বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আয়ের বিকল্প উৎস নিয়ে কিছু কথা

  • আতাহার খান   
  • ১৬ জানুয়ারি, ২০২১ ১৬:১৬

আমাদের কারো অজানা নয়, দেশে আশানুরূপ না-হলেও বিদেশি বাণিজ্যিক বিনিয়োগ কিছু-না-কিছু আসছেই। এই বাণিজ্যিক বিনিয়োগ আসার মূল কারণ শিল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের এখানে শ্রমের দাম অনেক কম, পানির মতো সস্তা আর কি! তাই অধিক মুনাফার আশায় শিল্পোন্নত দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে।

কঠিন এক পথ অতিক্রম করতে হচ্ছে। মহামারি করোনা ভাইরাসের আঘাতে পুরো দেশটাই প্রায় স্থবির। এতে অর্থনীতির সবগুলো খাত কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষত সেরে উঠবার আগেই আবার করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানতে শুরু করে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, সংকটের ভিতর দিয়ে দেশের অর্থনীতি কোনোক্রমে হেঁটে চলছে।

ক’দিন আগে এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়তে পারে। অবস্থা যদি শেষাবধি খারাপের দিকেই যায় তাহলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩০২ কোটি ১০ লাখ ডলার। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও সব সদস্য দেশকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বিশ্ববাণিজ্য থমকে আছে। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী প্রায় আড়াই কোটি মানুষ চাকরিচ্যুত হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। আয় কমে গেছে বহুসংখ্যক মানুষের। দারিদ্র্যের সূচকও এখন ঊর্ধ্বমুখী, তাকে কিছুতেই বাগে আনা সম্ভব হচ্ছে না, শুধু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

তারপরও স্বীকার করতে হয়, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সব আশা হাত ছাড়া হয়ে গেছে একথা বলবার সময় এখনও আসেনি। সরকারের সদিচ্ছা আছে, আছে প্রণোদনার বিশেষ ব্যবস্থা। এ মুহূর্তে হয়ত চলতি অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতির দুরবস্থা এড়ানো সম্ভব হবে না।

অর্থ-মন্ত্রণালয় থেকে ২০০০ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে মোট রাজস্ব আয় বেড়েছে ৮ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। এতে চলতি অর্থ বছরে কর-বহির্ভূত রাজস্ব প্রবৃদ্ধির ওপর সরকারকে নির্ভর করতে হচ্ছে। আর্থিক খাতের এই ছবি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, সরকারি খাত অনেকটা ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে বাস্তব অবস্থা মোকাবেলায় সরকারকে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

আমরা ভুলেই গেছি, ট্যাক্সের ওপর নির্ভর করা ছাড়া বাজেট প্রণয়ন করা যায় না। হ্যাঁ, বিশ্বের অনেক দেশেই একমাত্র কর আয়ের ওপর নির্ভর করে বাজেট প্রণীত হয়। আমাদের দেশেও রাজস্ব আয়ের ওপর ভিত্তি করেই বাজেট হয়। বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে পারিনি বলে ঘাটতি বাজেটের একটি বাড়তি চাপ থেকে যায় মাথার উপর। সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। সেই অতিরিক্ত চাপ মোকাবিলার উপায় নেই, এ-কথা বলা মোটেও ঠিক নয়। এর একটি সহজ পথ হতে পারে, বিদেশি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশি বিনিয়োগের সামান্য শেয়ার অনুযায়ী সরকার মূলধন জোগান দিতে পারে।

লাইসেন্স দেয়ার সময় ১০ শতাংশ শেয়ারের মূলধন সরকার জোগান দিয়ে তার অংশিদারিত্ব নিশ্চিত করতে পারে। তাতে সুবিধা হলো ভালো অংকের মুনাফা আয় করা সহজ হয়। নীতি-নির্ধারকরা বিষয়টি জানেন না, এটা ভাববার কোনো কারণ নেই। সচেতন মানুষমাত্রই জানেন, লাভ বেশি হয় মালিকানার একটা অংশ হাতে থাকলে।

আজ আমরা ট্যাক্স-নির্ভর বাজেট প্রণয়ন করি। সঙ্গত কারণেই মেগা প্রজেক্টে অর্থায়নের জন্য আমাদের হরহামেশাই অর্থ-ঘাটতিতে ভুগতে হয়। বিকল্প উৎস থেকে বড় অংকের লভ্যাংশ আয়ের সুযোগ থাকলে বড় বড় প্রজেক্টে অর্থায়নের জন্য কোনো অভাব বা সমস্যা দেখা দিত না। অর্থায়নের পদ্ধতিগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের স্বচ্ছ জ্ঞানের অভাব রয়েছে এ-কথা মানতে আমরা রাজি নই। ইচ্ছেশক্তি আর সততা থাকলে, দেশকে ভালোবাসলে এবং জবাবদিহির আওতায় থেকে দায়িত্ব পালন করলে নতুন সেই পথ অবশ্যই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তার জন্য চাই উদ্যোগ আর আগ্রহ। আমরা কাজের ক্ষেত্রে অর্থাৎ বাস্তবে সেই চেষ্টা দেখতে পাই না। অথচ এরকম উৎস থেকে সরকার তার আয় অনেক বেশি বাড়াতে পারে।

আমাদের কারো অজানা নয়, দেশে আশানুরূপ না-হলেও বিদেশি বাণিজ্যিক বিনিয়োগ কিছু-না-কিছু আসছেই। এই বাণিজ্যিক বিনিয়োগ আসার মূল কারণ শিল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের এখানে শ্রমের দাম অনেক কম, পানির মতো সস্তা আর কি! তাই অধিক মুনাফার আশায় শিল্পোন্নত দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে।

এসব ক্ষেত্রে সরকার দেশের স্বার্থে মোট মূলধনের কমপক্ষে ১০ শতাংশ অংশীদার হতে পারে। তার জন্য আইন তৈরি করে নিলেই হয়। সেই বিনিয়োগকৃত মূলধনের মালিকানাসূত্রে বছর শেষে মুনাফার অংশ কিন্তু একদম কম হবে না, সেখানে খুব ভালো অংকের লভ্যাংশ পাওয়া যাবে। তাতে রাষ্ট্রই হবে বেশি লাভবান। কিন্তু এপথে হাঁটা তো দূরের কথা, চিন্তা করে দেখবার সদিচ্ছাও যেন নেই কারো।

সে যাই হোক, আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য ‘ভিশন’-৪১। হাতে আছে ২১ বছর। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশ করতে হবে। সে লক্ষ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম থেমে নেই, চলছে জোরেশোরে পরিকল্পিতভাবে। যদি সাফল্যজনকভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব হয় তাহলে উন্নত দেশের পথে বাংলাদেশ বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু মাঝখানে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মহামারি করোনা। এই যুদ্ধে যদি আমরা জয়ী হতে পারি তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে।

এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশ করাটা সহজ হবে না। বিশেষ করে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে প্রবেশের মতো সহজ হবে না। উন্নত দেশের সোপানে প্রবেশ করতে হলে জাতিসংঘ নির্ধারিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) আগে অর্জন করতে হবে। সেই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জন্য প্রয়োজন হবে শিল্প-অবকাঠামো, অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের ব্যাপক উন্নয়ন। এ জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ছাড়াও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রথম ১২ বছরেই অতিরিক্ত ৯২৮.৪৮ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। বিপুল পরিমাণের অর্থ। অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্ব উভয় খাত থেকেই আয় করতে হবে এই টাকা। সেজন্য দেশের ভিতরে রাজস্ব আয়ের পরিধি বাড়াতে হবে, তার মানে কর আওতার মধ্যে দেশের সব শ্রেণির মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

কর-ব্যবস্থাপনার আওতায় ভারী ও মাঝারি শিল্প তো আছেই, সেখানে নিয়ে আসতে হবে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র হস্তশিল্পকেও । তাছাড়া একে সফল করে তুলতে হলে প্রয়োজন সুস্থ ধারার রাজনীতি। সরকারি ও বিরোধী উভয় দলকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে সেখানে। মনে রাখা দরকার, টাকার জন্য চাই নিরাপদ জায়গা। অনুকূল পরিবেশে সে চলাচল করতে ভালোবাসে। দেশের রাজনীতি যদি উত্তপ্ত থাকে, দলগুলো যদি সংঘাত আর হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ে তাহলে টাকা পাড়ি জমায় অন্য কোনো নিরাপদ দেশে। মুহূর্তেই দেশ থেকে বের হয়ে যাবে বিশাল অংকের টাকা। সে তার নিজ নিয়মেই খুঁজে নেবে নিরাপদ কোনো দেশ।

শেষাবধি সেখানেই গিয়ে হাজির হবে। তাই দেশে অশান্ত রাজনীতি কারো কাম্য হতে পারে না। সংঘাতের পথে না গিয়ে সরকার আর বিরোধী উভয়পক্ষকেই সমঝোতার মধ্য দিয়ে দেশে সহনশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যত্নশীল থাকতে হবে। তার মানে এই যুদ্ধ হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ।

সেখানে আমাদের প্রত্যেককেই থাকতে হবে এক একজন সফল যোদ্ধার ভূমিকায়। এসবই সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির দুরবস্থা তো আমাদের পার হতেই হবে, পাশাপাশি এগিয়ে যেতে হবে উন্নত দেশ অভিমুখে। আর সেজন্য চাই বিকল্প উৎস থেকে নিয়মিত টাকা আয়।

আমরা এখন মধ্যম আয়ের কাতারে অবস্থান করছি। এ সাফল্য নিয়ে গর্ব হয় ঠিকই, তবু ভীত হই যখন দেখি দেশের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে মধ্যম আয়ের সুফল ও স্বপ্নগুলো এখনও অধরা রয়ে গেছে। এর জন্য আমরা কাকে দুষব? কী কারণে রক্তস্রোতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশকে আমরা স্বপ্নের সমান উচ্চতায় পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছি। কে দেবেন এর উত্তর? বর্তমান প্রজন্ম এ প্রশ্নে কাউকে ছাড় দেবে ভাববার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : কবি, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর