বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

স্বপ্নের জলশহর: ‘কঠিনের’ ঘটুক উত্তরণ

  •    
  • ১৯ জানুয়ারি, ২০২১ ১৪:৩৯

একশ’ ভাগ দখল হয়ে যাওয়া বা অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া খালকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনা অনেক বেশি কঠিন। ‘সেই কঠিনেরে’ যেহেতু মেয়রদ্বয় ভালোবেসেছেন, অতএব নাগরিক হিসেবে আমরা এই প্রত্যাশা করতেই চাই যে, এই কঠিন কাজ বাস্তবায়নে তাদের পলিটিক্যাল উইল বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে এবং রাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায়ের গ্রিন সিগন্যালও তাদের কাছে রয়েছে।

এখন রাজধানীর যে এলাকায় থাকি, তার পাশেই পান্থপথের বড় রাস্তা, যেটি পশ্চিমে রাসেল স্কোয়ার থেকে পুবদিকে সার্ক ফোয়ারার মোড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। ব্যস্ত এই সড়কে সারাক্ষণই যানবাহন চলে। এই সড়কের পাশে স্কয়ার, শমরিতা, বিআরবি, হেলথ অ্যান্ড হোপের মতো বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং রাজধানীর অন্যতম অভিজাত বিপণীবিতান বসুন্ধরা শপিং মল। ফলে এই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপও প্রচুর। কিন্তু কেমন হবে যদি কয়েক বছর পরে দেখা যায় যে, এই সড়কে নৌযান চলছে?

সড়কে নৌযান চলে না। কিন্তু শঙ্কাটা এরকমই। কেননা, এই সড়কের নিচেই রয়েছে খাল। যেটি উন্মুক্ত করে দিয়ে দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিলের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হবে। তখন আর ব্যক্তিগত বাহন নয়, বরং মানুষ নৌযানে করে এসে শপিংমল বা হাসপাতালের গেটে নামবেন।

কী নাম দেয়া হবে এই জলপথের, পান্থ লেক? এখন কেউ ঠিকানা জানতে চাইলে যেমন বলি পান্থপথ, তখন আমরা বলব, আমাদের বাসা পান্থ লেকের পাশে। বারান্দা থেকেই হয়তো আমরা সন্ধ্যায় লেকের স্বচ্ছ জলে রঙিন আলোর খেলা দেখতে পাব। রাজধানীবাসীকে এই স্বপ্নটি দেখাচ্ছে রাজউক ও সিটি করপোরেশন।

বলা হচ্ছে, পান্থপথের বিদ্যমান রাস্তায় দখল হওয়া খালটি পুনরুদ্ধার করে এর মাধ্যমে ধানমন্ডি লেক থেকে নৌকা বা ওয়াটার ট্যাক্সিতে হাতিরঝিল হয়ে গুলশান-বারিধারায় যাওয়া যাবে। এর মধ্য দিয়ে শুধু রাজধানীর জলপথের পরিমাণ বৃদ্ধি বা যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিই নয়, বরং এই মহানগরীতে জলাধারের পরিমাণও বাড়বে—যা বর্ষার মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনেও বড় ভূমিকা রাখবে।

বিশেষ করে ধানমন্ডি, শুক্রাবাদ, কারওয়ান বাজার এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জের সুযোগ বাড়বে। শুধু এই পান্থপথ খালই নয়, বরং রাজধানীর দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া অন্য খালগুলোও সচল করে সেখানে নৌযান চালানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন দুই মেয়র। দুজনই বলেছেন, রাজধানী ঢাকা ইতালির জলশহর ভেনিসের চেয়ে কম হবে না।

গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের সব খাল আনুষ্ঠানিকভাবে দুই সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয় ঢাকা ওয়াসা। অনুষ্ঠানে দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ঢাকার খালগুলো উদ্ধারের যে অঙ্গীকার আমরা করেছিলাম, সেটার বাস্তবায়ন শুরু করতে যাচ্ছি। জানি, কাজটা অনেক কঠিন। কিন্তু অঙ্গীকার থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই। যদি এই কাজে সফল হতে পারি, তাহলে ভেনিসের চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না ঢাকা শহর।’

মেয়র জানান, শুরুতেই তারা একটা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছেন। এর আওতায় তিনটি খাল উদ্ধার করা হবে। এগুলো হলো জিরানি খাল, মান্ডা খাল ও শ্যামপুর খাল। একইসঙ্গে পান্থপথ কালভার্ট ও সেগুনবাগিচা কালভার্ট দুটিও উদ্ধার করা হবে। অনুষ্ঠানে উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামও বলেন, ‘খাল রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে ঢাকা হবে ভেনিস।’ এর কিছুদিন পরে উত্তর সিটির রূপনগর খাল পরিদর্শনে গিয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, তিনি এই খাল দিয়ে নৌকা চালিয়ে তুরাগ নদীতে যেতে চান। খালটির অবৈধ অংশ উদ্ধার করে এই নৌকাভ্রমণ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরের সঙ্গে ভেনিসের মূল পার্থক্যই হলো এর যোগাযোগ ব্যবস্থায়। সড়ক, রেল ও আকাশপথের অভাবনীয় উন্নতির এই সময়েও ভেনিসের মূল যোগাযোগমাধ্যম নদীপথ। অর্থাৎ জল ও জলপথই এই শহরের মূল আকর্ষণ, সৌন্দর্য এখানে পর্যটক আকর্ষণেরও প্রধান কারণ এর নান্দনিক ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ-ব্যবস্থা।

রাজধানী ঢাকা শুধু ভেনিসের মতোই নয়, বরং ভেনিসের চেয়েও বেশি সুন্দর হতে পারতো শুধু এর ভেতরে এবং চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, খাল ও জলাশয়গুলো কাজে লাগিয়ে। কিন্তু কাজে লাগানো তো দূরে থাক, বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতাবানদের প্রশ্রয়ে অসাধু লোকেরা এসব নদী, খাল ও জলাশয় দখল করে গড়ে তুলেছেন ভবন।

কোথাও কোথাও খালের ক্ষীণরেখা দেখা গেলেও অনেক জায়গায় অস্তিত্বই নেই। অর্থাৎ ঢাকাকে ভেনিসের মতো করে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন দুই মেয়র দেখাচ্ছেন, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। বরং ক্ষমতাবানের বহুবিধ বাধার মুখে পড়তে হবে। অনেক বহুতল ভবন ভাঙতে হবে। নতুন করে জলরেখা তৈরি করতে হবে।

প্রসঙ্গত, ঢাকার বুক চিরে একসময় ৪০ টিরও বেশি খাল প্রবাহিত হতো। কিন্তু এখন সেখানে হাতিরঝিল, গুলশান লেক ও ধানমন্ডি লেক ছাড়া আর কোনো পরিষ্কার জলাভূমি দেখা যায় না। যেগুলো আছে, সেগুলো ময়লা পানির ড্রেনে পরিণত হয়েছে।

রাজধানী ঢাকার খালগুলোর মালিক মূলত ঢাকা জেলা প্রশাসন। কিন্তু আশির দশকে খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায় ঢাকা ওয়াসা। ২০০১ সালের দিকে অধিকাংশ খাল ভরাট করে তাতে বক্স কালভার্ট নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এতে জলাবদ্ধতা না কমে উলটো বেড়ে যায়। প্রকল্পটি ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৬ সালের ১৫ জুন। একনেকে ঢাকার খালগুলো থেকে বক্স কালভার্ট তুলে উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসে। তখন খালের আগের রূপ ফিরিয়ে আনতে ঢাকা ওয়াসা, রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বাস্তবতা হলো, একটি ড্রেন বা ক্ষীণ জলরেখাকে সংস্কার করে যত দ্রুত নৌপথে রূপ দেয়া যায়, একশ’ ভাগ দখল হয়ে যাওয়া বা অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া খালকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনা অনেক বেশি কঠিন। ‘সেই কঠিনেরে’ যেহেতু মেয়রদ্বয় ভালোবেসেছেন, অতএব নাগরিক হিসেবে আমরা এই প্রত্যাশা করতেই চাই যে, এই কঠিন কাজ বাস্তবায়নে তাদের পলিটিক্যাল উইল বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে এবং রাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায়ের গ্রিন সিগন্যালও তাদের কাছে রয়েছে। কেননা সেই সিগন্যাল না থাকলে যতই সদিচ্ছা থাকুক, আর্থ-রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান লোকদের বহুতল ভবন ভাঙতে গিয়ে তাদের উলটো বিপদে পড়তে হতে পারে। কারণ টাকার জোর যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতিও পালটে দেয়, সেখানে দুই মেয়র চাইলেই যে সবকিছু সহজে করে ফেলতে পারবেন—এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

তারা যেহেতু নাগরিকদের ভেনিসের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন এবং কাজও শুরু করে দিয়েছেন, তার ফলাফল পেতে হলে এখানে সচেতন নাগরিকদেরও সহায়তা লাগবে। সেই সহায়তাটি টাকা পয়সা দিয়ে না হোক, অন্তত নৈতিক সমর্থনটাও জরুরি। আমাদের সর্বাত্মক নৈতিক সমর্থন ও শুভকামনা আপনাদের প্রতি রইলো মেয়রদ্বয়।

আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। অনেক নদী ও খালের জায়গা পুনরুদ্ধারের পরে সেগুলো পুনরায় দখল হয়ে গেছে। সুতরাং ঢাকা সিটির মেয়ররা যে ‘কঠিনেরে ভালোবেসেছেন’, সেটি টেকসই করতে চাইলে শহরের সিএস/আরএস/এসএ ম্যাপ অনুযায়ী সব খালের সীমানা চিহ্নিত করা এবং সব দখলকারীকে উচ্ছেদ করে খালের দুই পাড় বাঁধাই করতে হবে এবং দুপাশে হাঁটার মতো রাস্তা করে দিতে হবে—যাতে নতুন করে খাল দখল না হয়ে যায়। এজন্য মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং প্রভাবশালীদের। অর্থাৎ যারা জলাশয় দখল করেন এবং যাদের প্রশ্রয়ে দখল হয়।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর