অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্র ক্যাপিটল হিলে। প্রথা অনুযায়ী গতকাল ০৬ জানুয়ারি ২০২১, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উভয় কক্ষের সদস্যগণ প্রতিনিধি পরিষদের সভাকক্ষে ভাইস প্রেসিডেন্টের সভাপতিত্বে মিলিত হয়েছিলেন ২০২০ এর প্রেসডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয়কে অনুমোদন করতে।
এর মাঝে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ক্যাপিটল হিলে সমবেত হতে, যাতে ‘প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত বিজয়কে’ কংগ্রেস অনুমোদন করতে না পারে। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার সমর্থক বিপুল সংখ্যক দাঙ্গাবাজ সেখানে জড়ো হয়। এক পর্যায়ে তারা পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে ক্যাপিটল হিলে প্রবেশ করে এবং ব্যাপক ভাংচুর চালায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে আইন প্রণেতাদের নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে সভাকক্ষ থেকে সরিয়ে নিতে হয়। প্রায় তিন ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
ঘটনায় চার ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এবং কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মার্কিন গণতন্ত্রের এ ছিল এক চরম লজ্জার দিন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় দাঙ্গাকারীদের প্রতি তার ভালোবাসা জানিয়ে তাদের ঘরে ফিরে যেতে বলেছেন। এরপর তার টুইটার একাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
কংগ্রেসের এই অনুমোদন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রক্রিয়ার শেষ পর্ব। একটি একটি করে ৫০টি রাজ্য থেকে পাঠানো নির্বাচনি ফল এই মিলিত অধিবেশনে পাঠ করা হয় এবং কারো আপত্তি না থাকলে তা গ্রহণ করে ২৭০ এর অধিক ইলেক্টোরাল ভোট পাওয়া প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়। এটি আসলে নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা এবং সবসময় তা নিস্তরঙ্গভাবেই শেষ হয়।
কারণ নভেম্বরে নির্বাচনের পর ভোট গণনা শেষ হলেই কোন রাজ্যে কে জিতেছে তা নির্ধারিত হয়ে ফলাফল জানা হয়ে যায়। এরপর প্রতিটি রাজ্যের আইনসভা সেই ফলাফল প্রতিস্বাক্ষর করে। ইতিমধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য পরিবর্তন প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়।
এটা হলো স্বাভাবিকভাবে যা ঘটে থাকে তার বিবরণ। তবে ডনাল্ড ট্রাম্প যেমন ছিলেন মার্কিন ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী প্রেসিডেন্ট, ২০২০ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বাপরও ছিল তেমনি ব্যতিক্রমী। নির্বাচনের আগেই ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হবে বলে অভিযোগ তোলেন এবং পোস্টাল ব্যালটের বিরোধিতা করতে থাকেন।
নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হওয়ার কিছু পরই তিনি নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। গণনার শেষ পর্যায়ে ছটি রাজ্যে গণনা বন্ধ করার জন্য তিনি এবং তার সহচররা আইনি লড়াই শুরু করেন, যা অনেক ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু তার আইনজীবীরা একটি অভিযোগের পক্ষেও কোনো প্রমাণ হাজির করতে না পারায় তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
অনিয়মের কোনো তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও জনাব ট্রাম্প পরাজয় স্বীকার না করার বিষয়ে অনড় থাকেন এবং বিধিবহির্ভূত পন্থায় নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তার এ প্রয়াস অনেকটা পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। যে ২৭টি রাজ্য রিপাবলিকান শাসিত, তার গভর্নরদের তিনি ফল যাই হোক ইলেক্টোরাল কলেজে রিপাবলিকানদের মনোনীত করতে চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু কেউই এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি।
সর্বশেষ কিছু সংখ্যক রিপাবলিকান সিনেটর ও হাউজ সদস্য ছটি রাজ্যের ফলাফলের বিষয়ে যুক্ত অধিবেশনকালে আপত্তি উত্থাপন করেন। তবে অনেক রিপাবলিকান সদস্য এ ধরনের অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হতে অস্বীকৃতি জানান। জনাব ট্রাম্প ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে ‘সঠিক কাজটি’ করতে আহ্বান জানান, অর্থাৎ গণনার সময় ফলাফল পাল্টে দিতে। সংবিধানে যদিও এমন কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।
ট্রাম্প সমর্থকদের দ্বারা ক্যাপিটল হিল আক্রান্ত হওয়ার পর কিছু সিনেটর তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করেন। তারপরও দুটি রাজ্যের ফলাফল নিয়ে অর্থহীন বিতর্ক ও ভোটাভুটি হয়। সবশেষে, স্থানীয় সময় ভোর পোনে ৪টায় গণনা প্রক্রিয়া শেষ হয় এবং জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বলে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে এর আগে কখনো ঝামেলা হয়নি, তা নয়। ১৮০০ সালে, জেফারসন এবং এরন বার সমসংখ্যক ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেয়েছিলেন। পরে প্রতিনিধি পরিষদ তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে। ১৮২৪ সালে এন্ড্রু জ্যাকসন, জন কুইন্সি এডামের চেয়ে বেশি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু তা ছিল মোট ভোটের অর্ধেকের চেয়ে কম, কারণ প্রার্থী ছিল চার জন।
বিষয়টি প্রতিনিধি পরিষদে গড়ায় এবং অভিযোগ আছে যে স্পিকারের সঙ্গে যোগসাজশে এডাম জিতে যান। গৃহযুদ্ধের পর ১৮৭৬ এর নির্বাচনে গণনার শেষ পর্যায়ে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী স্যামুয়েল টিলডেনের জয়ের জন্য দরকার ছিল মাত্র একটি ভোট। কিন্তু দক্ষিণের চারটি রাজ্য তাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছিল না বিধায় নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাচ্ছিল না।
রিপাবলিকান প্রার্থী রাদারফোর্ড হেইস এই চার রাজ্যের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেন যে তিনি নির্বাচিত হলে, গৃহযুদ্ধে পরাজয়ের পর দক্ষিণের রাজ্যগুলোর উপর যেসব নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায় সেগুলো তিনি তুলে নেবেন। চুক্তির ফলে তার বিজয়ের পথ সুগম হয়। ১৯৬০ সালে জন কেনেডির বিজয় নিয়ে বিতর্ক আছে, আছে ২০০০ সালে আল গোরের বিরুদ্ধে জর্জ ডব্লিউ বুশের জয় নিয়েও।
তবে এর সবই ছিল রাজ্যগুলোর ফলাফল নির্ধারণের আগে। এবারই প্রথম যখন সব রাজ্য সরকারিভাবে তাদের ফলাফল নিশ্চিত করার পরও কোনো প্রমাণ ছাড়াই পরাজিত পক্ষ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেই গেছে। আর শেষ পর্যন্ত এই সংঘাত ন্যক্কারজনক সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার এক বার্তায় অবশেষে জানিয়েছেন যে, যদিও নির্বাচনের ফলাফল তিনি মেনে নেননি, তবুও ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।
জো বাইডেন ২০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে এ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ফিরতি নির্বাচনে দুজন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীই সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে সিনেটেও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। এর ফলে সরকার পরিচালনা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পক্ষে অনেকটা সহজ হবে।
তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সাত কোটির বেশি আমেরিকান ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। এর বড় অংশ স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণির মানুষ, যারা ট্রাম্পের অবিরাম মিথ্যায় সৃষ্ট এক কল্পিত জগতে বাস করেন। অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, ট্রাম্প সমর্থক যে দাঙ্গাবাজরা গতকাল ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রদর্শন করেছেন, এর অনুশীলন অব্যাহত থাকতে পারে তার সক্রিয় উসকানিতে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার সমর্থকদের কার্যকলাপ রিপাবলিকান পার্টির জন্যও একটি অশনি সংকেত। বস্তুত বিগত চার বছর ট্রাম্প মার্কিন রাষ্ট্র এবং রাজনীতির সব প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-কানুন সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছেন। ভোট হারানোর ভয়ে নেত্রীস্থানীয় রিপাবলিকানরা তার বিরোধিতায় সোচ্চার হননি। ক্যাপিটল হিলের ঘটনার পর রিপাবলিকান নেতৃত্বের একাংশ তাদের কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। দলকে ট্রাম্পের কবল থেকে উদ্ধার এবং সমর্থক শ্রেণিতে ভাঙন ঠেকিয়ে দল সুসংহত করতে অনেক ঘাম ঝরাতে হবে তাদের।
বিশ্বব্যাপী যাদের মার্কিন গণতন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল, বিগত চার বছরের ঘটনা প্রবাহ এবং গতকালের প্রলয়কাণ্ডে তা অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। বৈশ্বিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্ধীরা এ থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর বিশ্ববাসীর আস্থা ফিরিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব বর্তাবে ১৩ দিন পর ক্ষমতা গ্রহণকারী জো বাইডেন প্রশাসনের উপর।
মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব