বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টিকার ন্যায্য বণ্টন কি নিশ্চিত হবে?

  •    
  • ৪ জানুয়ারি, ২০২১ ১৯:০৬

তবে টিকা যখনই আসুক কিংবা যে পরিমাণ, তার ন্যায্য বণ্টন নিয়ে সন্দিহান খোদ জাতিসংঘ মহাসচিবও। ২৯ ডিসেম্বর এক ভিডিও বার্তায় সংস্থার মহাপরিচালক বলেন, ‘টিকার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। মহামারির লাগাম টেনে ধরতে টিকা বেশ আশাব্যঞ্জক। তবে ধরিত্রীকে রক্ষায় দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে ঝুঁকিতে থাকা সবার টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। যে দেশগুলোর টিকা কেনার সামর্থ্য আছে, শুধু সেখানেই টিকা দিলে হবে না।’

জনমনে এখন যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো, এভাবে মাস্ক পরে আর কতদিন? সহজ উত্তর হলো, যতদিন না পৃথিবী থেকে করোনা বিদায় নিচ্ছে। করোনা কবে বিদায় নেবে? যেদিন সবাই ভ্যাকসিন পাবে।

কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ কি ভ্যাকসিন পাবে? না। বাংলাদেশের সব মানুষ কি ভ্যাকসিন পাবে? না। তাহলে কি করোনার সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে? দেশের সবাই না হলেও, উল্লেখযোগ্য অংশের টিকা দিতে কত মাস বা বছর লাগবে? ভ্যাকসিনের ন্যায্য বণ্টন কি নিশ্চিত হবে?

যে দেশে বিধবা ভাতা পেতেও জনপ্রতিনিধিকে ঘুষ দিতে হয়; মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটও জাল হয়; যে দেশে পয়সা ছাড়া সরকারি অফিসে গিয়ে সেবা পাওয়া রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যপাার- সেই দেশে করোনার মতো একটি অতিমারির ভ্যাকসিন ন্যায্যভাবে বণ্টন হবে সেটি আশা করা কি বুদ্ধিমানের কাজ?

তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, টিকা দেয়া হয়ে গেলেই কি করোনা শেষ? যিনি ভ্যাকসিন নেবেন তিনি কি আর সংক্রমিত হওয়ার বা অন্যকে সংক্রমিত করার ঝুঁকিতে থাকবেন না?

টিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক জোট গ্যাভির কাছ থেকে পৌনে সাত কোটি টিকা জুনের মধ্যে চলে আসার কথা। তবে প্রথম দফায় পাওয়া যাবে ৫০ লাখ। এই ৫০ লাখ দিয়েই দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করা হবে। সে হিসেবে প্রথমে টিকা পাবেন দেশের ২৫ লাখ মানুষ (প্রত্যেকের দুটি ডোজ হিসেবে)। এখন প্রশ্ন হলো, এই ২৫ লাখের মধ্যে সাধারণ মানুষ কতজন থাকবেন ও বিশেষ অধিকারের তালিকায় কতজন?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরার বরাতে গণমাধ্যমের খবর বলছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যারা টিকা পাবেন, তাদের মধ্যে আছেন করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ, যাদের করোনা ঝুঁকি বেশি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও জানিয়েছেন, সীমিত পরিমাণ টিকা সবাইকে দেয়া যাবে না। ফলে কাদেরকে আগে দেয়া হবে, সেই নীতিমালা করা হচ্ছে।

কয়েক শ্রেণির মানুষ টিকা পাবেন না। যেমন গর্ভবতী নারী। কারণ, এখনও পর্যন্ত কোনো দেশে তাদের ওপর টিকা প্রয়োগ করে পরীক্ষা হয়নি। ১৮ বছরের নীচেও কাউকে করোনা টিকা দেয়া হচ্ছে না। কারণ এদের ওপরেও করোনা ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হয়নি। শিশুরাও আপাতত পাবে না। কারণ এটিও পরীক্ষিত নয়।

তবে টিকা যখনই আসুক কিংবা যে পরিমাণ, তার ন্যায্য বণ্টন নিয়ে সন্দিহান খোদ জাতিসংঘ মহাসচিবও। ২৯ ডিসেম্বর এক ভিডিও বার্তায় সংস্থার মহাপরিচালক বলেন, ‘টিকার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। মহামারির লাগাম টেনে ধরতে টিকা বেশ আশাব্যঞ্জক। তবে ধরিত্রীকে রক্ষায় দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে ঝুঁকিতে থাকা সবার টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। যে দেশগুলোর টিকা কেনার সামর্থ্য আছে, শুধু সেখানেই টিকা দিলে হবে না।’

জাতিসংঘ মহাসচিব এরকম একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন কারণ তিনি জানেন টিকার ন্যায্য বণ্টন খুব সহজ হবে না। ধনী ও প্রভাবশালীরা যে টিকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চাইবে সেই নির্মম বাস্তবতার খবর তার অজানা নয়।

ভার্চুয়াল জি-২০ সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজও এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ন্যায্য ও সহজলভ্যতার ভিত্তিতে কোভিড-১৯ এর টিকা বণ্টন নিশ্চিতে জি-২০ নেতাদের কাজ করতে হবে।’

সম্মেলনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেন, ‘আমাদের যেকোনো মূল্যে সেই দৃশ্য ঠেকাতে হবে যেখানে ধনীরা ভাইরাস থেকে সুরক্ষার সব ধরনের সুবিধা পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন অন্যদিকে আরেক দল সম্পূর্ণ বঞ্চিত হচ্ছেন।’

তার মানে টিকার ন্যায্য বণ্টন নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগে আছেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে দুর্নীতি অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। যেখানে সবকিছুই অর্থ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা নির্ণিত হয়। হাসপাতালে ভর্তি ক্ষমতাবান লোকেরা বিনা প্রয়োজনেও যেখানে অক্সিজেনের সিলিন্ডার দখল করে রাখেন সেখানে ক্ষমতাহীন মানুষের করোনার টিকা পাওয়া যে খুব সহজ হবে না, তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়।

যে ২৫ লাখ মানুষ প্রথম দফায় টিকা পাবেন, তাদের মধ্যে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষের বাইরে কারা অগ্রাধিকার পাবেন?

গণমাধ্যমকর্মীদেরও ফ্রন্টলাইন ফাইটার বা সম্মুখসারির যোদ্ধা বলে উল্লেখ করা হলেও তাদের কতজন শুরুতেই ভ্যাকসিন পাবেন তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা, সারাক্ষণ অন্যের মানবাধিকারের খবর দিতে ব্যস্ত যে পেশার মানুষের নিজেদের পেশার নিরাপত্তা বা অধিকার আদায় করতে পারেন না; বিনা নোটিশে গণহারে চাকরিচ্যুত হলেও যে পেশার মানুষেরা কার্যকর কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধে গড়ে তুলতে পারেন না, তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার ভ্যাকসিন পাবেন বা আদায় করে নেবেন, এটা ভাবাই বাহুল্য।

সাংবাদিকদের মধ্যে কিছু লোক শুরুতেই ভ্যাকসিন পাবেন, যাদের সঙ্গে সরকার সরকারি দলের নিবিড় সখ্যতা রয়েছে। পেশাদার সাংবাদিক কিন্তু দলবাজ নন, এমন সাংবাদিকরা সম্ভবত ভ্যাকসিন পাওয়ার তালিকার একেবারে নিচের দিকে থাকবেন।

জরুরি ও অগ্রাধিকারের পরে হয়তো সাড়ে তিনশো এমপি ও তাদের পরিবার, সরকারি দলের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী আমলা ও ঊর্ধতন কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার এবং ধনী ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা তালিকায় থাকবেন। অনেক ব্যবসায়ী হয়তো বিদেশে গিয়ে ভ্যাকসিন নিয়ে আসবেন। কারণ দেশে আসা ভ্যাকসিন হয়তো তাদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হবে।

২.

টিকার ন্যায্য বণ্টন হবে কি না তা নির্ভর করবে কোন প্রক্রিয়ায় টিকা দেয়া হবে, তার উপর। জানা যাচ্ছে, অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে করোনা টিকা নিশ্চিত করা হবে। এজন্য সফটওয়্যার তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। সরকার বলছে, এই নিবন্ধন তালিকা তৈরি করা হবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে। এই তালিকা অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে করা হবে না। এমনকি অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণও নেয়া হবে না। জনগণ সরাসরি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে পারবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এ নিয়ে কাজ করা হবে। নিবন্ধনের সঙ্গে এনআইডি নম্বর প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে বিধবা বা বয়স্কভাতা পান এমন তালিকাও সংগ্রহ করে দেখা হবে।

তার মানে যার নিবন্ধন থাকবে না তিনি টিকা পাবেন না। প্রশ্ন হলো, দেশের কতজন মানুষ অনলাইন নিবন্ধনে পারদর্শী? তৃণমূল পর্যায়ে হয়তো এই নিবন্ধন করা নিয়েই নানারকম ফন্দিফিকির আর ধান্দাবাজি চলবে। অনেকের কাছ থেকে পয়সা হাতিয়ে নেয়া হবে। বিশেষ করে পড়ালেখা না জানা অনেকেই প্রতারিত হবেন।

সুতরাং, যে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী এখনও শিক্ষিত নন বা শিক্ষিত হলেও ইন্টারনেট দুনিয়ার পথঘাট চেনেন না, তারা করোনার টিকা পেতে এই নিবন্ধিত হতে গিয়ে যে বিবিধ জটিলতায় পড়বেন বলে আশঙ্কা করা যায়। সেই জটিলতা নিরসনে সরকার মাঠ পর্যায়ে কী উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং সেই কাজ বাস্তবায়নে মাঠকর্মীরা কতটা আন্তরিকতা ও সততার পরিচয় দেন সেটিই বড় প্রশ্ন।

৩.

টিকা ইস্যুতে বাণিজ্যের শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকার বলছে, কোনো কোম্পানি যদি টিকা আনতে চায়, তাহলে সেখানে কিছু শর্ত থাকবে। কোন দেশ থেকে কোন কোম্পানির টিকা আনা হচ্ছে, সেই টিকার ফলাফল কী; তার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কি না; যে প্রতিষ্ঠান নিয়ে আনতে চায়, তাদের সক্ষমতা রয়েছে কি না; যাদের দেয়া হবে তার ফলোআপ করা হবে কীভাবে; এমনকি এই টিকার মূল্য কত হবে- তথ্যগুলো সরকারকে জানাতে হবে; তাহলেই কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান করোনার টিকা আনতে পারবে। এখানে যে শঙ্কাটি রয়েছে তা হলো, বেসরকারিভাবে হয়তো অনেক কোম্পানিই টিকা আনবে ও সঙ্গত কারণে তার দামও হবে অনেক বেশি। আবার বাজারে হয়তো প্রচুর নকল টিকাও ঢুকে যাবে। অসংখ্য মানুষ চড়া দাম দিয়ে সেই নকল টিকা শরীরে পুশ করবেন। হেপাটাইসিস বির টিকার ক্ষেত্রে এরকম অভিযোগ আছে।

সুতরাং ১৭ কোটি মানুষের দেশে বিরাট জনগোষ্ঠী যে টিকার বাইরেই থাকবেন, তাতে সন্দেহ কম। তাহলে বাঁচার উপায় কী? উপায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা। যতক্ষণ না করোনাকে গুডবাই বলা যাচ্ছে, ততদিন মাস্ক পরে এবং পকেটে স্যানিটাইজার নিয়েই ঘুরতে হবে। বাংলাদেশের মতো অতি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স বা শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা অসম্ভব হলেও যতটা সম্ভব স্বাস্থ্য সচেতন থাকার বিকল্প নেই। এভাবে সুরক্ষিত থাকার চেষ্টা করা এবং তারপরও করোনায় সংক্রমিত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা- আপাতত এটিই আমাদের অস্ত্র।

যিনি টিকা পাবেন তিনিও যে এরপর থেকে বিনা মাস্কে ও করোনাপূর্বকালের মতো স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ঘোরাফিরা করতে পারবেন, তা নয়। বরং যারা টিকা পাবেন, তাদেরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কারণ টিকা পেলে তিনি নিজে হয়তো সংক্রমিত হবেন না। কিন্তু তিনি সংক্রমিত কারোর সংস্পর্শে গিয়ে অন্য কাউকে সংক্রমিত করতে পারেন। ধরা যাক, হাত দিয়ে তিনি এমন কিছু স্পর্শ করলেন যেখানে করোনাভাইরাস রয়েছে। এরপর তিনি ওই হাত দিয়ে একজন সুস্থ মানুষকে স্পর্শ করলে তার সংক্রমিক হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

তার মানে টিকা পাওয়াই শেষ কথা নয়। বরং হয় পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর সব মানুষের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত হতে হবে, নয়তো প্রকৃতি যদি দয়া করে করোনার প্রকোপ কমিয়ে দেয় বা করোনা আর প্রাণঘাতি না হয়ে বরং সাধারণ সর্দি কাশিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, তাহলেই কেবল করোনাপূর্ব পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব। অন্যথায় এই মাস্ক, স্যানিটাজাইজার ও স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গেই আমাদের আরও বহুদিন বসবাস করতে হবে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

এ বিভাগের আরো খবর