বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত নাম হলো করোনা ভ্যাকসিন। প্রতিটি দেশ উদগ্রীব হয়ে ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন ২০২১ হবে ‘ভ্যাকসিন বছর’ বা ‘ভ্যাকসিন ইয়ার’।
ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। মুনাফা, প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতি, মানবিকতা, কূটনীতির দৌড়ঝাঁপ ইত্যাদি অনেক কিছুই হচ্ছে ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে। এসব ডামাডোলের মধ্যে অনেক দেশে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ ভ্যাকসিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এ সংক্রান্ত ভালো খবরে মানুষের আশাবাদ বৃদ্ধি পায়। আবার না পাবার আশঙ্কায় তারা বিচলিত ও হতাশায় ডুবে যায়।
করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে এদেশের মানুষের আশাবাদে বাস্তবতার ছোঁয়া লাগে গত নভেম্বর মাসের ৫ তারিখে। ওইদিন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মার সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী এবং বেক্সিমকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান।
চুক্তিতে সই করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাকে প্রতিনিধিত্বকারী তিন কর্মকর্তা। সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী সিরাম ইনস্টিটিউটের নিকট থেকে বাংলাদেশ তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনবে।
আমরা জানি ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে অনুমতিপ্রাপ্ত। তিন কোটি ডোজ দিয়ে দেড় কোটি মানুষকে সুরক্ষা দেয়া যাবে। অর্থাৎ একজনকে দুটো ডোজ দিতে হবে। এই ঘটনাকে দেশবাসী স্বাগত জানায়।
গত ২৫ নভেম্বর আমরা জানতে পারি বাংলাদেশ স্বল্পমূল্যে আরও ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাবে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশসমূহকে ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য গঠিত একটি বৈশ্বিক সংস্থার মাধ্যমে আমরা এটি পাবো। আমাদের আশার পালে হাওয়া জোরদার হলো। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে অন্তত চার কোটি ৯০ লাখ মানুষকে দেয়ার মতো ভ্যাকসিন যোগাড় হয়েছে।
গত ৪ জানুয়ারি হঠাৎ করে সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যনির্বাহী সংবাদমাধ্যমকে জানায় তারা ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে পারবে না। ভারত সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ৪ জানুয়ারি ভোর থেকে দেশবাসীর মনে হতাশা ও উৎকণ্ঠার শীতল ঢেউ বয়ে যায়। প্রশ্ন ধ্বনিত হয় তাহলে আমরা কি ভ্যাকসিন পাব না?
যাই হোক একই দিনে ভ্যাকসিন পওয়ার ব্যাপারে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়। কিন্তু এ প্রসঙ্গে দায়িত্বশীলদের কথায় একধরনের অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায় ভ্যাকসিন সংক্রান্ত চুক্তিটি হলো ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি। কূটনীতির ভাষায় যাকে বলে জি টু জি চুক্তি। বেক্সিমকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বললেন এটা একটি বাণিজ্যিক চুক্তি। তারমানে যারা সম্পাদন করেছে তারা কি চুক্তিটির ধরন সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নয়?
বিষয়টি দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর ভালো লাগেনি। ঘটনা প্রবাহের মধ্যদিয়ে পরের দিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল। কিন্তু জনমনে একটি আশঙ্কার কাঁটা বিঁধে থাকল। ভ্যাকসিনের জন্য আমরা একটি উৎসের উপর নির্ভরশীল। কোনো কারণে সেখানে গড়বড় হলে আমাদের ভ্যাকসিন পাওয়া হবে না।
এ প্রসঙ্গে অনেকের মনে পুরানো স্মৃতি ফিরে আসে। গত বছরের জুলাই মাসে চীনের সিনোভ্যাকের তৈরি করা ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল করার জন্য বাংলাদেশের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়। এ ব্যাপারে প্রাথমিক অনুমোদন দিয়ে থাকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল বা বিএমআরসি। বিএমআরসি-র ন্যাশনাল রিসার্চ ইথিক্স কমিটি ট্রায়াল প্রস্তাবের সব দিক খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। অতঃপর ১৯ জুলাই সিনোভ্যাককে নৈতিক অনুমোদন বা ইথিক্যাল অ্যাপ্রুভাল দেয়া হয়। সাধারণভাবে এই অনুমোদনের পরেই ট্রায়াল শুরু হওয়ার কথা।
এদেশে ট্রায়ালের কারিগরি অংশীদার ছিল আইসিডিডিআর,বি। সাধারণত এরকম ট্রায়ালের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা থাকে না। কোনো বিতর্ক তৈরি হলে সেসব দেখার জন্য আরও উচ্চতর একাধিক বৈজ্ঞানিক কমিটি রয়েছে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় ভাবে এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাক গলায়। তারা ট্রায়াল প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়। শেষপর্যন্ত ২৭ আগস্ট ২০২০, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভ্যাকসিনটির ট্রায়ালের অনুমতি প্রদান করে। কিন্তু ইতোমধ্যে সিনোভ্যাক তাদের ফান্ড সরিয়ে নিয়ে অন্য দেশে ট্রায়াল শুরু করে দিয়েছে। তারা ট্রায়ালের জন্য বাংলাদেশের কাছে অর্থ দাবি করে। এভাবেই চীনের সিনোভ্যাকের তৈরি ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে যায়। অথচ সে ট্রায়ালটি হলে আমরা এক লাখ ১০ হাজারের মতো ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পেতাম। অন্যদিকে হ্রাসকৃত মূল্যে পওয়ার জন্য দরকষাকষির বিশাল সুযোগ তৈরি হতো।
সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটির সংরক্ষণ প্রক্রিয়া অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের মতোই সহজ। এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল সংযুক্ত আরব আমিরাতে হয়েছিল। অনুমোদিত হওয়ার পর সেদেশের জনসাধারণকে এটি দেয়া শুরু হয়েছে। দেশে ট্রায়াল হলে আমাদের জনসাধারণকে এতদিনে এই ভ্যাকসিনটি দেয়া শুরু করা যেত বলে অনেকে মনে করেন।
সিরাম ইনস্টিটিউটের তিন কোটি ভ্যাকসিন পেতে মোট ছয় মাস সময় লাগবে। অর্থাৎ প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ আসবে। একজন মানুষকে দুইটি করে ডোজ দিতে হয়। তারমানে প্রতিমাসে ২৫ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে। এভাবে চললে একবছরে তিন কোটি মানুষ ভ্যাকসিন পাবে। ভ্যাকসিনের কার্যকাল একবছর বলে ধরা হচ্ছে। একবছর পূর্বে যারা পেয়েছিল তাদেরকে একবছর পর আবার ভ্যাকসিন দিতে হবে। এভাবে চললে পুরো দেশবাসীকে কখনো ভ্যাকসিন দেয়ার কাজটি সম্পন্ন হবে না। তাহলে আরও বিপুল সংখ্যক ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে হবে।
এখন পর্যন্ত অন্য কোনো উৎস থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভবনার কোনো খবর দেশবাসী জানতে পারেনি। ভ্যাকসিন সংগ্রহের পাশাপাশি ভ্যাকসিনের সংরক্ষণ ও প্রদানের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিমাসে এক কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার সামর্থ্য আমাদের অর্জন করতে হবে। এটি হবে একটি ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। এজন্য দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। সেজন্য প্রশিক্ষণ ও মহড়া দরকার। করোনার ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য ব্রিটেনে একজন মন্ত্রীকে নিযুক্ত করা হয়েছে। ভারতে রাজ্যে রাজ্যে মহড়া শুরু হয়েছে।
আমরা শিশুদের জন্য সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে সফল হয়েছি। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা দিয়ে এত বড় ভ্যাকসিন যজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আমাদের একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি পরিকল্পনা করতে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যতটা দক্ষ, বাস্তবায়নে ততটাই অদক্ষ।
কোনো দেশের ৭০-৮০% জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন দেয়া সম্পন্ন হলেই কেবল সেই দেশটি পূর্ণ সুরক্ষার আওতায় আসে। সে হিসাবে ন্যূনতম বারো কোটি মানুষের জন্য ২৪ কোটি ডোজ সংগ্রহ করা অতি আবশ্যক।
এজন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বেশ কয়েকটি উৎস থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার চেষ্টা চালাতে হবে। দেশে এনে সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নির্বাচন করে তাদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। একটি সঠিক পরিকল্পনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার দ্বারাই কেবল এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব। এ কাজগুলো ঠিক ভাবে করা না গেলে করোনার ভ্যাকসিন কিন্তু মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে দূরে, অনেক দূরে থেকে যাবে।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; শিশু-অধিকার, স্বাস্থ্য-অধিকার ও পরিবেশ কর্মী।