বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ ব্যবধান খুব অল্প

  • হুমায়রা সুলতানা   
  • ৫ জানুয়ারি, ২০২১ ১৪:৫৯

যে কোনো নেতিবাচক অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষ খোঁজে উত্তরণের ইতিবাচক পথ। করোনা ক্রান্তিলগ্নে আমরা যখন আটকা পরে আছি ভেবে পরিত্রাণ খুঁজে বেড়াচ্ছি, সেই সময়টি হোক আমাদের জন্য আশীর্বাদ। পরিবারের ছোটজন থেকে শুরু হোক সমতা, সহানুভূতি ও অধিকারের শিক্ষা।

কোভিড-১৯ এর মধ্য দিয়ে সারাবিশ্ব পদার্পন করেছে নতুন এক অধ্যায়ে। প্রতিষেধক না আসা অবধি নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে, বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করে নিজেদের সুরক্ষিত রাখবার প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু সত্যিই কি পারছি?

কোভিড-১৯ এর বিশ্বজনীন থাবায় সারা পৃথিবী যখন বাড়িকেই নিরাপদ চিহ্নিত করে প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে না করেছে। দৈনন্দিন অফিসে হাজিরা দিয়ে কাজের পরিবর্তে ওয়ার্ক ফ্রম হোমকে প্রায়োরিটি দিয়ে মোটামোটি রেভ্যল্যুশন করে ফেলেছে, ঠিক সেই সময়- বাড়িই হয়ে উঠছে ভয়ের আশ্রয় স্থল! ভাবা যায়?

করোনার মতন এই বৈশ্বিক দুর্যোগে নিজ আশ্রয়স্থলে ভালো নেই নারী ও শিশুরা। দৈনিক সংবাদপত্র বা অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো খুললেই নজিরের অন্ত নেই। গত বছরের এপ্রিলে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের’ একটি সমীক্ষায় অংশ নেয়া সতেরো হাজার ২০৩ জন নারী ও শিশুদের মধ্যে চার ৭০৫ জন জানিয়েছেন তারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এবং তাদের অর্ধেকের জন্যই এটা ছিল প্রথমবার। গোটা চিত্র কত ভয়াবহ তা বলবার আর অপেক্ষা রাখেনা। সহিংসতার সীমা কতটা লঙ্ঘন হলে সামাজিক মাধ্যমে সেটা ছড়াবার মতন ঘটনা ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়!

লকডাউনে মানসিক স্বাস্থ্যের যে বিপর্যয় ঘটছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এমতাবস্থায়, সহিংসতায় নারী ও শিশুদের জন্য পারিবারিক সহায়তা পাওয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক বা আইনগত সহযোগিতা পাওয়াও দুরূহ হয়েছে। ফলে সহিংসতার তীব্রতা বেড়েছে বহুগুণে। অথচ, এই সময়টা আমাদের সবচেয়ে বেশি একে অন্যকে প্রয়োজন ছিল! ২০২০ এর সেপ্টেম্বর নাগাদ নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি শারীরিক হিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৭৩টি, এর মধ্যে ৬৬টির বেশি ঘটনায় আক্রান্ত নারী/কন্যা শিশুর মৃত্যু হয়েছে ও এর সিংহভাগই সংঘটিত হয়েছে তাদের স্বামী বা পরিবারের কোনো সদস্যের দ্বারা।

শারীরিক সহিংসতাকে শারীরিক আঘাত অর্থাৎ মারপিটের সংজ্ঞার মধ্যে আবদ্ধ রাখার প্রবণতা আমাদের মধ্যে বেশি। বিদ্যালয়ে সন্তানকে পাঠানোর সময় বিগত দিনগুলোতে যেমন বাবা-মা শিক্ষক-শিক্ষিকাকে বলে দিতেন, ‘হাড্ডি আমার মাংস আপনাদের’, তেমন স্ত্রীকে বাধ্য করতে শাসন হিসেবে প্রয়োজন রূপে লঘু বা গুরু শারীরিক দণ্ড দেয়াকে দোষের কাজ হিসেবে দেখা হয় না। ঠিক তেমনই, ‘চাহিবা মাত্র প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবেন’ এর মতন স্বামীর অধিকার হিসেবে বৈবাহিক ধর্ষণকেও অনুমোদন দেয়া হয়। সামাজিক ট্যাবু বা এসব কথা বলার মতন সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বিষয়গুলো নারীরা নিভৃতে বয়ে বেড়ান।

২০২০ সালে ১৪ বছরের নুরুন্নাহারের মৃত্যু আমাদের এখনও ভুলবার কথা নয়। গত বছর নভেম্বরে, ৪ সংস্থার মিলিত প্রয়াসে (বাংলাদেশ আইন ও শালিস কেন্দ্র, ব্র্যাক, নারীপক্ষ এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন) ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট উচ্চ আদালতে নারী ও তেরো বছরের ঊর্ধ্বে কিশোরীদের বৈবাহিক ধর্ষণ অনুমোদনকারী আইনসমূহ যা বৈষম্যমূলক ও তাদের মৌলিক অধিকার, সমতা, বৈষম্যহীনতা, আইনের সুরক্ষা, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারের সুরক্ষা ক্ষুণ্ণ করে, তা কেন বাতিল হবে না এবং এই আইনসমূহ বাতিল করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। ২০২০ এর নানান বিষময়তার মাঝে নিঃসন্দেহে এটি একটি আশা সঞ্চারক।

নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলো অধিকাংশ ঘটনাগুলোই ঘটে নারীর অধস্তন অবস্থার কারণে। সুষম অবস্থানই পারে এর থেকে পরিত্রাণ দিতে। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষা, এর কোন বিকল্প নেই। অথচ, শিক্ষিত নারীদেরও একই পরিণতি হচ্ছে। একটু ভালো ভাবে প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায়, অবচেতন বা চেতন উভয় ভাবে নারীরা এখনও তার থেকে উচ্চ অবস্থাসম্পন্ন পুরুষকেই জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন সামাজিক সুরক্ষা ও পারিপার্শ্বিকতার কথা ভেবে। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই নারী নতুন একটি অধিকার বলয় ও নিয়ন্ত্রণের ভিতরে ঢুকে পরে।

নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সহিংসতার ঘটনা কমিয়ে আনতে এতদিন উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মাঝে নারী ও কন্যা শিশুকেন্দ্রিক যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে, তাতে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হল নারীদের মানসিকতার পাশাপাশি পুরুষদের মানসিকতা পরিবর্তন। মেন কেয়ার এপ্রোচ বা পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন। যাতে সে ঘরে-বাইরের কোনো কাজকেই লিঙ্গীয় বৈষম্যের মাপকাঠিতে না ফেলে।

সম্প্রতি (২০১৯) ওয়ার্ল্ড ভিশনের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে যেখানে পুরুষের গৃহকর্মে অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ছাব্বিশ শতাংশ, ২০১৯ এ সেটি ছিল একাত্তর শতাংশ। মেন কেয়ার এপ্রোচের সূত্রপাত হয় পরিবার থেকে। শুধু, পুরুষ সঙ্গী বা সদস্যই নয়, শিশুদেরও এর আওতায় আনা হয় যাতে করে সে শৈশব থেকেই ইতিবাচক ও সমতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠে।

মেন কেয়ার এপ্রোচকে কেবলই উন্নয়ন সংস্থার এজেন্ডা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। বরং এটি হওয়া উচিত সার্বজনীন। অর্থাৎ, সকল পরিবারের সকল সদস্যের জন্য। কাদামাটির মতন শিশুর যখন মনন, তখন থেকেই তাকে সমতার চোখ দিয়ে দেখতে শেখানো প্রয়োজন। গৃহস্থালীর কাজে সক্রিয়ভাবে পুত্র শিশু ও কন্যা শিশু উভয়কেই অংশগ্রহণ করতে শেখানো প্রয়োজন। আবার, বাইরের কাজগুলোতেও উভয়কে সম্মক করে তোলা উচিত।

‘ছেলেরা কাঁদেনা’ বলে তার অনুভূতি ভোতা যেমন করা যাবে না, তেমনই ‘মেয়েরা ফুলের মতন কোমল’ বলে তাকেও দুর্বল করা যাবে না। দুইজনই বেড়ে উঠুক ইতিবাচক শব্দ, কর্ম ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে।

যে কোনো নেতিবাচক অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষ খোঁজে উত্তরণের ইতিবাচক পথ। করোনা ক্রান্তিলগ্নে আমরা যখন আটকা পরে আছি ভেবে পরিত্রাণ খুঁজে বেড়াচ্ছি, সেই সময়টি হোক আমাদের জন্য আশীর্বাদ। পরিবারের ছোটজন থেকে শুরু হোক সমতা, সহানুভূতি ও অধিকারের শিক্ষা।

আমার মাঝে পরিবর্তন আসলেই ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’তে যেতে সময়ের ব্যবধান খুব অল্প। আমরাই পারি পরিবারকে সত্যিকারের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে।

লেখক: ম্যানেজার, ফিল্ড কমিউনিকেশন, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

এ বিভাগের আরো খবর