১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি আব্বা আমাকে আর আম্মাকে নিয়ে খুব সকাল সকাল রওনা হলেন তেজগাঁওতে একটি বাসার উদ্দেশে। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসছেন, তার বন্দিজীবন শেষে। বাঙালির কাছে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে।
আব্বা শুধু বলতেন, বঙ্গবন্ধু যেন স্বাধীন বাংলাদেশে সুস্থ শরীরে ফিরে আসতে পারেন। এটাই ছিল আব্বার এবং এদেশের অসংখ্য মানুষের একমাত্র প্রার্থনা।
সবাই ভয় পাচ্ছিল, পরাজিত পাকিস্তানিরা কোনো শয়তানি করে কিনা। কারণ বিজয়ের আর কটা দিন দেরি হলেই বঙ্গবন্ধুকে ওরা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিত। এরকমই নাকি গোপন পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়াতে এই পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল। অবশ্য সেদিন আমরা জানতাম না ওরা না করলেও ওদের প্রেতাত্মারা ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েই ছাড়বে।
আমরা প্রায় হেঁটেই সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম তেজগাঁও রোড বা পুরনো বিমানবন্দর সড়কের পাশের সেই দোতলা বাড়িতে। আমরা যাওয়ার আগেই বেশ কিছু মানুষ দোতলার বারান্দায় অবস্থান নিয়েছেন। কোনোভাবে সেখানে জায়গা করে নিলাম। আব্বা আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন, যেন আমি ঠিকমতো দেখতে পারি।
ভূতের গলি থেকে আসার পথে সম্ভবত আনন্দ সিনেমা হল বা আরও আগে পর্যন্ত আমরা রিকশায় আসতে পেরেছিলাম। এরপর আর রিকশা এগুতে পারেনি। আমরা নেমে হেঁটে এসেছিলাম এই বাসায়।
সেদিন খুব শীত ছিল। এই শীতেও আব্বা আর আম্মা ঘেমে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাও একটুও ক্লান্ত মনে হয়নি তাদের। আম্মা একটা ব্যাগে করে নিয়েছিলেন পাউরুটি, বিস্কুট, পানি আর কলা। কারণ কেউই ঠিকমতো জানত না, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কখন প্লেনটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামবে।
রাস্তার দুপাশে সেই ভোরেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অগণিত মানুষ। যাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল তেজোদীপ্ত সেই শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। এত মানুষ একসাথে রাস্তায় আমি কখনো দেখিনি। প্রায় সবার হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত সাদাকালো পোস্টার। আব্বা আমাকেও একটা ছোট পতাকা কিনে দিয়েছিলেন। অনেকেই গলা ছেড়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইছিল। আমিও ওদের দেখাদেখি পতাকা ওড়াতে ওড়াতে আব্বা আম্মার সাথে হেঁটেছিলাম। অনেকেই আমাকে দেখে হাত নেড়েছিল, কারণ সাত বছরের এক শিশু পতাকা হাতে নিয়ে এই ভোরে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যাচ্ছে, ওদেরই মতো।
এখন বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে নানা উৎসব, উদযাপন দেখে ভাবি, সেদিন সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সাদামাটা মানুষগুলোর মধ্যে যে প্রাণ ছিল, আজকাল অনেক জাঁকজমক, কোলাহল থাকলেও প্রাণটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আর তাই বঙ্গবন্ধুকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হয়।
আমি তখনও স্বাধীনতা, স্বদেশ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এত কিছু বুঝতাম না। শুধু বুঝেছিলাম, আমরা যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের হটিয়েছি, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন আর বঙ্গবন্ধুই আমাদের নেতা, যিনি এই যুদ্ধে আমাদের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তাকে পাকিস্তানিরা বন্দি করে রেখেছিল। আজকে আমাদের নেতা দেশে ফিরে আসবেন।
দুপুরের দিকে বঙ্গবন্ধুর বিমান দেশের মাটি স্পর্শ করল। পরে জেনেছি, তখন ঘড়িতে সময় ছিল দুপুর সোয়া একটা। এর আগে যখন বিমানটি নেতাকে নিয়ে আকাশে চক্কর দিচ্ছিল, তখন চারিদিকে হই-চই যেন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। রাস্তায় দাঁড়ানো অগণিত মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘ওই যে’, ‘ওই যে’ করে চিৎকার দিচ্ছিল।
এমনকি সেই বারান্দায় থাকা লোকজনের সাথে আব্বাও আকাশের দিকে তাকিয়ে বিমানটি দেখছিল। সবার চোখে মুখে তুমুল উত্তেজনা। আব্বা আমাকে বলেছিলেন, ‘মা, ওই যে ওই প্লেনে আমাদের বঙ্গবন্ধু আছেন।’
আমি তো তখন তেমন করে প্লেন দেখিনি, শুধু যুদ্ধবিমানের কানফাটা শব্দ আর বোমা ফেলার শব্দ চিনেছিলাম। আর আজ সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি প্লেন এসেছে। এটাও আমার কাছে খুব মনে রাখার মতো একটা বিষয় ছিল।
দোতলা থেকে নিচে তাকিয়ে মনে হল যেন জনসমুদ্র। কীভাবে এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়িটি এগুবে? এর অনেক পরে দেখলাম, একটি খোলা ট্রাকে বঙ্গবন্ধু, তাকে ঘিরে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধুকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেয়া হয়েছে। চারিদিকে শ্লোগান আর জয়ধ্বনি। অনেকেই ট্রাকে ঝোলার চেষ্টা করছে। অবশ্য গাড়ি যে গতিতে এগুচ্ছিল, তাতে করে এরকম ঝুললেও কোনো ঝুঁকি ছিল না। সবাই যেন চেষ্টা করছে বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখতে।
তবে আমরা কিন্তু সেই দোতলা থেকে ঠিকই বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেয়েছিলাম। উনি সবার দিকে তাকাচ্ছিলেন, হাত নাড়ছিলেন। সেদিন ওই পথের ধারে সব বাড়ি, বাজার আর দোকান ছিল লোকে লোকারণ্য। সবার উদ্দেশ্য নেতাকে অভিবাদন জানানো।
নেতাকে নিয়ে গাড়ি চলেছে রেসকোর্স ময়দানের দিকে, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেদিন সেখানে উপস্থিত লাখ লাখ মানুষের উদ্দেশে কথা বলতে বলতে জাতির পিতা কেঁদে ফেলেছিলেন। ওনার সাথে কেঁদেছিল বাংলার মানুষ। এ কান্না ছিল বিজয়ের, আনন্দের এবং একই সাথে স্বজন হারানোর বেদনার।
ট্রাকটি চলে যাওয়ার পর আমরাও নেমে গেলাম। কিন্তু তখনও হাজার হাজার মানুষ চলেছে ট্রাকের পেছন পেছন। আব্বা বললেন, সবার গন্তব্য রেসকোর্স ময়দান। সেখানে গিয়ে তারা সদ্য কারামুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির ভাষণ শুনবে।
পথে শুধু মানুষ, কোনো বাহন নেই। আবার আমরা হেঁটেই রওনা দিলাম বাসার দিকে। অনেক দূর গিয়ে একটা রিকশা পেলাম এবং অলিগলি ঘুরে বাসায় ফিরে এলাম যখন, তখন সন্ধ্যা। শীতকালে সন্ধ্যা নামে খুব তাড়াতাড়ি।
যে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুকে দেখে জীবন সার্থক করেছিলাম, সেই বাসা সাংবাদিক শফিক রেহমানের বাবা অধ্যাপক সাইদুর রহমানের। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন।
দুঃখ শুধু একটাই, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে না মারলেও এ দেশের এক শ্রেণির ক্ষমতালোভী মানুষ তাকে ফিরে আসার মাত্র আড়াই বছর পর পরিবারশুদ্ধ হত্যা করেছে। মেরে ফেলেছে সেদিন সেই ট্রাকে থাকা এদেশের সূর্য সন্তানদের।
ওই ট্রাকে অবস্থানকারী মীরজাফর, বেঈমান খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বেই ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৭২-এর জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট, খুব অল্প দিনের ব্যবধান। এর মানে কি এটাই যে, ওই বিজয় মিছিলে দাঁড়িয়ে সেদিন খন্দকার মোশতাক ভবিষ্যতের হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন?
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন