সোহেল রানা নামটি কি বর্তমান প্রজন্মের কাছে পরিচিত? এখন যারা তরুণ-তরুণী তারা কি আদৌ চেনে তাকে?
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে এসেছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়।
একদিকে যেমন ‘ওরা এগার জন’, ‘বাঘা বাঙালি’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’র মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল আরেকদিকে সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ বলে অপপ্রচারও হয়েছিল সিনেমা জগতে।
এই সোহেল রানা একজন খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা। এবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি তার কান্না লুকাতে পারেননি। আবেগ ও স্মৃতি রোমন্থনে কাতর সোহেল রানার কান্না উপস্থিত অনেককেই আবেগপ্রবণ করে তোলে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনিও তার আবেগ সংবরণ করেছেন কষ্ট করে। বিশেষত, সোহেল রানা যখন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও অতীতে তার আদেশে সিনেমায় অভিনয় করার কথা বলেন, তখন সবাই নির্বাক হয়ে তা শুনেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোটামুটি সব বিষয়ে খবর রাখেন। আশা করি এই ঘটনাও তার মনে আছে। রাজনৈতিক ঝামেলায় সরকার প্রধানকে চেনা অচেনা মনে হলেও সংস্কৃতির কথা আসলেই আমরা পাই দরদি বাঙালি এক নারী শেখ হাসিনাকে। যিনি শুধু বড়দের জন্য না ছোটদের জন্য সিনেমা বানানোর কথাও মনে করিয়ে দেন।
সেই কবে ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নামে একখানা ছবি হয়েছিল তারপর কি আসলে আদৌ কেউ ছোটদের জন্য ছবি বানানোর কথা ভেবেছেন? মাঝে ‘একাত্তরের যীশু’ বা এমন দু একখানা সিনেমা পাওয়া গেছে বটে। বিনোদন আর মনোজাগতিক আনন্দে ছোটদের জন্য জায়গা নেই বললেই চলে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার বিতরণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলতে ভোলেননি।
শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘এর মধ্যে দিয়ে কিন্তু একটা শিশু তার জীবনটাকে দেখতে পারবে, জীবনটাকে তৈরি করতে পারবে, বড় হতে পারবে। সেদিকে লক্ষ রেখেই শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, তার মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো প্রতিফলিত করা, এটাও কিন্তু আমাদের করতে হবে।’
চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই সামাজিক দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সিনেমাগুলো সেভাবেই তৈরি করতে হবে, যেন পরিবার-পরিজন নিয়ে দেখতে পারে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আজকাল দুনিয়ার কোনো দেশেই মানুষ আগের মতো হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন না। কিন্তু এটাও ঠিক আমাদের দেশের মতো অতোটা খারাপ নয় অবস্থা।
আমার একমাত্র সন্তান তার ক্যারিয়ার হিসেবে অভিনয়-নির্দেশনা, চিত্রনাট্য রচনা বেছে নেয়ার পর থেকে আমি খুব কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়া ও বলিউডের সিনে জগৎ দেখছি। প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে সিনেমা। সব এখন হলে গিয়ে দেখতে হয় এমনও নয়।
বিলিয়ন ডলার বাজেটের মু্ভি বিশ্বনন্দিত সিরিজ ‘মুলান’। ডিজনি ওয়ার্ল্ডের এই ছবিতে খুব ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে আমার ছেলে অর্ক। এটি অস্ট্রেলিয়া তথা এশিয়ার কোনো যুবকের ডিজনি মু্ভিতে প্রথম অভিনয়। সেই বিগ বাজেটের ছবিটি করোনার কারণে হলে মুক্তি না পেলেও জমিয়ে ব্যবসা করেছে ডিজনি চ্যানেলে। আজকাল ঘরে বসেও মানুষ সিনেমা দেখা রপ্ত করে নিয়েছে। তাই একথা বলা যাবে না, সিনেমা শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। মূলত বিপাকে পড়েছে সিনেমা হল-কেন্দ্রিক ব্যবসা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন মানুষকে সিনেমা হল-মুখী করে তুলতে। ভালো কথা। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গেই বলি পারির্পাশ্বিক বাস্তবতা কি তা সমর্থন করে? ইন্টারনেটে চলছে বিনোদনবিরোধী অপপ্রচার। সেগুলো এত জঘন্য আর এত বিদ্বেষপ্রসূত যে ভাবেই যায় না। যেহেতু এগুলোর সঙ্গে পবিত্র ধর্মকে ট্যাগ করে দেয়া হয়েছে, সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করছে এবং গিলছে। এর সঙ্গে সিনেমার সম্পর্ক সাপে নেউলে। তাহলে সে সমাজে মানুষকে কীভাবে হলমুখী করা সম্ভব?
সিনেমার বৈরী হয়ে ওঠা সমাজকে গাইড করছে যেসব মৌলবাদী গোষ্ঠী তারাও কিন্তু ইলেকট্রনিক বাহনের মাধ্যমেই তা করছে। অন্যদিকে ভালো, মাঝারি মান আর সাধারণ মানুষের সিনেমাগুলো বন্ধ করার পাঁয়তারা চলছে। তবে অশ্লীল নাম ও সিনেমা বন্ধ হয়নি। কাট পিসের জগৎ এড়িয়ে এখন সরাসরি অশ্লীল ছবি জুড়ে দেয়ার পাশাপাশি উদোম নারী শরীর প্রদর্শনও পিছিয়ে নেই। এসবের ব্যাপারে সমাজের নীরবতা চোখে পড়ার মতো। এ বাস্তবতা আশঙ্কারও কারণ বটে।
সুস্থ, স্বাভাবিক ও মূলধারার ছায়াছবি নির্মাণ এখন সময়ের চাহিদা। সেসব মূলধারার ছবিগুলোই পারে শিল্প রুচি ও জীবনবোধের চাহিদা মেটাতে। পাশের দেশে কলকাতায় চলচ্চিত্রে গভীর জীবনবোধের চর্চা হচ্ছে বলেই আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে তাদের সিনেমা জগৎ। এর কোনোটাই আমরা মানি না। অনেকে রসিকতা করে বলেন, দেশের রাজনীতিতে যখন অভিনয় চলে, তখন দর্শক কেন টাকা খরচ করে পর্দায় সিনেমা দেখবে? এটা রসিকতা হলেও আমরা কি বাস্তবে তা রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখছি না?
সুখের কথা, তবু দেশে সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। চলচ্চিত্র জগতে নবীন-প্রবীণেরা কাজ করছেন। প্রতিবছর নতুন আশায় নতুন ছবি সামনে এসে দাাঁড়য়। কারো অভিনয়প্রতিভা, কারো কাহিনি, নির্মাণশৈলী, নির্দেশনা, কারো সুর, ক্যামেরার কাজ আমাদের মুগ্ধ করে। তারা পুরষ্কার জিতে নেন। জাগিয়ে দেন আশা।
সিনেমা বা অভিনয়শিল্প মৌলিক। এর বিনাশ নেই। এর বিকাশে দরকার সরকারি আনুকূল্য আর মানুষকে সিনেমামুখী করা। সে কাজটা সমাজের আরও অনেক কিছুর সঙ্গে থমকে আছে। কবে কীভাবে উদ্ধার হবে বা ঘুরে দাঁড়াতে শিখবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : প্রবাসী কলাম লেখক