আমরা অনেকেই গল্প করতে বা বলতে পছন্দ করি। শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমেই এই গল্প বলা যায়। ছবি এঁকে, কবিতায়, গল্প- উপন্যাস লিখে, চলচ্চিত্রে বা নিবন্ধ লিখে এই গল্প বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ যার যে মাধ্যম পছন্দ, সেটাকেই ব্যবহার করে থাকি গল্প বলার জন্য।
আমি যখন কলম নিয়ে বসি কিছু লেখার জন্য তখন অজানা এক আশঙ্কা কাজ করে। এই আশঙ্কা হলো লেখাটা কারো বিরুদ্ধে যাচ্ছে কি না! কোনো কিছু নিয়ে লেখার জন্য ভাবছি, তখনো এক ধরনের চাপ কাজ করে। চাপটা হলো লেখাটা ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের বিপক্ষে যাচ্ছে কি না! শুধু বিপক্ষেই না অনেক সময় এমন হয় সমাজের ঘটে যাওয়া কোনো সত্য ঘটনা বা চরিত্র নিয়েও পক্ষে কলম ধরলে ভয় লাগে। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে, চলতে ফিরতে রাস্তা-ঘাটে অফিস-আদালতে, বাসায় সবখানে আমাদের ভাবতে হচ্ছে- আমি যা করতে যাচ্ছি বা বলতে চাচ্ছি তা অন্যের বিপক্ষে যাচ্ছে কি না। ফলে ইদানীং অনেকেই কথা বলাও কমিয়ে দিচ্ছেন, কি বাসায় কি অফিসে।
সমাজের প্রতিটা মানুষ ভালো না। আবার সবাই খারাপ নই। ঠিক সব পেশায় ভালো মানুষ যেমন আছেন. আবার খারাপ মানুষ তেমন আছেন। আবার একই ব্যক্তি কারো কাছে খারাপ কারো কাছে ভালো।
যেকোনো বিষয়ের ভালো ও মন্দ দুইটা দিক থাকে। আবার সেই বিষয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি থাকে। লেখকের কাজ হলো নির্দিষ্ট কোনো বিষয়কে তুলে ধরা বা সমালোচনা করা, যাতে করে এই লেখা থেকে যতটুকু ভুল শুধরে নেয়া যায় অথবা লোকজনকে সেই লেখার মাধ্যমে আলোকিত করা। কিন্তু লেখক ভয়ে ভয়ে থাকেন সম্পাদক ছাপবেন কি না! সম্পাদক চাপে থাকেন কোনো পেশার বিপরীতে গেলে তারা আবার ধর্মঘটে যান কি না। পরিচালক চাপে থাকেন সেন্সর বোর্ড থেকে বাদ দেয়া হয় কি না ইত্যাদি। পুলিশ ও প্রশাসনের কথা না হয় বাদ দিলাম।
আমার জানামতে, বাংলাদেশে একটা পেশার মানুষ আছেন যারা কোনোদিন ধর্মঘটে যাননি। তারা হলেন ব্যাংকার। আমি কোনোদিন শুনিনি বা দেখিনি যে, কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে তারা ক্যাশ বন্ধ করে প্রতিবাদ করেছেন। আমরা কমবেশি দেখি যে প্রায় সব পেশার মানুষ প্রতিবাদ করে, অনশন করে, বিভিন্নভাবে জানান দেয় তাদের দাবির কথা। আমি সেই তালিকা দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। বরং পাঠকদের বলবো যে, তারা কবে কোন ব্যাংকে গিয়ে শুনেছেন যে, ব্যাংকাররা কর্মবিরতিতে আছেন সেই তথ্য আমাকে দেবেন। তাহলে আমার জ্ঞানের কিছুটা হলেও ঘাটতি দূর হবে।
আজ থেকে বিশ বছর আগে আমি একটা শব্দ ব্যবহার করে বইয়ের নাম দিয়েছিলাম ‘আবেগাহন’। যার অর্থ দিয়ে আমি বলতে চেয়েছিলাম আবেগ দিয়ে অবগাহন। বিষয়টা এমন ছিল এক যুবক আবেগ দিয়ে গোসল বা স্নান করে। সেই বইয়ের অধিকাংশ কবিতা ছিল আবেগাশ্রিত। যদিও সব লেখার সঙ্গে আবেগের কমবেশি যোগাযোগ আছে। সেই সময় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, কোনো শব্দ যদি ডিকশনারিতে না থাকে তাহলে আমি সেটা ব্যবহার করতে পারি কিনা।
পরে সেই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে নাম বদলে দিয়েছিলাম ‘আবেগের সঙ্গে বসবাস’। সে সময় আমি বলেছিলাম আমরা যদি এভাবে চিন্তা করে নতুন শব্দ যোগ ও প্রচার না করি তাহলে শব্দের ভাণ্ডার কী করে বাড়বে আর ডিকশনারিতে যুক্ত হবেই বা কী করে। বাংলা সাহিত্যে এ রকম অনেক উদাহরণ আছে কবি-লেখকেরা লিখে লিখে এই শব্দের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছেন। সবচেয়ে বড় উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের ‘অশ্রুজল’ শব্দ।
সম্প্রতি আমি আমার এক কবিতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দকে ‘ঠিস ঠিস’ বলেছি, আমাকে একজন বলেছেন এর গ্রহণযোগ্যতা কী? আমি বলেছিলাম টাপুর-টুপুর, রিমঝিম, অনেক হলো। আর কত? এবার নতুন করে কিছু ভাবি। তিনি আমার কথা মেনে নিতে পারেননি। পরে যখন বলেছি এই শব্দ ‘কোজাগরী’ বইতে ভারতীয় লেখক বুদ্ধদেব গুহ ব্যবহার করেছেন, তখন আমাদের আলোচনা আর এগোতে পারেনি। তাহলে লেখককে সব সময় কোনো না কোনোভাবে চাপে থাকতে হয়, সেটা বন্ধু মহলে হোক বা আরও বড় কোনো পরিসরে। ফলে তখন আমাদের শঙ্কা আরও বেড়ে যায়। কী লিখি বা কীভাবে লিখি। এই নিয়ে সারাক্ষণ মাথার ভিতরে একটা মাছি ভন ভন করে।
অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সোমবার আমেরিকানদের জন্য বিশেষ দিন। ‘কলম্বাস দিবস’ হিসেবে এই দিনটা ছুটি হিসেবে পালিত হয়। আমেরিকানরা ইতালিয়ান অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতেই জাঁকজমকভাবে দিনটি অতিবাহিত করে থাকে। কলম্বাস যখন আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছিলেন, তারিখটি ছিল ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর। ‘কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন’ বলার চেয়ে ‘কলম্বাস আমেরিকাকে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন’ বলাটাই আরও বেশি যৌক্তিক।
কেননা, ১৪৯২ থেকে ১৫০২ সাল পর্যন্ত তার বিখ্যাত চারটি অভিযানের পথ ধরেই কানাডার উত্তর প্রান্ত থেকে চিলির দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত সব জায়গাতেই নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছে স্প্যানিশ-পর্তুগিজ-ডাচ-ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চরা। একদা তার এই আমেরিকা আবিষ্কারের জন্য এক ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। অনেকটা কলম্বাসকে সংবর্ধনা দেয়ার আয়োজন। সেখানে সবার বক্তব্য এমন ছিল যে, আমেরিকা আবিষ্কার কোনো ব্যাপার না, নৌকা নিয়ে বেরুলেই হলো। তখন কলম্বাস একটা ডিম দিয়ে বলেছিলেন সবাই এটাকে এক এক করে টেবিলের উপরে রাখতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেউ টেবিলের উপরে ডিম রাখতে পারেনি। ডিমটা যখন অতিথির হাত ঘুরে কলম্বাসের হাতে ফিরে এল, তখন তিনি ডিমের একটা কোণা টেবিলের সঙ্গে গুঁতো মেরে হালকা করে ফাটিয়ে ডিমটাকে টেবিলের উপরে বসিয়ে দিলেন। সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, ‘এ আর এমন কী এটা তো সবাই পারে’। তখন কলম্বাস বলেছিলেন, ‘এটা সবাই পারে তবে বুদ্ধিটা সবার থাকে না’।
বুদ্ধি করে নানাভাবে সেন্সরের কথা মাথায় রেখে আমাদের লিখে যেতে হয়, নয়ত বানাতে হয় চলচ্চিত্র। ফলে সমাজের অনেক বাস্তব বিষয় আমরা আমাদের লেখায় তুলে আনতে পারছি না বা পারি না। আবার সব লেখকের সেই ধরনের সক্ষমতা নেই। ফলে বাংলাদেশে নচিকেতার মতো গীতিকার-শিল্পী সৃষ্টি হচ্ছে না। ঘুরে ফিরে কবিরা চাঁদ, তারা, ফুল আর প্রেম নিয়েই কাব্যচর্চা করে যাচ্ছেন।
প্রতিবাদী লেখক আজকাল পাওয়া যাচ্ছে না। চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা যাচ্ছে না। সম্পাদকীয়তে পাওয়া যায় না ঝলসে যাওয়া কোনো এক বারুদের মতো লেখা। সমাজের নানান দিক নিয়ে বুকে সাহস নিয়ে লেখা প্রকাশিত হলে সমাজের মানুষ উপকৃত হতো।
আমরা যারা কল্পনায় বসবাস করি বিজ্ঞান সেটাকে বাস্তবে রূপ দেয়। জুল ভার্ন যখন ‘আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ’ বইটা রচনা করেন, তখন নিশ্চয় তাকে নিয়েও উপহাস করেছিল তখনকার সমাজ ব্যবস্থা। অজানা নানামুখী কর্মকাণ্ড শুধু শিল্প-সাহিত্যের বিকাশে বাধা নয়, এর মান এবং মননশীলতার অন্তরায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও শুদ্ধতা রক্ষা, জীবনাচারণ এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা কিংবা সামাজিক অবক্ষয়রোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে সাহিত্যের অবদান কোনো অংশেই কম না।
সামনেই ভাষার মাস, বই মেলা হোক বা না হোক বই প্রকাশ হোক। আমরা ঘরে বসেও যেন বই কিনতে পারি সেই আশা ব্যক্ত করতেই পারি। আশির দশকের মতো সামরিক আগ্রাসন আমাদের ঘিরে রাখেনি। আমাদের দেশে গণতন্ত্র আগের চাইতেও অনেক বেশি চর্চা করা হয়। তাই ফুল পাখি চাঁদ তারা নিয়ে আর কতদিন? সমাজের সব বিষয় নিয়ে খোলা মনে আমাদের কলম আবার আবার লিখতে শুরু করবে বলে আশা করছি।
লেখক : কলাম লেখক, ব্যাংকার।