সময় ও অবস্থান পালটে গেলে বিষয়ের তাৎপর্য পাল্টে যায়। সান্ত্বনা যেন শঙ্কা জাগায়। যেমন নাসির উদ্দিন হোজ্জার নিজের কাছে কথাটা ছিল সান্ত্বনা, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতে আমাদের কাছে তা যেন আতঙ্ক। সেই যে তিনি রান্না করে মাংস নিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ এক বাজপাখি ছোঁ মেরে মাংসের হাড়ি নিয়ে উধাও হয়ে গেল। হোজ্জা তখন কী করবেন? এত কষ্টে যোগার করা মাংস, তার চেয়েও বন্ধু বান্ধব নিয়ে তৃপ্তি ভরে মাংস খাবেন বলে অনেক তোয়াজ করে বউকে দিয়ে রান্না করানো সব শেষ হয়ে গেল! মাংস হারিয়ে হাত কামড়ে বা কপাল চাপড়ে কী হবে। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে আর বাজ পাখিকে অভিসম্পাত দিয়ে বললেন সেই বিখ্যাত ও কালজয়ী বাক্য। ওরে হতভাগা! মাংস নিয়ে গেলি কিন্তু রান্নার পদ্ধতি তো নিতে পারিস নাই। আবার রান্না হবে। হা হা হা! সান্ত্বনার মতো মনে হলেও এই হাসি ছিল কান্নার চেয়েও অধিক বেদনার।
বিপরীত-ক্রমে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের খবর দেখতে দেখতে চেতনা অসার হয়ে যাওয়ার উপক্রম যখন হয় তখন মাঝে মাঝে দুই একটি ঘটনায় মানুষ নড়ে চড়ে উঠে। বেশ কিছু চুনোপুঁটি ধরা পড়ে, কয়েকটা টাকি, শোল বেকায়দামত আটকে পড়ে, বড় দুই একটা রাঘব বোয়াল জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় এসব তো দেখছে মানুষ। কখনো দুই একজন দুর্বৃত্ত ধরা পড়লে বা কাউকে ধরার জন্য তোড়জোড় হলে মানুষ ভাবে ধরল বা পালাল তো একটা। কিন্তু পদ্ধতি যে থেকে গেল!
এমনই এক ঘটনা। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদারের মা লীলাবতী হালদারসহ ২৫ ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। কে এই প্রশান্ত কুমার হালদার? তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থেকে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একথা প্রায় সবাই জানে যে তিনি এখন কানাডায় আছেন।
পি কে হালদারের দখল করা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের পাঁচজন আমানতকারীর করা এক আবেদনের শুনানি নিয়ে সম্প্রতি হাই কোর্ট এই আদেশ দিয়েছেন। পাঁচ আমানতকারী কিন্তু সমাজের সাধারণ কেউ নন। তারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তারা হলেন- সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়ে ড. নাশিদ কামাল, গৃহিণী সামিয়া বিনতে মাহবুব, মো. তরিকুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মো. শওকতুর রহমান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত রাজিউল হাসান।
‘আমরা আমাদের টাকাটা ফেরত চাই’, আদালতের কাছে এমন আবেদন জানিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের মেয়ে ড. নাশিদ কামাল।
তিনি বলেছেন, ‘যতবারই আমরা আমাদের টাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছি, তারা আমাদের কোনো যথাযথ জবাব দিতে পারছে না। আমরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছি।’
প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের দখল করা প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে ৫০ লাখ টাকা আমানত রেখেছিলেন শিক্ষক ও সঙ্গীত শিল্পী নাশিদ কামাল। শুধু তিনিই নন, তার আত্মীয় স্বজনরাও টাকা রেখেছিলেন এখানে। সে কথা জানিয়ে আদালতে নাশিদ কামাল বলেন, ‘আমার চাচার বয়স ৮৪ বছর। তিনি পৌনে তিন কোটি টাকা রেখেছেন। ফুফু, তার স্বামী ও ছেলে প্রায় তিন কোটি টাকা রেখেছেন। পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে আমাদের টাকাটা ছিল। হঠাৎ করে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের দিকে যায়। এই প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে থাকায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে নির্বাচন করা হয়। বাবা সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল বেঁচে থাকতে প্রথমে তিনিই এখানে টাকা রাখেন। তাকে দেখে দেখে আমরা সবাই এখানে টাকা রাখি। আমরা যারা যারা টাকা রেখেছি, সরল বিশ্বাসে রেখেছি।
এমন আর এক ভুক্তভোগী ক্যানসারে আক্রান্ত গৃহিণী সামিয়া বিনতে মাহবুব (৩৭) তার ভোগান্তি ও কষ্টের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তিনি ও তার স্বামী দুজন মিলে এক কোটি টাকা রেখেছিলেন। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে পিপলস লিজিংয়ে টাকা রাখেন তারা, বিশ্বাসের কারণ একই, কোম্পানিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত ও নিবন্ধিত। কিছুদিন আগে ক্যানসার ধরা পড়ার পর দুই বছর ধরে চাকরি করতে পারছেন না তিনি। করোনার কারণে স্বামীরও চাকরি নেই। এখন এতটাই কষ্টে দিনযাপন করছেন যে তিনি সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সামিয়া বিনতে মাহবুব বলেন, ‘এক বছর যাবৎ আমি আমার সন্তানকে কোনো রকম মাছ–মাংস খাওয়াতে পারি না। আমাদের আয় নেই। এক কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধিত কোম্পানিতে রাখার পরে আজ আমি বিনা চিকিৎসায়। ৯ বছর বয়সী মেয়েকে একা রেখে না হয় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলাম কিন্তু আমি আমার সন্তানের কী হবে?’
অনেকেই হয়তো বলবেন, আপনি কেন এই প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে গেলেন? এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন আমানতকারীরা। তার জবাবে সামিয়া বলেন, ‘তারা তো ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নিয়ে গেছে। কেন কোনো রকম অ্যাকশন–রিঅ্যাকশন তাদের বিরুদ্ধে হবে না? আমরা আমানতকারী সরল বিশ্বাসে টাকা রেখেছি, আমরা কেন এত কষ্ট পাব। আমরা কেন এত নির্যাতিত হব?
এই প্রশ্নের জবাব ও এই সংকটের প্রতিকার কে করবে? মানুষের সরল বিশ্বাস রক্ষা করবে কে আর প্রতারকের শয়তানি বন্ধ করবে কে? রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা কি হবে, দায়বদ্ধতা শব্দটি কি শুধুই একটি ধ্বনি, এ কি কোনো অর্থ তৈরি করবে না। এই হাহাকার কিছুদিন পরপর আমরা শুনছি।
এরই মধ্যে আর একটি খবর চমক তৈরি করেছে। করোনার মধ্যেই গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসেই দশ হাজার ২২০ কোটি কালো টাকা সাদা করে ফেলেছেন ৭ হাজার ৬৫০ জন। শুধু ডিসেম্বর মাসেই চার হাজার ২৯২ জন কালো টাকা সাদা করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
করোনা, ক্যাসিনো, পিকে হালদার, পাপিয়া, সাহেদ, সাব্রিনা কত কাণ্ড আর কত নামের আলোড়নের মধ্যে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ হাত ছাড়া করতে চান নি তারা।
এবারের মতো এমন ঢালাও সুযোগ আর তেমন একটা আসেনি। জমি, ফ্ল্যাট কেনা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কিংবা ব্যাংক বা নিজের কাছে নগদ টাকাও সাদা করার ঢালাও সুযোগ দেয়া হয়। ফলে বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখা টাকাও সাদা করার সুযোগ মিলেছে। কালো টাকা সাদা করলে অর্থের উৎস জানতে চাইবে না এনবিআর। এমনকি অন্য কোনো কর্তৃপক্ষও এই সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভয়ে যারা এত দিন কালোটাকা সাদা করেননি, তারা এবার এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
চলতি বছরের রিটার্ন জমা ও অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণার হিসাব দিয়ে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে এনবিআর সেখানে কালো টাকা সাদা টাকা করার সাড়াকে ‘অভূতপূর্ব হিসেবে অভিহিত করেছে এনবিআর।
তারা বলেছেন, অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে চলতি অর্থবছরে সরকার অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে বিশেষ সুযোগ দেয়। এ সুযোগে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন সম্মানিত করদাতারা। সম্মানিত ব্যক্তিদের কালো টাকা সাদা হলো দশ হাজার ২২০ কোটি, রাষ্ট্র রাজস্ব পেল ৯৩৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। মনে পড়ে বিজ্ঞাপনের ভাষা। ভালই তো, ভালো না!
সাধারণ মানুষ কোনো কিছু কিনলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেবেন, মোবাইলে কথা বলতে ৩৩ শতাংশের বেশি ট্যাক্স দেবেন, নিয়ম মেনে ব্যবসা করলে ২৫/৩০ শতাংশ ট্যাক্স দেবেন আর কালো টাকা সাদা করলে ১০ শতাংশ কর দেবেন এবং পরিষ্কার হয়ে সম্মানিত কর দাতা হবেন।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো কী? চুরি দুর্নীতি যাই করেন, ঘুষ টুস খেলেও সমস্যা নেই, আমাদের কাছে আসেন, ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। আমরা তো আছি। কিন্তু সংবিধানের কী হবে? সেখানে যে উল্লেখ আছে, অনুপার্জিত আয় ভোগ করা যাবে না। একথা শুনলে অনেকেই দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলবেন, এ রকম কত কথাই না লেখা আছে সেখানে!
এ বছর দুটি উপায়ে কালো টাকা সাদা হয়েছে। প্রথমত, ফ্ল্যাট, জমি বা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা বা নগদ টাকার ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা হয়েছে। অপরটি হলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। ফ্ল্যাট ও জমি কেনার সময় এলাকায় ও আয়তন ভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিতে হয়। নির্ধারিত ও প্রদত্ত এই দুই করের মধ্যে ফারাক একেবারে কম থাকে না।
আর নগদ টাকা, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়েও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আছে। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯-এ ধারায় এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ। টাকার ময়লা পরিষ্কার করা সম্মানিত ব্যক্তিদের যে তালিকা তাতে নগদ টাকা সাদা করার প্রবণতা বেশি বলে জানা গেছে।
পি কে’র প্রতারণা, প্রতারিতদের কান্না ও হাহাকার, সদ্য সাদা হওয়া সম্মানিত ব্যক্তিদের হাসি, কর আদায়ের সাফল্যে এনবিআর-এর আত্মতুষ্টি, কর পেয়ে রাষ্ট্রের সন্তুষ্টি সব কিছুর মধ্যে মূল্যবোধের পরাজয় কি দেখছি না? আর মাংস গেলেও রান্নার পদ্ধতি যে বহাল থাকছে, তা আমাদেরকে আতঙ্কিত করছে না?
লেখক: বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক ছাত্রনেতা