বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রূপকথার অনন্য রাজকুমার

  • আতাউর রহমান   
  • ২১ জানুয়ারি, ২০২১ ১২:৫৬

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বাঙালির গৌরব এবং আমার প্রিয় নেতা যিনি সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে জীবন পণ করেছিলেন। তিনি ভারতের জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদেরকে স্বাধীনতা উপহার দেব।’ আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু অন্য পথ ধরেছিলেন; তিনি বলেছিলেন, ‘দিয়েছিতো রক্ত, আরও দেব রক্ত’। আমার ধারণায় আমাদের নেতা বোঝাতে চেয়েছিলেন, তোমরা পাকিস্তানিরা আমাদের রক্ত নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে, আর কত রক্ত নেবে? সুতরাং পরিণামে আমাদের জয় হবেই!

আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার কাছে একজন মহামানব। তার অবয়ব চোখের সামনে ভেসে উঠলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ গানটি মনের কোণে গুনগুনিয়ে উঠে- “ঐ মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ রাগে/মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।” আমাদের এই বাংলার অর্থাৎ মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলিকণা অনুরণিত হয়েছিল তার আগমনে যিনি আমাদের পাকিস্তানিদের দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন। তিনি আজ কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মহানায়ক নন, তিনি সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানুষেরও মুক্তির দূত।

আমার মূল্যায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সকল প্রকার দূষণমুক্ত একজন মানুষ। তার সমগ্র জীবন দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্যে উৎসর্গকৃত ছিল। তিনি ছিলেন গ্রাম বাংলার সহজ ও সুন্দর একজন মানুষ। তার সমগ্র জীবন ছিল শিকড়ে প্রথিত, তিনি ছিলেন মাটি থেকে উৎসারিত একজন মানুষ, যিনি কৈশোরকালে টুঙ্গিপাড়ায় বাবা মায়ের আদরের খোকা ছিলেন। যিনি ছিলেন আর দশটি গ্রাম-বাংলার ছেলের মতো কাদা মাটিতে ফুটবল খেলে, বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করা এক কিশোর । কালে দেশের কাদামাটি থেকে উৎসারিত ছেলেটি হয়ে উঠলো আমাদের তথা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন সহজভাবে গড়ে ওঠা মানবত্রাতা এবং গণমানুষের নেতা। তিনি বাংলার মাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে গড়ে উঠেছিলেন, বেড়ে উঠেছিলেন। তাকে রাজনীতির পাঠ বিশেষভাবে নিতে হয়নি। তিনি ছিলেন কর্মযোগী পুরুষ। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, একে ফজলুল হক এবং মওলানা ভাসানীর সাহচর্য পেয়েছিলেন। কিন্তু সব সৎ-সুন্দর ও মঙ্গলময় মতাদর্শের সারাৎসার হৃদয়ে ধারণ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, যিনি মৃত্যুতে ছিলেন কেবল বাঙালির নয়; সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের এক অবিনাশী নেতা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছেন, শুনেছেন কিন্তু রাজনীতির শিক্ষা তাকে কোনো বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিতে হয়নি, কারণ তিনি নিজেই ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ছিলেন প্রকৃতির হাতে গড়া একজন মানুষ। বাংলা সাহিত্য সৃজনের সেরা পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কৈশোরকালে হিমালয় দর্শনে নিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে তিনি প্রকৃতিবান্ধব একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন। আমাদের জাতির পিতা অত্যন্ত সহজাতভাবে একজন প্রকৃতির সন্তান হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন। যিনি প্রতীকী অর্থে আমাদের প্রকৃতির মতোই বর্ষাকালে কাদা মাটির মতো নরম ছিলেন, কিন্তু শীতকালে সেই কাদামাটিই কঠিন শিলার রূপ পরিগ্রহ করে। যা তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে প্রমাণ করেছেন। তার রাজনৈতিকসত্তা প্রকৃতির নিয়মেই কখনো কাদা মাটি হয়েছে এবং প্রয়োজনে সেই কাদামাটি কঠিন শিলার রূপ ধারণ করেছে। জননেতা বা গণনায়ক বলতে যা বুঝায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সত্যিকার অর্থে তাই।

মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় যে রাজনীতি তাকে কোনো বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিখতে হয়নি; তাকে রাজনৈতিক বিজ্ঞানে (পলিটিক্যাল সায়েন্স) শিক্ষা গ্রহণ করে রাজনীতি ও সংশ্লিষ্ট কূটনীতি শিখতে হয়নি। তিনি যা শিখেছেন সম্পূর্ণই শিখেছেন দেশবাসীর জীবনাচরণ ও জনজীবনের ধারাপাত থেকে। তার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ছিল না কোনো কুটিলতা। দেশের সাধারণ জনগণ তার সমগ্র সত্তাকে অধিকার করে রেখেছিল। সাধারণ কর্মজীবী এবং কৃষিজীবী মানুষই ছিল তার শক্তি, সাহস এবং অন্তর্গত চেতনার উৎস। তার অনিঃশেষ চেতনার শক্তি জুগিয়ে ছিল বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ।

আব্রাহাম লিঙ্কনকে বলা হতো ‘ম্যান নেক্সট ডোর’ অর্থাৎ পাশের বাড়ির মানুষটি। আমাদের জাতির পিতা সেই অর্থে ছিলেন ‘প্রত্যেকের ঘরের মানুষ’। শালপ্রাংশু দীর্ঘ দেহ এবং উদা‌ত্ত কণ্ঠস্বরের অধিকারী, বলিষ্ঠ পদচারণা নিয়ে তিনি সত্যিকার অর্থে আমাদের কাছে রূপকথার বীরপুত্র ছিলেন। তাকে বাঙলির পোশাক পায়জামা-পাঞ্জাবি এবং সাহেবদের পোশাক কোট-প্যান্টে সমান সুদর্শন মনে হতো। বঙ্গবন্ধুর ছিল মাথাভর্তি চুলের সমাহার। সবকিছু নিয়ে আমরা আমাদের তরুণ বয়সে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে। অথচ এই মহাপুরুষটি স্ত্রী এবং পাঁচ পুত্র কন্যা এবং আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়ে ছিলেন সর্বাংশে একজন গৃহী মানুষ। বাসায় তিনি চেক লুঙ্গি ও হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরিধান করতেন। আমি তার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে এই পোশাকে দু’বার দেখেছি।

আমাদের জাতির পিতার প্রসঙ্গে শেকসপিয়রের ম্যাকবেথ নাটকের একটি সংলাপ মনে পড়ে গেল। সেনাপতি ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন পুণ্যবান রাজা ডানকান। ইচ্ছা ছিল ম্যাকবেথ এবং লেডি ম্যাকবেথ উচ্চাশার রথে চড়ে রাজা ডানকানকে হত্যা করে ম্যাকবেথ হবেন রাজা এবং লেডি হবেন রানি। ম্যাকবেথের সংলাপের ভগ্নাংশ : “গোপন গোপন করো চমৎকার রঙ্গিনী কলায়; হৃদয় হৃদয়ের মিথ্যা চাপা পড়ে থাক মুখের মিথ্যায়” (অনুবাদ : সৈয়দ শামসুল হক)। আমরা সাধারণ মানুষেরা হৃদয়ের সত্য আর মুখের সত্য এক সমান্তরাল রেখায় মিলাতে পারি না। আমাদের বেশির ভাগ মানুষের হৃদয়ে থাকে এককথা, মুখে উচ্চারিত হয় অন্যকথা। ধরা যাক, একজন বলল মুখে বলছে ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’ অথচ তার হৃদয় বলছে ‘আমি আপনাকে ঘৃণা করি।’ কিন্তু আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের সত্য এবং মুখের সত্য একই ছিল। তার হৃদয়ের সত্য আর মুখের সত্যের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। নৈতিকতার প্রতীক, উদার ও ভালোবাসার ঝরনাধারা এই মানুষটার তুলনা কেবল তিনি নিজেই ছিলেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের লক্ষ লক্ষ জনতার উদ্দেশে তখনকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) উচ্চারিত ১৯ মিনিটের বক্তৃতা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে। বলা বাহুল্য হবে না যে, পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি সেদিনই ঘটেছিল‌। সেদিনই আওয়ামী লীগের জয়যাত্রার সূচনা। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবি সেদিনই জয়ী হয়।

২০১৫ সালে ইউনেস্কো এই অনন্য ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হ্যারিটেজ’ (লিপিবদ্ধ ঐতিহ্যের) অন্তর্ভুক্ত না করলেও এই ভাষণের গুরুত্ব ন্যূনতম হ্রাস পেত না। আমি প্রায়ই বলে থাকি, ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার না পেলেও তিনি জগতের অন্যতম সেরা কবিই হয়ে থাকতেন। এই তাৎক্ষণিক বক্তৃতা বৈদ্যুতিক শক্তিতে বাঙালির দেহের প্রতিটি দেহ-কোষে সঞ্চারিত হয়েছিল। ভাবা যায়! যে সহজ-সরল বাঙালি জাতি যারা আধুনিক যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে কিছুই জানত না, এই বক্তৃতা তাদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যার হাতে‌ নিত্যদিনের ব্যবহার্য দা, কুড়াল, লাঠি নিয়ে পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্বাপর না ভেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল ৩০ লক্ষ বাঙালি, সম্ভ্রমহানি হয়েছিল লক্ষাধিক মা-বোনের।

আমি আব্রাহাম লিঙ্কনের বিশ্বনন্দিত সংক্ষিপ্ত ‘গেটিসবার্গ বক্তৃতা, উইনস্টন চার্চিলের ‘রক্ত শ্রম ও ঘাম’ (তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বক্তৃতা) এবং পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ১৪ আগস্ট ১৯৪৭-এর 'ট্রাইস্ট উইথ ডেস্টেনি' (নিয়তির সঙ্গে অভিসার) অসাধারণত্ব স্বীকার করে বলব, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শৃঙ্খল মুক্তির বক্তৃতা ছিল সর্বকালের সেরা যা অনন্তকাল ধরে অনতিক্রম্য হয়ে থাকবে। এই বক্তৃতার প্রায় প্রতিটি লাইন দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালির ছিল মুখস্থ, সুতরাং এই বক্তৃতা সম্পর্কে আমি বিস্তারিত আলোচনা করব না। এই বক্তৃতাটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শ্রুত ভাষণ। এই বক্তৃতার প্রণিধানযোগ্য বিষয় ছিল ১৯ মিনিটের একটি মহাকাব্যের আবৃত্তি। আমার ধারণায় যা এসেছিল স্বর্গালোক থেকে। শত্রুদের বিরুদ্ধে এই ভাষণে একটিও হুংকার ছিল না, পরিশোধিত বা সভ্য ভাষায় কেবল অনুরোধ ছিল এবং পাশাপাশি ছিল দেশবাসীকে সর্বাঙ্গীন যুদ্ধ প্রস্তুতির আহবান ।

জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণের প্রধান বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের দেশের ও বিদেশের অনেক গুণী ও বিদগ্ধজন আলোচনা মৌখিক ও লিখিতভাবে প্রকাশ করেছেন। দেশের আপামর জনসাধারণের মুখে মুখে তার মহাকাব্যিক ভাষণের অংশবিশেষ প্রায়ই উচ্চারিত হয়।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বাঙালির গৌরব এবং আমার প্রিয় নেতা যিনি সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে জীবন পণ করেছিলেন। তিনি ভারতের জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদেরকে স্বাধীনতা উপহার দেব।’ আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু অন্য পথ ধরেছিলেন; তিনি বলেছিলেন, ‘দিয়েছিতো রক্ত, আরও দেব রক্ত’। আমার ধারণায় আমাদের নেতা বোঝাতে চেয়েছিলেন, তোমরা পাকিস্তানিরা আমাদের রক্ত নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে, আর কত রক্ত নেবে? সুতরাং পরিণামে আমাদের জয় হবেই!

দেশের মাথার মণি এমন একজন মহামানবকে ঘৃণ্য ঘাতকচক্র যেভাবে হত্যা করেছে তার উদাহরণ পৃথিবীতে নেই। আব্রাহাম লিঙ্কন, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, জন এফ কেনেডি, মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখের মৃত্যু হয়েছিল ঘাতকদের হাতে; তবে তা ছিল হত্যাকারী বা হত্যাকারীদের অস্ত্রে একক ব্যক্তি মানুষের সংহার। আমাদের জাতির পিতা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ সংহার করেছিল ঘাতকচক্র, এমনকি তার শিশুপুত্র রাসেলকেও তারা ছাড় দেয়নি। এই ঘাতকচক্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর সহচর ছিলেন খোন্দকার মোশতাক, তার কৃপাধন্য জিয়াউর রহমানসহ বিদেশি চক্র; যারা পাকিস্তানের বিভাজন মেনে নিতে পারেনি। মানতে পারেনি বিশ্ব মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের উদ্ভবকে। দৈবের কৃপায় তার আদরের দুই তনয়া বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে গিয়েছিলেন, জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ শেখ রেহানা। জ্যেষ্ঠ কন্যা জনকের হাতের আলোকবর্তিকাটি তুলে নিয়ে দেশবাসীকে আজও পথ দেখিয়ে চলছেন। তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তারই আলোকবর্তিকা বিচ্ছুরণে দেখানো পথে আমরা উন্নতির সড়কে এগিয়ে যাচ্ছি।

উইলিয়াম শেকসপিয়রের বিখ্যাত নাটক ‘জুলিয়াস সিজার’। এ নাটকে জুলিয়াস সিজারকে হত্যার পেছনে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী ছিল তারই ঘনিষ্ঠতম বন্ধু মার্কাস ব্রুটাস। তাকে সংসদ ভবনে নিয়ে গিয়ে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করেছিল একাধিক ঘাতক। আর সামনে থেকে ছুরিকাঘাত করেছিল জুলিয়াস সিজারের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু মার্কাস ব্রুটাস। তিনি কেবল উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন; ‘তুমিও ব্রুটাস’! জুলিয়াস সিজারের ঘৃণ্য ও নির্দয় হত্যাকে সিজারের ঘনিষ্ঠ স্বজন-বন্ধু মার্ক অ্যাস্টনি বর্ণনা করেছিলেন- ‘দিস ওয়াজ দা মোস্ট আনকাইন্ডেস্ট কাট অব অল’। শেক‌সপিয়র জ্ঞানত বৈয়াকরণিক শুদ্ধ ইংরেজির তোয়াক্কা না করে সর্বোচ্চ বিশেষণ একবাক্যে পর পর দুবার ব্যবহার করেছিলেন। এই মৃত্যুর নির্মমতা প্রকাশ করতে 'মোস্ট আনকাইন্ডেস্ট' ব্যবহার করেছিলেন, যা ব্যাকরণগতভাবে ভুল। এই নাটকের জুলিয়াস সিজারের উক্তিতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের দৃঢ়তা লক্ষ করা যায়–“Cowards die many times before their deaths: The valiant never taste death but once” (কাপুরুষ মৃত্যুর আগে মরে বারবার, বীর শুধু একবার। অনুবাদ সৈয়দ শামসুল হক)।

আমি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসিন্দা থাকার সময়ে বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে একাধিকবার দেখেছি। চেক সাদা লুঙ্গি এবং হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরে সকাল বেলায় তাকে দেখেছি উদাত্ত কণ্ঠে ‘বুবু বুবু’ ডাক দিয়ে বেগম সুফিয়া কামালের বাসায় ঢুকতে। বেগম সুফিয়া কামালের বাসায় সকালে চা পানের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা উলটাতেন এবং নানা বিষয়ে গল্প করতেন। বঙ্গবন্ধুর একটি বিশেষ গুণ ছিল তার অনন্য স্মরণশক্তি। বাংলাদেশের কয়েক হাজার মানুষকে তিনি পারিবারিক পরিচয়সহ ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ছিল তার স্বজন ও আপনজন। তার বাসায় আমি দু’বার গিয়েছি। তখন আমি মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটক করি।

১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের বিখ্যাত কবি ও নাট্যবিদ জিয়া হায়দার ছিলেন এই নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আর আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। জিয়া হায়দার অর্থাৎ জিয়া ভাইয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভালো পরিচয় ছিল। তিনি তাকে ‘মুজিব ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। আমরা কোনো একটি যাত্রাপালা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার কাছে আর্থিক সহযোগিতার জন্য গিয়েছিলাম। ডিএল রায়ের লেখা গান- ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা–’ উদাত্ত কণ্ঠে গাইতে গাইতে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নিচতলায় নামছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরনে ছিল সাদা চেক লুঙ্গি ও হাতাওয়ালা সাদা গেঞ্জি। তিনি আমাদের সব কথা শুনলেন। আমি ভয়ে ‘স্যার’ ‘স্যার’ করে সম্বোধন করছিলাম। তিনি বললেন, ‘মালেক সাহেব (আমরা বলতাম ঠেঁটা মালেক) এখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। আমি হলাম বিরোধী পার্টির দলনেতা আমার কথায় কি কোনো কাজ হবে?’ তখন বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। সমগ্র দেশ তার হুকুমে স্থবির হয়ে গিয়েছিল। সব অফিস-আদালত বন্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুই বলে দিয়েছিলেন বিশেষ একটি দিনে বিভিন্ন অফিসের কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবে। এক কথায় বিরোধী দলের নেতা অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে সমগ্র দেশ চালাচ্ছিলেন।

মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন কিন্তু তার বাস্তব রূপায়ণ ঘটিয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ঘটনা আমি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। বাঙালিদের কাছে তিনি ত্রাতাতুল্য ছিলেন। যাহোক মজার বিষয় বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে আমাদের টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন এবং সেই নির্দেশ থেকে গভর্নর মালেক সাহেবের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি অনু ভাইও বাদ পড়লেন না। বললেন, অনু এদের কিছু টাকা পয়সার ব্যবস্থা সরকারি তহবিল থেকে করে দিবি। এরা দেশের কথা বহির্বিশ্বে শোনাবার জন্য একটি যাত্রাদল নিয়ে যাত্রাপালা দেখাতে বিদেশ যাবে। আমাদের অবশ্য বিদেশে (দক্ষিণ কোরিয়াতে) যাওয়া হয়নি। কারণ সেই লোকজ নাটকের অনুষ্ঠানটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। তার পাঁচ সাতটা টেলিফোনে সেদিনে কয়েক লক্ষ টাকা ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিলো। এই ঘটনা আজও আমার এই পরিণত বয়সে আপন মনে ভাবতে ভালো লাগে। স্মৃতিকে আন্দোলিত করে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা আমি রেসকোর্স ময়দানে বসে শুনেছি। আমার মনে হয়েছে, এখনও মনে হচ্ছে প্রতিটি শব্দ-বাক্য অনন্য। মনে দৈব থেকে প্রেরিত। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে যেতাম, ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সঙ্গে তার সমঝোতা আন্দোলনের অগ্রগতি শোনার জন্য। সেই অনন্য নেতার চেহারা যতদিন আমি বেঁচে থাকব, কোনোদিন ভুলব না। তার প্রিয় ধূমপানের পাইপটি হাতেই থাকত।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন শ্রুতিধর। অনেক কবিতা ও গান মুখস্থ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার প্রিয় কবি। রবি ঠাকুরের অনেক কবিতা তিনি মুখস্থ বলে যেতে পারতেন। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু যেদিন ইংল্যান্ড-ভারত হয়ে তেজগাঁও ও পুরানা পল্টনে এলেন, সেদিনও আমি ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু কিছুটা কৃশকায় হয়ে গিয়েছিলেন। স্বজন-বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন এবং একটু শান্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ থেকে আবৃত্তি করলেন– “নমোনমো নমঃ, সুন্দরী মম জননী- বঙ্গভূমি। গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি”।

তারপরে নিজের বাড়িতে পুত্রকন্যা-স্ত্রীর কাছে না গিয়ে সোজা চলে গেলেন রেসকোর্স ময়দানে, তার প্রতীক্ষায় উদ্বিগ্ন অপেক্ষমাণ দেশবাসীর কাছে। বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় তার সকল কার্যক্রম স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হতো, কোনো পদক্ষেপ নিয়ে তাকে হোঁচট খেতে দেখিনি।

এই লেখা হবে অনিঃশেষ। তাই এখানে শেষ করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার কাছে ছিলেন রূপকথার এক অনন্য রাজকুমার এবং সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!

লেখক: মঞ্চসারথি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

এ বিভাগের আরো খবর