ইংল্যান্ডের অ্যাভন নদীর তীরে স্ট্রাটফোর্ড শহরে জন্ম নেয়া উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের একটি বিখ্যাত নাটকের নাম ‘হ্যামলেট’। এই নাটকের প্রধান চরিত্র প্রিন্স হ্যামলেটের স্বগতোক্তির প্রথম লাইন হলো – ‘To be, or not to be, that is the question’। বাংলায় অনুবাদ করা যেতে পারে –‘হবে কি হবে না, সেটাই হলো প্রশ্ন’।
প্রশ্ন না করলে কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু প্রশ্ন উঠলেই ঝামেলা শুরু হয়। এখানে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিলো রিট আকারে- ‘নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার বা ম্যারিজ রেজিস্ট্রার হতে পারবে কি পারবে না’। হাইকোর্টের একটি রায় আমাদের জানিয়ে দিল- ‘সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে’ ‘নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না’। রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন– আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফিকেশনে থাকেন। মুসলিম বিয়ে হচ্ছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান হয় মসজিদে। ওই সময়ে নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারে না এবং তারা নামাজও পড়তে পারে না। সুতরাং বিয়ে যেহেতু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এস কে সাইফুজ্জামান আদালতের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে আরো জানান- ‘একজন নারী একজন মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রার হতে হলে কিছু কিছু কার্যক্রম করতে হয়। নারী হিসাবে সব জায়গায় যেতে পারবেন কি না। রাত-বিরাতে বিয়ের অনুষ্ঠান হতে পারে। সেখানে যেতে পারবেন না।’ এসব কথা আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জেনেছি।
বাংলাদেশের সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ‘মুসলিম বিয়ে’র প্রকৃত চিত্র নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এ দেশে বিয়েকে ধর্মীয়, আইনি এবং সামাজিক অনুষ্ঠান হিসাবে দেখা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্ধারকের ভূমিকায় থাকে দেশের বিধিবদ্ধ আইন। ইসলাম ধর্মমতে বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর বয়স নির্ধারণের কোনো ব্যাপার নেই। যে কোনো বয়সের নারীর (শিশু, কিশোরী, তরুণী, প্রৌঢ়া ইত্যাদি) সঙ্গেই যে কোনো বয়সের পুরুষের বিয়ে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে। আইনের দ্বারা ‘বাল্যবিয়ে’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণভাবে ১৮ বছরের কম বয়সের কোনো নারীকে বিয়ে করা বা বিয়ে দেয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে সে আইনকে সবাই গ্রহণ করে মেনে চলছে।
ধর্মীয়ভাবে মুসলমানদের বিয়েতে রেজিস্ট্রেশনের কোনো প্রয়োজন নেই। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষীর উপস্থিতিতে বর ও কনের অনুমতি নিয়ে বিয়ের দোয়া পড়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়। তবে অবশ্যই ‘মোহরানা’র ধরন ও পরিমাণ স্বাক্ষীদ্বয়ের সামনে উল্লেখ করতে হবে। এমনকি বিয়েতে বর নিজেই নিজের বিয়ে সম্পন্ন করতে পারেন। কিন্তু এরকম শুদ্ধ ধর্মীয় বিয়ে বাংলাদেশের আইন ও সমাজ কারো দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে একটি আধুনিক ধারণা।
এ দেশে আইনের দৃষ্টিতে মুসলিম বিয়ে হলো একটি ‘দেওয়ানি চুক্তি’। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর ও নারী আইন অনুযায়ী বিয়ের একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করে। সেখানে দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে সব শর্তাবলীর উল্লেখসহ চুক্তিটি সম্পন্ন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চুক্তিটিকে আইন অনুযায়ী নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন করার জন্য একজন কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন।
রাষ্ট্রকর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা হলেন নিকাহ রেজিস্ট্রার বা ম্যারিজ রেজিস্ট্রার। সাধারণ মানুষ এই কর্মকর্তাদের কাজী সাহেব বলে সম্বোধন করেন। সবাই নিকাহ রেজিস্ট্রারের অফিসকে ‘কাজী অফিস’ হিসাবে জানে। মুসলিম ঐতিহ্যে ‘কাজী’ ছিলেন বিচারক। সম্ভবত সেকালে অনেক স্থানে কাজীর সামনে অথবা তার দ্বারা বিয়ের কাজটি সম্পাদন করা হতো। সেজন্য একালে নিকাহ রেজিস্ট্রার হয়ে গিয়েছেন কাজী।
বাংলাদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিয়ে কীভাবে সম্পন্ন হয়? সাধারণভাবে প্রতিটি বিয়েতে কাবিননামা সম্পাদনসহ রেজিস্ট্রেশন হয়। প্রথমে একজন ‘উকিল’ ও দুজন সাক্ষী নিযুক্ত হন। ‘উকিল’ সামাজিকভাবে উকিলপিতা বা উকিলবাবা হিসাবে পরিচিত। তিনি বরের পক্ষ হতে মোহরানা ও অন্যান্য শর্তাদিসহ বিয়ের প্রস্তাব কনের কাছে নিয়ে যান। কনে প্রস্তাব গ্রহণ করে ‘কবুল’ বা ‘রাজি’ শব্দ শ্রুতিযোগ্য ভাবে উচ্চারণ করে ও কাবিননামায় স্বাক্ষর করে। তারপর বর, উকিল এবং সাক্ষীদ্বয় কাবিননামায় স্বাক্ষর করে। সবশেষে নিকাহ রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নিকাহ রেজিস্ট্রার এর আগেই মোহরানাসহ অন্যান্য শর্তাবলী কাবিননামায় লিখে নেন। মাঝে আরো কিছু ছোটখাটো রীতি পালিত হয়। এরপর বিয়ের দোয়া পড়ে মোনাজাত করা হয়। বিয়ের দোয়া পড়ে মোনাজাত করাকে চলতি বাংলায় ‘বিয়ে পড়ানো’ বলে। অনেক ক্ষেত্রে কাজীসাহেব নিজে বিয়ে পড়ান। আবার অনেকসময় বিয়ের মজলিসে উপস্থিত সম্মানিত আলেম বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব দ্বারা বিয়ে পড়ানো হয়। অর্থাৎ এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। মোটামুটি এই হলো এ দেশে মুসলিম বিয়ের সাধারণ রূপ।
এই প্রক্রিয়াটি কোথায় হয়ে থাকে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়ের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে কাবিননামা সম্পাদনের কাজটি হয়ে থাকে। অনেকে আগেই রেজিস্ট্রেশনের কাজটি সেরে রাখে। কিন্তু মফঃস্বলে প্রচুরসংখ্যক মানুষ বর-কনেসহ কাজী অফিসে চলে আসে। বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের পরে নিজগৃহ বা গ্রামে ফিরে গিয়ে সুবিধামতো দিনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে স্থানীয় মৌলভী, হুজুর, ইমামসাহেব বা মোল্লা বিয়ে পড়ানোর কাজটি করেন। আমাদের গ্রামের ‘মোল্লামিয়া’-কে প্রচুরসংখ্যক বিয়ে পড়াতে স্বচক্ষে দেখেছি। যদিও সেসব বিয়ের রেজিস্ট্রেশন অন্য কেউ করেছে।
আমার নিজ জেলা শহর মানিকগঞ্জে কাজী অফিসের লাগোয়া ঘরে অর্ধযুগ কাটিয়েছি। সেখানে গ্রামের মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভিড় সারাদিন লেগে থাকত। বর ও কনেসহ দুই পক্ষ চলে আসত বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করতে। ব্যাপারটি শেষ হতো সবাইকে মিষ্টি মুখ করানোর মধ্য দিয়ে, অনেকটা জমি রেজিস্ট্রেশনের মতো। স্ব-উদ্যোগে যারা বিয়ে করেন তারাও কাজী অফিসে চলে যান।
আমাদের সমাজে মসজিদে সম্পাদিত বিয়ের সংখ্যা কত? আজ থেকে আড়াই-তিন দশক আগে সাধারণত মসজিদে কোনো বিয়ে হতো না। এখনো খুব একটা হয় না। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে নতুন একটি ‘ফেরকা’র উদ্ভব ঘটেছে। যারা মসজিদে বিয়ে সম্পন্ন করতে আগ্রহী। অবশ্য এদের অনেকেই নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশনের কাজটি আগেভাগে করে নেয়। মসজিদের ভেতর রেজিস্ট্রেশন খুব কমসংখ্যক মানুষ করে থাকে। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় এদের সংখ্যা অতি নগণ্য।
নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজীসাহেব কি নিজে সমস্ত বিয়ের রেজিস্ট্রেশন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন? সব কাজী সাহেবের একাধিক সহকারী থাকে। কাজীসাহেব নিজে কোথাও যেতে না পারলে তাদের একজনকে পাঠান। সাধারণত শুক্রবার বা বন্ধের দিনে একাধিক বিয়ের অনুষ্ঠান থাকে। রাতে বা দিনে কাকে কোথায় পাঠানো হবে সেটা তিনি নির্ধারণ করেন দেন। অনেক অফিসে আবার ‘ডিউটি রোস্টার’ করা হয়। কাজী সাহেবের সহকারীকেও লোকজন কাজী বলে মানেন। সহকারী কাজী কাবিননামায় সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষরসহ প্রয়োজনীয় তথ্যাদি লিখে আনেন। কাজী সাহেব নিজে বিয়েতে উপস্থিত থাকলে তিনিও একই ধারায় কাজ করেন। পরে অফিসে এসে সেটা পরিপূর্ণ করার পর নিকাহ রেজিস্ট্রারে কাজী সাহেব স্বাক্ষর করেন।
নারীদের রাষ্ট্রীয় কোনো পদে নিয়োগে বাধা আছে কি? আমরা জানি মহানবীপত্নী হযরত আয়েশার (রা.) সেনাপতিত্বে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ করেছে। হযরত আয়েশা উটের উপর আসীন ছিলেন বলে ইতিহাসে সেটা ‘উটের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশে নারীরা বিভিন্ন পদে নিয়োগ পাচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা দায়িত্বপালন করছেন।
পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ ২৪ ঘণ্টা কর্মরত থাকতে হয় এমন পদে/বিভাগে নারীরা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর একাধিক দেশের মসজিদে নারীরা ইমাম হিসাবে নিযুক্তি পেয়েছে। তারা নামাজের জামাতে ইমামতি করছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র সময়ে হযরত আয়েশা (রা.) ও উম্মে সালেমা (রা.) নারীদের ইমামতি করতেন। ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফিকেশনের বিষয়টি তাদের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়নি।
হঠাৎ করে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় না। এটা পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট তারিখ ও সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। গর্ভবতী নারীদের প্রসবব্যাথা যে কোনো সময় হতে পারে। রাত-বিরাতে এ রকম জরুরি প্রয়োজনে উপজেলা বা ইউনিয়ন মেডিক্যাল সাবসেন্টারের কর্মরত নারী ডাক্তার (মেডিক্যাল অফিসার) বা এফডব্লিউভি (ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর) বাড়িতে গিয়ে সে রকম রোগীকে অ্যাটেন্ড করে থাকেন। অনেক পেশা/দায়িত্বে থাকা নারীদের রাত-বিরাতে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
আমরা মনে করি মহামান্য হাইকোর্টের রায়টি পুনর্বিবেচিত হওয়া খুবই দরকার। ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংবিধানিক সমস্ত বাস্তবতা বিবেচনায় রেখেই এ রকম প্রত্যাশা করছি। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বা উপযুক্ত আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হতে পারেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আপিল করতে পারে। অথবা রিটকারী নিজেই আপিল করতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় সরকার নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করলে। প্রক্রিয়া যেটাই হোক, আমাদের চাওয়া নারী তার অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হোক। নারী ও পুরুষের দায় ও অধিকারের সমতা প্রতিষ্ঠাই হলো মানবিক সমাজ নির্মাণের প্রধান শর্ত।লেখক: শিশু অধিকার,স্বাস্থ্য অধিকার ও পরিবেশ কর্মী।