বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাপের বিষ কারা কেনে? কারা বেচে?

  • পাভেল পার্থ   
  • ১৪ জানুয়ারি, ২০২১ ২০:২১

আর এই বিষের বাজারমূল্য নির্ধারণ হয় কীভাবে? করোনাকালে যে কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ আটক হয়েছে তা যদি সত্যি হয়, তবে এই টাকায় দেশের গরিব মানুষের ভ্যাকসিন কেনা সম্ভব। তাহলে আটককৃত এই সাপের বিষ আদতে কী?

করোনাকালে কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার করেছে র‌্যাব। ৮ জানুয়ারি ২০২১ ঢাকার রামপুরা নতুনবাগ ১নং লোহারগেট এলাকার ঘ-১ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব। এই বাড়ি থেকে ১২ পাউন্ড সাপের বিষ, ছয়টি টেস্টিং কিট, সিডি, একটি ম্যানুয়াল উদ্ধার করে র‌্যাব। বিষ পাচারচক্রের পাঁচ সদস্যকে আটক করে র‌্যাব। গণমাধ্যম জানায়, এই বিষের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। তরল ও দানাদার এই বিষগুলোর সঙ্গে যে ম্যানুয়াল পাওয়া গেছে তা থেকে অনুমান করা হয়েছে ফ্রান্স থেকে এই বিষ আনা হয়েছে। জারভর্তি বিষের গায়ে লেখা ছিল ‘মেড ইন ফ্রান্স’। গণমাধ্যমে এই বিষকে ‘সহেন্দজনক’ সাপের বিষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গণমাধ্যম জানাচ্ছে, বাংলাদেশকে সাপের বিষ চোরাচালানের একটি রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক এই সাপের বিষ উদ্ধারের নানা ছবি আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পেলাম। নানা ধরনের কাচের জারভর্তি বিষ এবং জব্দ মোবাইলের ছবি। প্রশ্ন হলো এতো সাপের বিষ কি দেশে এর আগে উদ্ধার হয়েছে? হয়তো হয়েছে কিন্তু এই করোনা মহামারিকালে এতো সাপের বিষ কোথায় চালান হচ্ছিল? কারা বেচল আর কারা কেনে এসব বিষ? কী হয় এই বিষ দিয়ে? বিশেষ করে যখন করোনা মহামারিতে স্তব্ধ হয়ে আছে পৃথিবী। এমন সংকটকালেও সাপের বিষ কাদের দরকার হয়, কারা এই বিষের বাণিজ্য সামলায়?

করোনাকালে সাপের বিষ আটক

২৪ ডিসেম্বর ২০২০। মহামারিকালের বড়দিনের আগের দিন ঢাকার দক্ষিণখানের গুলবার মুন্সিসরণি থেকে প্রায় ৯ কেজি সাপের বিষসহ ছয়জনকে আটক করে র‌্যাব। উদ্ধার হওয়া ওই বিষের বাজারমূল্য গণমাধ্যম জানায়, প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। জারভর্তি এই বিষের গায়ে লিখা ছিল ‘মেড ইন ফ্রান্স’। ২৭ নভেম্বর ২০২০, ঢাকার মিরপুরের পশ্চিম মণিপুর থেকে প্রায় তিন কোটি টাকার সাপের বিষসহ ১১ জনকে আটক করে র‌্যাব। ২৫ নভেম্বর রাতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকার সাপের বিষ ও পাচারকারী দুইজনকে আটক করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ। এই বিষের গায়েও লিখা ছিল ‘মেড ইন ফ্রান্স’। ২০২০ সালের জুনে ফেনী থেকে দুই পাউন্ড সাপের বিষসহ এক ব্যক্তিকে আটক করেছিল র‌্যাব।

সাপের বিষ চোরাচালান

কবে থেকে বাংলাদেশে সাপের বিষ চোরাচালান হচ্ছে এ বিষয়ে হাতের নাগালে কোনো নথি খুঁজে পাইনি। ২০১৫ সালে দৈনিক ভোরের কাগজ ‘অনুমোদনহীন ডজনখানেক খামার, বিদেশে পাচার হচ্ছে সাপের বিষ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ হয়েছে, দেশি-বিদেশি চক্র প্রতিবছর ১০০ কোটি টাকার গোখরা সাপের বিষ পাচার করছে। পটুয়াখালীর নন্দীপাড়া, কুড়িগ্রামের রাজিবপুর, রাজবাড়ীর কালুখালী, গাজীপুরের মণিপুর, রাজশাহীর ধর্মহাটা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, ঠাকুরগাঁও এবং ঢাকার ধারমাইয়ে সাপের খামার আছে। এসব খামার থেকে ফ্রান্সের একাধিক প্রতিষ্ঠান বিষের ক্রেতা বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে (সূত্র: ২৮/৭/২০১৫)। এই প্রতিবেদনের পাঁচ বছর পর ২০২০ সালে সাপের বিষ আটক নিয়ে প্রকাশিত বিবিসি নিউজ বাংলার একটি প্রতিবদেনে উল্লেখ হয়েছে, বছরে অন্তত একশ কোটি টাকা মূল্যের বিষ পাচার হয় এবং বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফেনী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, যশোর ও কুমিল্লায় একাধিক চক্র সাপের বিষ সংগ্রহ ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশের ধারণা (সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা, ২৫/১২/২০২০)। ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রায় ১২ কোটি টাকার সাপের বিষ আটক করা হয়। ২০১৭ সালে ঢাকা থেকে ১২ পাউন্ড ওজনের প্রায় ৬৮ কোটি টাকার সাপের বিষ আটক করেছিল পুলিশ। ২০১৭ সালের ৮ মার্চে ঢাকার ধানমন্ডি থেকে কোবরা সাপের ১২ পাউন্ড বিষসহ এক ব্যক্তিকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকার সূত্রাপুর থেকে ১৮টি সাপের বিষের জার উদ্ধার করে পুলিশ (সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল, ১৩/৮/২০১৭)। দিনাজপুরের উপশহর থেকে ৫০ কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার করে পুলিশ (সূত্র: যমুনা টিভি, ১/৯/২০১৯)।

ভারতীয় গণমাধ্যম কেন ‘বাংলাদেশের’ নাম?

কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারতেও প্রায় সময় সাপের বিষ উদ্ধারের খবর দেখা যায় গণমাধ্যমে। ভারতীয় গণমাধ্যমে এ সম্পর্কিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভারতে আটককৃত সাপের বিষ বাংলাদেশ থেকে চোরাচালান হয়েছে বলে ঢালাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার সাপের বিষ আটক করা হয় এবং সেখানকার কর্মকর্তারা স্থানীয় গণমাধ্যমে বলেছিলেন সেগুলো বাংলাদেশ থেকে জলপাইগুড়ি গিয়েছিল (সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা, ২৫/১২/২০২০)। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের বিহারের পুর্নিয়ায় ৯০০ গ্রাম সাপের বিষসহ দুজনকে আটক করা হয় এবং সেই বিষ বাংলাদেশ থেকে বিহারে ঢোকে বলে জানায় গণমাধ্যম (সূত্র : ডয়েচেভেলে, ২৬/৩/২০১৭)। ২০২০ সালের আগস্টে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ থেকে ৬০০ গ্রাম সাপের বিষ উদ্ধার করে পুলিশ এবং দুইজনকে আটক করে। গণমাধ্যম জানায়, ওই বিষ ‘ফরাসি বুলেটপ্রুফ পাত্রে’ ছিল (সূত্র: হিন্দুস্থান টাইমস, ১/৮/২০২০)। ভারত থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বর্তমান’ পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ থেকে সড়ক পথে চোরাকারবার, সাপের বিষ পাচারের নয়া রুট হিলি সীমান্ত’ শীর্ষক একটি খবর প্রকাশিত হয় (সূত্র: দৈনিক বর্তমান, ৩/৮/২০২০)। কলকাতা টিভিতে ২০২০ সালের ৬ জুন প্রকাশিত ‘৬ কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার’ শীর্ষক খবরেও বাংলাদেশের নাম আসে। নিরপেক্ষ তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ভারতীয় অঞ্চলে ‘সাপের বিষ’ চোরাচালানের সাথে ঢালাওভাবে এভাবে বাংলাদেশের নাম প্রচারিত হওয়াটা দুঃখজনক।

‘সন্দেহজনক’ সাপের বিষ

বাংলাদেশে কোটি কোটি টাকার আটক হওয়া সাপের বিষ নিয়ে তর্ক ওঠেছে। গবেষক, বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে সাপের বিষ নিয়ে গবেষণারত বিশেষজ্ঞরা জানান, বিভিন্ন সময়ে আটককৃত সাপের বিষ পরীক্ষা করে তারা দেখেছেন সেগুলো কোনোটাই সাপের বিষ নয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সাপের বিষ নামে তরল বা দানাদার কাচের জারভর্তি যা আটক করছেন তা আদতেই সাপের বিষ কি না তা পরীক্ষার ব্যবস্থা সবখানে নেই। আটককৃত ‘সাপের বিষ’ গবেষণাগারে পরীক্ষা করে অনেক গবেষক দেখেছেন সেগুলো সাপের বিষ নয়। তাহলে কেন বারবার গণমাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ আটকের খবর আসছে? আর এই বিষের বাজারমূল্য নির্ধারণ হয় কীভাবে? করোনাকালে যে কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ আটক হয়েছে তা যদি সত্যি হয়, তবে এই টাকায় দেশের গরিব মানুষের ভ্যাকসিন কেনা সম্ভব। তাহলে আটককৃত এই সাপের বিষ আদতে কী? কোনো নতুন মাদক, যৌন উত্তেজক কোনো সামগ্রী নাকি ¯্রফে জালিয়াতি? যেমন একটা সময় সীমানা পিলার আর রাম-সীতার ধাতব মুদ্রা নিয়ে গ্রামগঞ্জে মানুষ খুনোখুনির পর্যায়ে গেছিল। কষ্টিপাথর বা তক্ষক চোরাচালান নিয়ে যেমন এখনও আছে।

মেড ইন ফ্রান্স

আটককৃত সাপের বিষের ছবি কারুকাজ করা জারে বাংলাদেশ ও ভারতের গণমাধ্যম বারবার প্রকাশিত হচ্ছে। এসব জারের গায়ে রেড ড্রাগন কোম্পানি, কোবরা, ¯েœক পয়জন অব ফ্রান্স লেখা থাকে। আর থাকে ‘মেড ইন ফ্রান্স’। যদি এগুলো আদতেই সাপের বিষ হয়ে থাকে তবে কি আসলেই এসব ফ্রান্স থেকে আসে? ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে তো এমন জারভর্তি বিষ হাওয়া বা সমুদ্রের পানিতে ভেসে আসে না। যদি এগুলো সাপের বিষ হয়ে থাকে তবে এসব বিষ কীভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের নজর এড়ায়? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশ বাণিজ্যিকভাবে সাপের বিষ বিক্রি করে না। ফ্রান্স সাপের বিষ বিক্রি করে না। তাহলে বার বার কেন ‘মেড ইন ফ্রান্স’ লেখা থাকে? বাংলাদেশ, ভারত ও ফ্রান্সকে জড়িয়ে ‘সাপের বিষের’ এই চোরাচালান তাহলে কারা তৈরি করেছে? আইন শৃঙ্খলা বাহিনীই এই রহস্য উদঘাটন করতে পারে।

সাপের বিষ তর্কের সুরাহা হোক

সাপের বিষ দিয়ে ‘সাপে কাটা রোগী চিকিৎসার’ অ্যান্টিভেনমসহ নানা ওষুধ তৈরি হয়, গবেষণাগারে ব্যবহৃত হয়। তাহলে কোথাও কি এমন ভেজাল সাপের বিষ ব্যবহৃত হচ্ছে? সাপের বিষ আটকের এই তর্ক সামাজিকভাবে শঙ্কিত করেছে বেদে সম্প্রদায়কে। এই জালিয়াতির সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত না হয়েও গ্রামেগঞ্জে নানা কথা শুনতে হচ্ছে তাদের। সাপের বিষ বিষয়ক তর্কের দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্ত ও এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিচার হওয়া জরুরি। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ‘ভেনম রিসার্চ সেন্টার’ কাজ শুরু করেছে। যদিও দেশে সাপের বিষ কোনো ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় না। বাংলাদেশে সাপের বিষ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার ও বিক্রি বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী দ-নীয় অপরাধ। আমাদের জানা দরকার আটক হওয়া কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ আদতেই সাপের বিষ কি না? না হলে এইসব কী জিনিস? এ দিয়ে কী হয়? এইসব আসে কোথা থেকে? কারা এর ক্রেতা এবং ভোক্তা? কেন ভারতীয় গণমাধ্যমে সেখানে আটককৃত সাপের বিষের উৎস দেশ হিসেবে বার বার বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে? এসব তর্কের ফয়সালা হওয়া দরকার। সাপের বিষ নিয়ে এক জালিয়াতি বিভ্রম তৈরি করবার ভেতর দিয়ে আমরা কোনোভাবেই চাই না প্রকৃতি সাপশূন্য হোক।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক

এ বিভাগের আরো খবর