে নিতে হয়েছে নতুন এক পথ। তার মন্ত্র হলো দ্বিখণ্ডিত নয়, ঐক্যবদ্ধ দেশ ও জাতি চাই। কোভিডোত্তর পৃথিবীতে টিকে থাকবার জন্য দরকার এই ঐক্য। হাউস ও সিনেটের বিভেদে গত চার বছর বার বার থেমে গেছে আমেরিকান অর্থনীতির চাকা। শুধু প্রথাগত রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে এই অর্থনীতি সচল রাখা সম্ভব নয়। এজন্য কর্পোরেট আমেরিকারও সাহায্য প্রয়োজন। এছাড়া বাইডেনের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি বা লিঙ্গভিত্তিক পারিশ্রমিক-বৈষম্যের অবসান। মহিলা এবং তরুণদের নিয়ে বাইডেনের আশা আরও বেশি।
সমাজের এই দু অংশের স্বার্থের কথা ভেবে তাকে দিতে হয়েছে দুই বিলিয়ন ডলারের এক ‘গ্রিন নিউ ডিল’ ঘোষণা। সে টাকা কর্পোরেট আমেরিকাকে না-রাগিয়ে, কর কীভাবে তোলা যায়, তা এখনও স্পষ্ট নয়- আর সে প্রশ্ন তুলতেও উৎসাহী নন শিক্ষিত, উদারপন্থী আমজনতা। তবে বিষয়টি নিয়ে তাকে সতর্কভাবে এগিয়ে যেতে হবে। তার সামনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, জীবাশ্ম জ্বালানি। নির্বাচনি প্রচারণার সময় সর্বশেষ টিভি-বিতর্কে জো বাইডেন মুখ-ফসকে বলে ফেলেছিলেন, নির্বাচিত হলে তার প্রশাসন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসবে এবং সৌরশক্তি ও বাতাসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেবে। কথাটা বলবার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন এটা বলা তার ঠিক হয়নি। কারণ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে প্রায় দুই কোটি মানুষের রুজি-রুটি হুমকিতে পড়বে। তাই তিনি বিতর্ক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নির্বাচিত হলে তার প্রশাসন তেল-গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করবে না। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপারেও তাকে সত্যিই বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে।
আমরা জানি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার নাম সরিয়ে নেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই। এখন সে-অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ১৮৭টি দেশের সঙ্গে একমত হয়ে প্যারিসে যে জলবায়ু চুক্তি করেছিল সেখানে আবার ফিরে এসেছে। এটি সুখবর। ওই চুক্তিতে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা ছিল।
হ্যাঁ, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জো বাইডেনকে সতর্ক পা ফেলতে হচ্ছে মাটিতে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সংকটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভক্ত জাতিকে ঐক্যের অমিয় বাণী শোনানোর দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। জো বাইডেনের এই ঐক্যের আহ্বান কতটা কার্যকর হবে, তা আগামী দিনগুলোই বলে দেবে।
লেখক: সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, কবি