বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীরা বরাবরই বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রহিত করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের মতে, এর মাধ্যমে দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। তবে সরকার প্রতিবারই বলছে, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যই তারা এমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
অর্থ যাতে বিদেশে পাচার হতে না পারে এবং দেশের অর্থ দেশেই বিনিয়োগ হয়, এই বিবেচনায় তারা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দিচ্ছেন। আসলে এ ধরনে সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির বিস্তারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে বলে মনে করছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সরকার একদিকে সুশাসনের কথা বলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বার বার উচ্চারণ করছে, আবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিচ্ছে। প্রকারন্তরে এটা সরকারের দ্বিমুখী নীতির নামান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ।
অর্থনীতিবিদের মতে, কালো টাকা বলতে সে সম্পদ বা আয়কে বুঝায় যে সম্পদ বা আয়ের বিপরীতে কর প্রদান করা হয়নি৷ এর আবার দু'টি ভাগ আছে, এর একটি হলো বৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ, আরেকটি হলো অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ৷
কালো টাকা প্রতিনিয়ত আমাদের অর্থনীতিতে ঢুকছে৷ এতে দুই ধরনের সমস্যা হচ্ছে৷ প্রথমত, সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷ আর যারা সৎ বিনিয়োগকারী, তারা কালো টাকার সঙ্গে পেরে ওঠেন না৷ ফলে অর্থনীতিতে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে৷ বিশ্বব্যাংক অবৈধ আয়ের কালো টাকার উৎস হিসেবে মাদক ব্যবসা, অবৈধ ব্যবসা, ঘুষ ও দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছে৷
আয়কর আইনজীবীদের মতে, আইনে কালো টাকা হলো অপ্রদর্শিত আয়৷ যে আয়ের কর দেয়া হয়নি৷ সেই আয় বৈধ এবং অবৈধ দুটোই হতে পারে৷ এনবিআর আয়কর নেয়ার সময় আয়ের উৎস জানতে চায় না৷ এখানে আয় বৈধ না অবৈধ সেটা আলাদা করার সুযোগ নেই৷ তবে খরচের খাত যখন দেখানো হয়, তখন আয়ের উৎস বলতে হয়৷ এটি আয়কর দেয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
দেশে ঘোষণা দিয়ে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। এ পর্যন্ত ১৭ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং বৈধ করা মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা এবং এর আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। তখন রেকর্ড পরিমাণ ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছিল।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, কিছু মানুষ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের তথ্যমতে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয়, প্রায় সাড়ে নয়শ’ কোটি টাকা কর দিয়ে বৈধ করেছেন সাত হাজার ৪৪৫ করদাতা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে ২০৫ জন প্রায় ২২ কোটি টাকা কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করেছেন। আর অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ, ব্যাংকে জমা রাখা টাকা, ফ্ল্যাট ও জমি বৈধ করেছেন ৭ হাজার ৪৪৫ করদাতা। আর এর বিপরীতে তারা কর দিয়েছেন প্রায় ৯৪০ কোটি টাকা। তাদের সবাই রিটার্ন দাখিল করে অপ্রদর্শিত আয়ের ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশে ২০১২-১৩ সাল থেকেই জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার একটা নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবারই বলা হয় এটাই শেষ সুযোগ। কালো টাকার বিশেষ সুযোগ নিয়ে শেয়ার বাজার বা আবাসন খাতের মতো সুনির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এলে সেটি দেশের অর্থনীতিতে সত্যিকারভাবে কতটা ভূমিকা রাখে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেট বক্তব্যে বলেছিলেন, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।’
তিনি আরও বলেছিলেন, একই সময় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে, ওই বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে, আয়করসহ কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করবে না।
এর বাইরে বিনিয়োগ চাঙা করতে বিদায়ী অর্থবছর থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে সরকার। সেখানে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকৃত অর্থের ১০ শতাংশ কর দিলেই এখন প্রশ্ন করবে না এনবিআর। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এই সুযোগ আছে। অবশ্য এখন পর্যন্ত কেউ হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে কালোটাকা বিনিয়োগ করেননি। বিদায়ী অর্থবছরে ফ্ল্যাট কেনায়ও তেমন সাড়া পায়নি সরকার।
বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ কত তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের কোনো গবেষণা নেই৷ তবে ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণার তথ্যমতে, ২০০২-২০০৩ সালে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল মোট জিডিপি’র ৩৭ দশমিক সাত ভাগ। অন্যদিকে ২০১১ সালে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় কালো টাকা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে৷ তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ ভাগ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ৷ গবেষণায় আরও বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পরযন্ত গড়ে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩৫.৬ ভাগ৷ আর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কালো টাকার পরিমাণ ছিলো জিডিপির মাত্র ৭ ভাগ৷ তবে দেশে ঘোষণা দিয়ে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। খুব বেশি সাড়া না মেলায় ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তখনকার সরকার বলেছিল, ‘নানা কারণে অনেকে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি বলে আবেদন নিবেদন বিবেচনা করে সরকার তাদের কর-অনারোপিত প্রকৃত আয়ের ঘোষণার জন্য এ বছর ৩০ জুন পর্যন্ত আর একবার সুযোগ দিয়েছেন। আশা করা যায়, করদাতারা তাদের এখনও অপ্রকাশিত আয় ঘোষণার এই শেষ সুযোগ হারাবেন না। কেননা, এরপর কর ফাঁকির মামলাসমূহের ব্যাপারে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ তখন মাত্র ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা হয়েছিল।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর আবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে বলা হয়, এর মধ্যে সুযোগ না নিলে সর্বোচ্চ ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত— জরিমানা করা হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার এই সুযোগ নেয় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আর এতে বৈধ হয় ৯ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
২০০৯ সালে নতুন সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। এমনকি আয়কর অধ্যাদেশে স্থায়ীভাবে নতুন একটি ধারা সংযোজন করে কালোটাকা সাদা করার আইনি সুযোগ রাখা হয়। এই ধারাটি হচ্ছে ১৯-ই। এর ফলে প্রযোজ্য আয়করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিলে যে কেউ অর্থ সাদা করতে পারবেন।
প্রায় সব সরকারই অবাধে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে, নানা ধরনের হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব হুমকি কেবল বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে তেমন কেউ উৎসাহ দেখায়নি। তবে দু’টি ব্যতিক্রম ঘটনার কথা বলাই যায়।
যেমন এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি সরকার গঠন করলে তখনকার অর্থমন্ত্রী ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে কালোটাকা বৈধ করার যে ধরনের বৈষম্যমূলক কর দায়মুক্তির সুবিধা দেওয়া হয়েছে, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, এ ধরনের গণতান্ত্রিক ও গোষ্ঠী স্বার্থপ্রসূত বৈষম্যমূলক করনীতি আমাদের এই গণতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণ পরিহার করবে।’ পরের পাঁচ অর্থবছরে কালোটাকা সাদা করার আর সুযোগই দেওয়া হয়নি।
দ্বিতীয় ব্যতিক্রম ঘটনাটি ২০০৯ সালের। সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। তখনকার অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব পেয়ে বাজেটের আগে ঘোষণা দিলেন আর কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে না। কিন্তু বাজেট ঘোষণায় ঠিকই এ সুযোগ দেওয়া হলে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি। ফলে এর ব্যাখ্যা দিতে হয়েছিল তাকে।
বাজেট–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও এই সুযোগ দেওয়া হয়েঝছ রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ সমঝোতায়। কেননা, রাজনীতি হলো আপসের সবচেয়ে নিপুণ কৌশল। রাজনীতিতে সব ধরনের মানুষ ও সব ধরনের স্বার্থকে সমন্বয় করে চলতে হয়। এ হচ্ছে রাজনীতির কাছে নৈতিকতার পরাজয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এর মতে, ‘কালোটাকা সাদা করার যে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা চিরতরে বন্ধ করা উচিত। ঢালাও সুযোগ দেওয়ার পরও যে পরিমাণ সাড়া পাওয়া গেছে, তা হতাশাজনক। আশা করা যায়, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন ও বিবেচনা করবে।’
দেশে যে পরিমাণ কালোটাকার মালিক আছে বলে অনুমান করা হয়, সে তুলনায় কালো টাকা সাদা করার চিত্রটি আশাব্যঞ্জক নয়। ভবিষ্যতে তথ্য গোপন থাকবে না— এমন আশঙ্কা থেকেও অনেকে সাদা করতে চান না। আর রাঘব বোয়ালেরা বিদেশে পাচার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলে অভিযোগ আছে। উচিত হবে চাঁদাবাজি, ঘুষের মতো কালোটাকার উৎসমুখ চিরতরে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া।
অবৈধ কাজকে বৈধ করার আইনগত সুযোগ দেওয়ার এই বিষয়টি কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অনৈতিক একটা বিষয়কে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হলে সৎ করদাতাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয় এবং এটা সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিকেই উৎসাহিত করে। প্রকারান্তরে এর মাধ্যমে দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে।
কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগটি চিরতরে বন্ধ করাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূলের প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে বলে সংশ্লিষ্টদের দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: কলাম লেখক ও ব্যাংকার