অনেক কিছুই ঠিকঠাক চলছে না। সবাই দেখছেন। কেউ কেউ বলছেন, কেউ কেউ লিখছেন। তাদের কথায় পাত্তা দিচ্ছেন না হর্তাকর্তারা। যারা সাদাকে সাদা, এবং কালোকে কালো বলছেন তাদেরকে ট্যাগ করে দেওয়া হচ্ছে- এরা সুশীল, এরা বাম, এরা রাজাকার! কিন্তু অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম, স্থপতি মোবাশ্বের, ও সুপ্রিম কোর্টর আইনজীবী জেড আই খান পান্না তো অতীতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। সুলতানা কামাল হচ্ছেন কবি সুফিয়া কামালের কন্যা এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টাও। এখন শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং তার ভাই মির্জা কাদেরের বাহাস।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান ও সাবেক মেয়রদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে সাধারণ আওয়াম জানতে পারছে উভয় তরফের শত কোটি টাকার দুর্নীতির কাহিনি। কিছু দিন আগে পরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, বিদেশে যারা টাকা পাচার করেছেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা, আর কয়েক জন আছেন রাজনীতিবিদ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাহস করে (অথবা তার স্বভাবসুলভ সরল-বোকামি ও অপরিপক্ব আধিকারিকের ভঙ্গীতে) যে তথ্য ফাঁস করেছেন,সেটি সাগরে ভাসমান বিশাল হিমবাহের দৃশ্যমান ক্ষুদ্র একটি অংশ। তবুও তাকে ধন্যবাদ, সত্য প্রকাশের জন্য। সরকারকে ধন্যবাদ, সত্য স্বীকার করে বিদেশে টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ায়।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে দুর্নীতি যে মহামারির আকার নিয়েছে; মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে; আমলা ও পুলিশ যে রাজনীতিবিদদের বেখবর করে দিয়ে রাষ্ট্রের হর্তাকর্তা হয়ে বসেছেন; লক্ষ হাজার কোটি টাকা যে খেলাপি ঋণ হয়ে গেছে; গাঙ্গেয় বদ্বীপ যে আজ ধর্ষণ-উপদ্রুত এলাকায় পরিণত হয়েছে; তার প্রতিকারের উপায় আছে কি? মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা কী অর্জন নিয়ে মানুষ ও বিশ্বের সামনে দাঁড়াব?
আমি এ কথা বলছি না যে, ১৭ কোটি মানুষের দেশে কোনো দুর্নীতি, অপরাধ, লুটপাট, ও সন্ত্রাস হবে না বা খেলাপি ঋণ বা কালো টাকা থাকবে না। কিন্তু ধর্ষণ ও গণ-ধর্ষণ যদি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়; ৭ লক্ষ হাজার কোটি টাকার বেশি যদি বিদেশে পাচার হয়ে যায়; খেলাপী ঋণের পরিমাণ যদি হয় ২ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা; কালো টাকার পরিমাণ যদি জিডিপির ৪৫ থেকে ৮৫ শতাংশ হয়, তাহলে সেটাকে কি ছোটখাট বিচ্যুতি, বিচ্ছিন্ন ঘটনা, অথবা অল্প কিছু লোকের দুর্বৃত্তপণা বলে আখ্যায়িত করা যায়?
আমি বলছি না যে, বাংলাদেশের ৫০ বছরে কোনো অর্জন নেই। অনেক বড় বড় অর্জন আছে, যেগুলো ঈর্ষণীয়, অনুসরণীয়, এবং অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো। আমাদের আরএমজি এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের একটি অর্থনৈতিক খাত; আমরা প্রতি বছর রেমিট্যান্স হতে ১২ থেকে ১৭/১৮ বিলিয়ন ডলার পাচ্ছি; আমাদের ওষুধ কোম্পানিগুলো ৯০টির অধিক দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে; আমাদের সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিমিশনে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন; ক্ষুদ্র ঋণের কারণে বাংলাদেশের একটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ডিং হয়েছে, যেটিকে ভিন্ন এক উচ্চতা দিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য; মৎস-চাষ, কৃষি, সব্জি, ও ফলমূল উৎপাদনে আমাদের সক্ষমতা অনেকে বেড়েছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘের তিনটি মানদণ্ডে - মোট গড় জাতীয় আয় (জিএনআই পার ক্যাপিটা), মানবসম্পদ সূচক, ও অর্থনৈতিক নাজুকতা সূচক সক্ষমতা প্রমাণ করে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে উন্নীত হয়েছে।
এ সকল অর্জনসমূহ বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশেকে ভিন্ন উচ্চতা দিয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে যখন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-নিরাপদ সড়ক, দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি, পুলিশি ও বিচারিক সেবার কথা চিন্তা করি, তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। যখন খেলাপি ঋণ, কালো টাকা ও বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া লক্ষ হাজার কোটি টাকার তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়, তখন সত্যিই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। একটি দেশের ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ও পুঁজির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি হয়, কিছু দুষ্ট লোক লুটপাটও করে, বিদেশে অর্থও পাচার হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ, কালো টাকা, এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থর যে পরিমাণ, সেটি আতঙ্কিত হওয়ার মতো।
উপরন্তু রয়েছে মানহীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ২০ জনের অধিক ব্যক্তির মৃত্যু, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন গতি, পুলিশ, ও বিচারিক সেবার নিম্নমান। আমাদের অর্থনৈতিক জিডিপি বাড়ছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক জিডিপি বাড়ছে না; হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে জিপিএ ৫ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে না; বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে; আগে আমরা ছিলাম দারিদ্র্যসীমার নিচে; এখন আমরা অবস্থান করছি চরিত্রসীমার নিচে! শীর্ষ থেকে গোঁড়ালি পর্যন্ত দুর্নীতি, অবাধ লুটপাট, ও ধর্ষণের মহামারি ইঙ্গিত করে যে, জিডিপির ঊর্ধ্বগতিতে রাষ্ট্রিক উন্নয়ন ও ব্যক্তির আর্থক সামর্থ্য বাড়লেও মূল্যবোধের অবক্ষয়ে আমাদের অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এদিকে সংকুচিত হচ্ছে গণতান্ত্রিক স্পেস। নির্বাচন কমিশন বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারছে না। আদর্শক রাজনীতির শূন্যতায় হেফাজতের মতো অরাজনৈতিক ও ধর্মান্ধ শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য হুমকি তৈরি করছে।
এমন এক রাষ্ট্রিক পরিস্থিতিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র মহোদয় গুলিস্তানসহ কিছু জায়গায় অবৈধভাবে প্রদত্ত দোকান এবং স্থাপনা উচ্ছেদ করা শুরু করেন। বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও ব্যবসায়ীরা সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করেন। বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকার পরে সাবেক মেয়র সোচ্চার হন। গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীতে এক মানববন্ধনে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, তাপস দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শত শত কোটি টাকা তার নিজ মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তরিত করেছেন এবং শত শত কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লাভ হিসেবে গ্রহণ করছেন।
বর্তমান ও সাবেকের পাল্টাপাল্টিতে গণমাধ্যম সরগরম হয়ে ওঠে; আম-জনতা মজা লুটতে থাকে; কিন্তু অস্বস্তিতে পড়ে দলের হাই কমান্ড। দুএক দিন ধরে মনে হচ্ছে যে, ভেতরে ভেতরে একটা আপস-রফা হয়ে গেছে। তবে সাধারণ আওয়ামের লাভের লাভ যেটি হয়েছে, সেটি হচ্ছে - তারা জেনে গেছে যে, রাজনীতি ও ব্যবসা এখন সমার্থক হয়ে গেছে। যত বড় পদ তত রমরমা ব্যবসা, এবং অঢেল মুনাফা।
এদিকে প্রদিতিন মিসাইল বর্ষণ করছেন সেতু মন্ত্রীর ছোট ভাই কাদের মির্জা। দিন দুই আগে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা ব্যক্তিত্বহীনদের দিয়ে দেশে কল্যাণকর পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা আর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাহেব ছাড়া আর ভালো নেতা কে কে আছেন? হ্যাঁ, আরও কয়েকজন ভালো নেতা আছেন। ভালো নেতা না থাকলে কি চলে! তবে, ওনারা দুজন সবচেয়ে ভালো। শেখ হাসিনা দেশের জন্য যা করছেন তার তুলনা নেই, কিন্তু দুর্নীতিবাজ [হারা] ধ্বংস করে দিচ্ছে ওনার সব অর্জন। এর আগে তিনি নোয়াখালীর কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, সুষ্ঠ ু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পালাবার পথ খুঁজে পাবেন না।
একটি বড় দলে উপদল থাকে, বড় নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বও থাকে। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলের জন্য সেটি নতুন নয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও গণতান্ত্রিক এই দলটি নানা ষড়যন্ত্র, উপদলীয় কোন্দল, ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, এবং এক দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। কিন্তু গত ৫/৬ বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা, সংসদ নির্বাচন, এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সুরক্ষার বিষয়ে বড় কিছু ব্যত্যয় হয়েছে। বর্তমান ও সাবেক মেয়রের বাহাস, এবং সেতু মন্ত্রী ও তার ভাইয়ের পালটাপালটি ভেতরের নাজুক অবস্থাকে কিছুটা হলেও উন্মোচন করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে - এই ব্যত্যয়, বিচ্যুতি, ও নাজুকতা নিয়ে আমরা কি কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারব?
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়