বিস্ময়করভাবে চীন সীমান্তে অবস্থিত একটি দেশ হয়েও ভিয়েতনামেই পৃথিবীতে সব থেকে কম মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে। সব থেকে কম সংখ্যক মৃত্যু সেখানে ঘটেছে। ভিয়েতমানে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৫৩৯ এবং মৃত্যু মাত্র ৩৫। অনেক কঠোর অবস্থান আবার সাহসী পদক্ষেপ - সব মিলে ভিয়েতনাম এই রেকর্ড করতে পেরেছে।
ভিয়েতনামের এই স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি যেমন সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি ২০২০ সালে ভিয়েতনাম অন্তত তিনটি মাইলফলক স্পর্শ করেছে তাদের ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে। তারা বড় মাপের অ্যাপেল সাপ্লায়ার্সের জায়গা নিয়েছে। এ ছাড়া সারা পৃথিবীতে যেখানে এয়ারলাইনস বন্ধ হয়ে গেছে একের পর এক, সেখানে তারা নতুন একটি এয়ারলাইন ওপেন করেছে। অন্যদিকে মাথাপিছু আয়ে তারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ৭ থেকে নিজেদেরকে ৬ এ উন্নীত করেছে।
এবং প্রথম কয়েক মাসের মধ্যে তারা কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন পর্যায়ে নিয়ে আসে যে, মানুষ যে কোনো জায়গায় তার ইচ্ছে মতো যেতে পেরেছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে গেছে। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার জন্যে প্রতি সপ্তাহে যার যার গন্তব্যে ফ্লাই করেছে। অর্থাৎ ডোমিস্টিক প্লেনগুলো নিয়ম মতই চলেছে। এমনকি মানুষ নিয়মিত জিমে গেছে। শপিং মলগুলোর এলিভেটরেও সারিবদ্ধভাবে নিয়ম মেনে আগের সংখ্যক মানুষই ওঠা-নামা করেছে।
অথচ এই কোভিডে ভিয়েতনাম সব থেকে বেশি অসুবিধায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে একটি দেশ হবার কথা ছিল। কারণ, তাদের অর্থনীতির অংশ রপ্তানিনির্ভর। এই কোভিডে ২০২০-এ অধিকাংশ দেশই রপ্তানিতে আঘাত পেয়েছে। তাদের রপ্তানি কমে গেছে। অথচ এর বদলে ভিয়েতনামে দেখা গেছে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। তারা বরং এই কোভিডের ভেতর ২০২০-এ রপ্তানিতে আরো ভালো করেছে, যা তাদের অর্থনীতির আরো দ্রুত উন্নতিতে সহায়তা করেছে।
শুধু এখানেই ২০২০-এ ভিয়েতনামের কোভিডের মধ্যে দাঁড়িয়ে উন্নতির গল্প শেষ নয়। ভিয়েতনাম এই কোভিডের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ সঠিকভাবে নির্বাচন করেছে অত্যন্ত উঁচু মানের কর্মক্ষমতা দিয়ে। যেখানে তারা তাদের বেঞ্চমার্ক হিসেবে সব সময়ই আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশ বান্ধবতার দিকে বেশি লক্ষ্য রেখেছে। সব মিলিয়ে তাই ভিয়েতনামে ২০২০-এ বিনিয়োগ বেড়েছে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে সারা পৃথিবী যেখানে ২০২১-এ জিডিপি বৃদ্ধি ২ দশমিক ৯ শতাংশের এর বেশি হবে বলে মনে করছে না, সেখানে ভিয়েতনামের জিডিপি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে বলেই ধরে নিয়েছে পৃথিবীর অর্থনীতিবিদেরা।
ভিয়েতনামের এই সাফল্যর গল্পের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প একেবারে কম নয়। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা ও মৃত্যুর হার নিয়ে লিখতে গিয়ে নিক্কিই এশিয়ায় খ্যাতিমান কলামিস্ট লিখেছিলেন, আমেরিকার যে শহরে বসে আমি এই লেখা লিখছি, এই শহরে যত মানুষ মারা গেছেন, তার দশভাগের একভাগ মানুষও বাংলাদেশ নামক দেশটিতে মারা যায়নি। শুধু তাই নয়, দেশটি অসম্ভবকে সম্ভব করে প্রায় সব কিছু চালু রেখেছে।
বাস্তবে ভিয়েতনাম যেমন চীনের সীমান্তের একটি দেশ, বাংলাদেশও কিন্তু ভারতের সীমান্তের একটি দেশ। ভারতে যেখানে লাখ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে প্রতিদিন (পৃথিবীতে মৃত্যুর দিক থেকে তিন নম্বরে চলে গেছে ভারত), সেখানে একই আবহাওয়ার বাংলাদেশ যেভাবে মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা সীমিত রেখেছে তা সত্যি বিস্ময়কর। এমনকি বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেছিলেন, আমাদের হাসপাতালগুলো হিমশিম খাবে। রোগি চিকিৎসার স্থান পাবে না। বাস্তবে তা কিন্তু ঘটেনি বাংলাদেশে। অন্যদিকে বাংলাদেশেও ভিয়েতনামের মতো একটি রপ্তানি আয়নির্ভর দেশ। বাংলাদেশের মূল রপ্তানি আয় পোশাক শিল্প থেকে। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান প্রায় শুরু থেকে পোশাক শিল্প চালু রাখার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। তখন দেশে এ নিয়ে প্রবল আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তিনিই সঠিক ছিলেন। পোশাক শিল্প যে শতভাগ আয় করতে পারেনি, তা বাংলাদেশের কোনো ঘাটতি নয়। বাংলাদেশ সব সময়ই যে পরিমাণ কাজের অর্ডার পেয়েছে, তার শতভাগ রক্ষা করেছে। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ারের অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি কিছুটা কমেছে।
অন্যদিকে ভিয়েতনাম যেমন তিনটি মাইলফলক ছুঁয়েছে, ২০২০-এর কোভিড-১৯ এর ভেতর বসে বাংলাদেশও তার থেকে বড় মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশেও ২০২০-এ জিডিপি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সব থেকে বেশি। সারা বিশ্বে যেখানে কোভিড-১৯ এর কারণে অবকাঠামো উন্নয়ন বন্ধ, সেখানে বাংলাদেশ পৃথিবীর সব থেকে বেশি পলিবাহী ও অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মার ওপরে সেতু নির্মাণের জন্যে সবগুলো স্প্যান বসানোর কাজ শেষ করেছে এই কোভিড-১৯ এর ২০২০-এ। অন্যদিকে এই কোভিড-১৯ এর ২০২০-এই কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি নরম মাটির দেশে মেট্রোরেলের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে বাংলাদেশ। এ সময়ে শুধু পদ্মা সেতু ও মেট্রো রেলে বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি, বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ভিয়েতনামেরই কাছাকাছি হারে। এ ছাড়া পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ যেখানে ২০২১-এ তাদের জিডিপি বৃদ্ধি নিয়ে হতাশ, সেখানে ২০২১-এ বাংলাদেশের জিডিপি সাত শতাংশের বেশি হবে বলে এডিবিসহ বাংলাদেশের অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন। অর্থনীতির যে গতি দেখা যাচ্ছে, তাতে বাস্তবে এটাই ঘটবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বরং এর সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ বা ২০২৩-এ গিয়ে বাংলাদেশের জিডিপি নয় শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ ডাবল ফিগার হতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের এই সাফল্যের রসায়নটি বাস্তবে কোথায়? নেতৃত্ব অনেক বড় একটি বিষয়। তবে তার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা রসায়নটিও দেখা প্রয়োজন। ভিয়েতনামের পাশের দেশগুলোও যেমন পারছে না ভিয়েতনামের সঙ্গে বিপদে সাহস নিয়ে মোকাবিলা করতে, তেমনি বাংলাদেশের পাশের ভারতের একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে যদি ধরা হয়, যাদের মানুষ এবং বাংলাদেশের মানুষ শুধু একই এথনিক গ্রুপ নয়, একই সংস্কৃতি বহন করে – তাদের দিকে যদি তাকানো হয়, তাহলে দেখা যাবে, তারা তো বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতায় আসে না। বরং ভারতের অন্যান্য রাজ্যের থেকেও তারা অনেক পিছিয়ে রয়েছে উন্নয়নের ক্ষেত্রে। অথচ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এই রসায়ন মিলের কারণ কী?
বাস্তবে এই দুটি দেশের মানুষের মানসিক গঠন বদলে দিয়েছে রাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করায়। যে কারণে যেকোনো দুর্যোগ শুধু নয়, প্রতিদিনের জীবনে এই দুই দেশের মানুষ অন্য রকম সাহসী। মানুষের জীবনে ও জাতীয় জীবনের সাফল্যের সব থেকে বড় বিষয় সৎ সাহস। আমেরিকার বিরুদ্ধে ১২ বছর ধরে অসম সাহসী যুদ্ধের মাধ্যমে বিপ্লবে বিজয়ী হওয়ায় ভিয়েতনামের মানুষের ভেতর সে সাহসের সঞ্চার হয়েছে। যুদ্ধ করে অর্জন করার স্বভাব তার ভেতর জম্ম নিয়েছে। এ তাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হবে। বাংলাদেশও তাই। মাত্র নয় মাসে পাকিস্তানের হিংস্র বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে বিজয়ী হবার ভেতর দিয়ে এবং তার আগে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২২ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এই দেশের মানুষের মধ্যে যে সাহসের সঞ্চার হয়েছে, তা প্রবাহিত হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। যদিও বাংলাদেশের এই সাহস ভুলিয়ে দেবার জন্যে ইতিহাস বিকৃত করা হয়। রাজনীতি বিকৃত করা হয়েছে। তারপরেও একটি সৎ বিপ্লবের ভেতর দিয়ে মানুষের ভেতর প্রবাহিত হওয়া সাহস দীর্ঘকাল প্রবাহিত হয়। আর নেতৃত্ব যদি সেই সৎ সাহসের পক্ষে থাকে, তাহলে সেখানে সাফল্য অনিবার্য। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যদি মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতের কোনো সরকার থাকত, তারা কিন্তু মানুষের এই সাহসের রসায়নটি জাগাতে পারত না। এবং কোনো মতেই পদ্মা সেতু থেকে জিডিপির সাফল্য এই কোভিড-১৯ এর ২০২০ এ আসত না।