ঢাকা শহরের বেশ কিছু সড়কে অনেকদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বাড়ি আর অফিসের যে সরল রেখা আঁকাপথ, সেই আঁকা ডিঙিয়ে যাওয়া হয় না সচরাচর। কিছুদিন অফিস ঘর থেকে বাইরে ছিলাম। আয়েশ করে শোবার বা বৈঠক ঘরে বসে সময় অপচয় করিনি। ঢাকার বিভিন্ন সড়কে ঢুঁ দিয়েছি। কাজে কিছুটা অবশ্যই। তারচেয়েও বেশি ঢাকা নাকি ঢাকনা খুলি ঊর্ধ্বমুখী এখন, এবং রং বদলে বদলে যাচ্ছে দ্রুত তাই দেখতে। বেশির ভাগ সড়কই অচেনা। গলিপথ থেকে শুরু প্রধান সড়ক, দুই ধারে বিত্তের ঊর্ধ্বগতি। চকচকে রং। কখনো কখনো চারধার অচেনা লাগে। মনে হয় চিমটি কেটে দেখি, আমি ঢাকাতেই আছি নাকি অন্য স্বপ্নের শহরে। ঢাকা এখন যতোটা না ধূলির শহর তারচেয়েও বুঝি বেশি বৈভব উড়ছে এখানে। সাকরাইনের ঘুড়ি যখন আসমানে, তখন আমি ঘুড়ি দেখি না, দেখি রক্তাক্ত দোপাট্টা। ক্ষোভে উড়ন্ত দোপাট্টা। কারণ বৈভবে টইটম্বুর যে শহর, আলোর ঝলকানিতে দিবসে রূপ নেয়া যে শহর, সেখানে এখনও গভীর অন্ধকার। যে অন্ধকার রাক্ষস হয়ে খোঁজে নারীকে। সকল পরাজয়, ব্যর্থতার দায় তুলে দেয় নারীর কাঁধে।
বড় হতে হতে একটি বিষয় লক্ষ করেছি, আমাদের এখানে নারীদের চেয়ে পুরুষেরাই অধিক নারীবাদী। এটা বাস্তবে নয়, ভনিতায়। নিজেদের নারীবাদী দাবি করে বা অমন ভান করে চলে সমাজকে বোঝানো, তিনি অগ্রসর চিন্তার মানুষ। উদারমনা। তবে আমার পর্যবেক্ষণ এবং বাস্তব উদাহরণ হলো তারা নারীবাদী চিন্তার মুখোশ পরে নারীঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন বা নারী-ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তাদের। তারা কারা? এরা নিজেদের নারীবাদী হিসেবে দাবি করেন। ঢোল পিটিয়ে জানান দেন তারা নারীবাদী। তবে এই দুই পক্ষের নারীবাদিতার দৌড় পোশাকে। কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল যাপনে। নিজেদের উচ্ছৃঙ্খল যাপনকে হালাল করতে গিয়ে তারা নারীবাদিতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। স্বস্তির বিষয় হলো দুদিকেই এদের সংখ্যা আমলে নেয়ার মতো নয়। শহর-কেন্দ্রিক তলানির নাগরিক এরা। এদের কেউ কেউ সমাজকে ব্যক্তি ও সংগঠনের তরফ থেকে নারীর নানা অধিকারের কথা বলেন। বাস্তবতা হলো ঘরে নিজেরাই তারা এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। বঞ্চিত হচ্ছেন নিজে, বঞ্চিত করছেন কন্যা, পুত্রবধূ, গৃহসহায়িকাসহ অন্য নারীদের।
এই ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো আচমকা কোনো কোনো ইস্যুতে জেগে ওঠেন। সংবেদনশীলতা দেখান। তাদের সংবেদন প্রদর্শনও কখনো কখনো এতোটাই মাত্রা হারিয়ে ফেলে যে, নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীকে অবমাননা করা, তার মুক্তচিন্তার অবনমনের প্রতিবাদে গর্জন দেখালেও তা বিতর্কের মুখে পড়ে। এই অভিজ্ঞতা নারীর প্রতি সহিংসতার একাধিক ঘটনাই আমরা দেখতে পাই।
নারীবাদী ভূমিকায় পুরুষ, মহিলা যারাই অবতীর্ণ হয়েছেন, রাজপথ কাঁপিয়েছেন, তারা একটি কাজই করতে ব্যর্থ হয়েছেন বার বার। সেটি হলো- নারীর প্রতি উত্থিত আঙুলটি নামিয়ে আনতে পারেননি। তেলের শিশি ভাঙলো কেন? আগুনে ঘর পুড়লো কেন, রাষ্ট্র খণ্ডিত হলো কেন? সব কিছুর পেছনেই কেন নারীকে দাগি হিসেবে খোঁজ করা। নারী খুন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, দায় কেন নারীরই? অপরাধীর বন্ধুর শেষ নেই। কিন্তু কোনো নারী বন্ধু থাকলেই সর্বনাশ। তাকে জাপটে ধরে পুরো সমাজ। অপরাধ, ভুল তো মানুষই করে। কিন্তু নারী করলেই গণমাধ্যমসহ সকলেই যেন মেতে ওঠে বিয়ে বাড়ির আনন্দে।
নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে শুরু করার অভ্যাস শুরু করা যায়নি। নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন এই আহ্বানগুলো পোস্টারের স্লোগান হয়েই রইল। নারীবাদ নয়, প্রয়োজন মানুষবাদিতা। পুরুষ, নারী সকলকেই মনুষ্য জমিনের সমান হিস্যে দিতে হবে। তবেই মেয়েটি কেন গেল ছেলেটির কাছে- এই প্রশ্ন উঠবে না। মানুষ মানুষের কাছে যাবে। মানুষ তাকে ভালোবাসবে, সম্মান দেবে মানুষের মতোই, এটিই প্রত্যাশিত। এই সম্পর্কে কোনো সহিংসতার সম্ভাবনা থাকতে পারে না। আমরা সেই সম্ভাবনার সমাজই তৈরি করতে চাই, ভনিতার নারীবাদ আমাদের প্রয়োজন নেই। মানুষ বলতে আমরা মানুষকেই বুঝতে চাই। তার ভুল থাকবে, সেই ভুলের দায় আধেকের ঘাড়ে তুলে দেয়াটা অমনুষ্যত্ব। আসুন নারীবাদী হওয়ার আগে মানুষবাদী হই।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী