একটি সংবেদনশীল বিষয়ে আজ লিখব। আশা করি পাঠক অনধিকারচর্চা হিসেবে নেবেন না। সম্প্রতি সুপরিচিত ইসলাম বিশারদ মামুনুল হক সাহেব ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য’সহ সকল প্রকার ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে ঘোষণা করেছেন, যেখানেই এ ধরনের ভাস্কর্য দেখা যাবে- তা তিনি ও তার দলবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন। তার মনে স্থির বিশ্বাস, এ ধরনের যেকোনো ভাস্কর্য হচ্ছে ইসলাম ও পবিত্র কোরআনের বিধি-বিরোধী এবং সে জন্য তা ধ্বংস করা প্রত্যেক মুসলমানের পবিত্র কর্তব্য।
আমি সবিনয়ে বলতে চাই, তিনি ভুলে গেছেন বহু দেশে অনেক মুসলমান রয়েছেন যারা ভাস্কর্য শিল্প অনুমোদন করেন, নিজের ঘরে সজ্জাবস্তু হিসেবে রাখেন, মিউজিয়ামে পবিত্র স্মৃতি উপকরণ হিসেবে যত্ন সহকারে সেগুলো সংরক্ষিত থাকে, ছুটির দিনে দল বেঁধে অনেক মুসলমান তা দেখতে যান। সেসব নিয়ে মুসলিম পণ্ডিতরা ইতিহাসের পাঠোদ্ধার করার জন্য বিচিত্র গবেষণা ও প্রত্নতত্ত্ব বিদ্যাচর্চা করেন। আজ ঘরে ঘরে এমনকি নিছক ‘পেপার-ওয়েট’ হিসেবে ভাস্কর্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবক্ষমূর্তি ব্যবহৃত হয়। আমার নিজের ঘরেই গ্র্যানাইট নির্মিত লেনিনের আবক্ষমূর্তি এক পেপার-ওয়েট আছে! ভাস্কর্য একটি বিদ্যাশিক্ষার অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে পড়ানো হয়। সেখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, নাস্তিক নির্বিশেষে সকলেই ভর্তি হতে পারেন এবং পাঠ নিতে পারেন। আমাদের দেশে বিখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পী নভেরা ও শামীম শিকদারের বেশ কিছু কীর্তি অনেক জায়গায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সুরক্ষিত আছে। সেগুলো ধ্বংস করলে শিল্প জগতের অপরিসীম ক্ষতি হবে। কিন্তু মামুনুল হকের মতো ‘পণ্ডিত’রা মনে করেন ভাস্কর্যের দ্বারা যদি কোনো মৃত বা জীবন্ত মানুষের প্রতিরূপ তৈরি করা হয়, তা করাই হয় তাকে শুধু পূজা করার জন্য এবং যেহেতু ঈশ্বর বন্দনার বদলে ভাস্কর্য মনুষ্যবন্দনাকে প্রতিষ্ঠিত করছে, সেহেতু তা ইসলামবিরোধী। তারা এটাও ভুলে যান যে, ঈশ্বর-ভগবান, আল্লাহ্ বা সৃষ্টিকর্তা কখনো এত দুর্বল নন যে মানুষের তৈরি দেব-দেবীকে ভয় পেয়ে তা ভাঙার ফরমান জারি করবেন!
কিন্তু ভাস্কর্য সর্বদা পূজা বা বন্দনা করার জন্য নির্মিত হয় না। সৌন্দর্যের সাধনা ও উপভোগের জন্যও ভাস্কর্য নির্মিত হয়। এ কথা সত্য আমাদের দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেব-দেবীর মূর্তি বানিয়ে তার আরাধনা-পূজা, ইত্যাদি করে থাকেন। মন্দির বানিয়ে সেখানে সেসব দেব-দেবীর ভাস্কর্য ঘটা করে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। আমরা মুসলমানরাও সেসব উৎসবে যোগ দিই- প্রসাদও খাই। তারাও যেমন ঈদোৎসবে আমাদের বাড়িতে এসে ফিরনি খেয়ে যান। আমাদের রাষ্ট্র-সংবিধান যার যার ধর্মকে ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গতভাবে পালনের সমান অধিকার প্রদান করেছে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্প্রীতিমূলক আচরণ এবং পরস্পরের ধর্মকে সম্মান-শ্রদ্ধা করার কথাই আমাদেরকে শেখায় ও বলে।
গণতন্ত্রের সেই আধুনিক শর্তটা আমরা মেনে নিয়েছি- ‘We agree to disagree.’
অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ভাষায়, ‘আমার সমালোচক হচ্ছে আমার বন্ধু’। আমি বা আমরা কেউ কেউ মুসলমান হিসেবে মূর্তিপূজা পছন্দ না-ও করতে পারি- পৌত্তলিকতার পরিবর্তে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতে পারি-কিন্তু তাই বলে অন্য কারো সেরকম বিশ্বাস পোষণ করার স্বাধীনতায় আমরা হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী নই। ইসলামও তা অনুমোদন করে না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ভুলের শাস্তি দেয়ার মালিক সৃষ্টিকর্তা, মানুষ নয়। অন্য কেউ তার আরাধ্য দেবতার মূর্তি বানিয়ে, যদি তার বাড়িতে বা নির্দিষ্ট কোনো মন্দিরে তার পূজা করেন, আমি তা নিশ্চয়ই ভাঙতে ছুটে যাব না। সেটা যারা করে, তারা অন্যের ধর্মকে অশ্রদ্ধা করে। অন্যের ধর্মকে অশ্রদ্ধা করলে নিজের ধর্মকেও শেষ পর্যন্ত অশ্রদ্ধা থেকে রক্ষা করা যায় না। তাই আসুন যার যার ধর্মকে আমরা শ্রদ্ধা করি এবং সে জন্যই সকলের ধর্মপালনের অধিকারকে আমাদের শ্রদ্ধা করতে হবে। কান্টীয় নীতিদর্শন অনুযায়ী এটি আমাদের জন্য একটি সর্বজনীন কর্তব্য। ইংরেজিতে যাকে বলা হয়- ‘Categorical Imperative’.
সে জন্যই বলা হয় যে কেউ যদি বাবরি মসজিদকে অশ্রদ্ধা করে ভাঙতে চান তাহলে তাকে রামমন্দিরকে অশ্রদ্ধা করে ভাঙার অভিযানকেও মেনে নিতে হবে। তাই শ্রেষ্ঠ নৈতিকতা ও শিষ্টাচার হচ্ছে কেউ কারো উপাসনালয় ভাঙবেন না।
সেদিন আমার ছোট মেয়ে পুতুল কিনে দেয়ার বায়না করেছিল। মেলা থেকে বেছে বেছে তাকে আমি কিছু পুতুল কিনে দিলাম। সে সেগুলোকে খাওয়ায়, বকা-ঝকা করে, আদর করে ঘুম পাড়ায়- এটাই তার খেলা। এখন মামুনুল হকের মতো পণ্ডিতেরা কি তাদের শিশু পুত্র-কন্যাদের জন্য খেলনা পুতুলকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করবেন?
আমার মনে আজ এসব ফতোয়াবাজদের এমন ফতোয়া দেখে এই বিষয়েও আশঙ্কা উপস্থিত হয়েছে।
যতদূর জানা যায়, এ ঘটনার সূত্রপাত ধোলাইপাড় চত্বরে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য স্থাপন করার ঘটনা থেকে। গত অক্টোবরেই এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ শুরু হয়। প্রতিবাদ ওঠে ‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ক’টি ইসলামপন্থী দলের একটি জোটের সদস্যদের তরফ থেকে। ওই জোটের অন্তর্ভুক্ত একটি দলের উচ্চপর্যায়ের নেতা মামুনুল হক পরবর্তী সময়ে আরও আক্রমণাত্মক ভাষায় ওই ভাস্কর্যসহ সকল ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয়ার দাবি জানান। পরে অবশ্য বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তিনি নন, তিনি হচ্ছেন ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে। এর আগে এসব দলের অনুসারীরা এয়ারপোর্টের কাছে অবস্থিত ‘লালন’ ভাস্কর্য এবং সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত গ্রিক দেবী থেটিসের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিজ’ মূর্তিটিও ভেঙে ফেলা ও অপসারণের দাবি তুলেছিলেন। তখন বিশেষ রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমান শাসক দল নির্বাচনকে সামনে রেখে হেফাজতের দলগুলোকে নানা কনসেশন দিচ্ছিলেন এবং ফলে তখন তারা তাদের দাবি বাস্তবায়নে সক্ষমও হয়েছিলেন। আমাদের সমগ্র বিষয়টা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সামগগ্রিকভাবে দেখতে হবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রথমত, আমাদের মানতে হবে যে, আমাদের সংবিধানের ৪১ (১)-এর ক এবং খ উপধারায় লেখা আছে- “আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে;
(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।”
এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের কর্তব্য হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা নিজের হাতে তুলে না নেয়া। দ্বিতীয়ত, ‘নৈতিকতা’ বলতে এখানে মানবিক নৈতিকতার কথা-ই বুঝানো হয়েছে যার অন্যতম সূত্র হচ্ছে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা ধর্মভিত্তিক কোনো নৈতিকতা আবশ্যকীয়ভাবে আমাদের রাজনীতি বা নৈতিকতার উৎস হতে পারে না। আমরা মানবিক ও গণতান্ত্রিক ও রাজনীতি অনুসরণ করব। তা কোনো বিশেষ ধর্মের বিধান বা দোহাই দিয়ে বাধা দেয়াটা হবে নাগরিকদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। যে কথাটা আজ আমরা তাই সবাই বা সব ধর্মের লোক মেনে নেব তা হচ্ছে- ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। রাষ্ট্রের ইহলৌকিক আইন-কানুন, রীতি-নীতি ধর্ম নির্বিশেষে ইহলৌকিক মানবিক বিবেচনার দ্বারাই নির্ধারিত হবে। তবে একথা সত্য যে, এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হচ্ছে ধর্মপ্রাণ মুসলমান। আমি জানি এই লেখা মুসলমানদের কারো কারো ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে বা বিশ্বাসে আঘাত হানতে পারে। সেটা হলে আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে ইসলামের একটি অমর বাণীর কথা পুনরায় তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই,
“লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন” বা
‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার’।
[ উৎস: ১০৯ সুরা কাফিরুন, রুকু-১, আয়াত-৬, পবিত্র কোরআন শরিফ, বঙ্গানুবাদ করেছেন--মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মাওলা ব্রাদার্স, (জুলাই ২০১৬) পৃ. ৪৭৬। ]
লেখক: অর্থনীতিবিদ, বিভাগীয় প্রধান, অর্থনীতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।