করোনার কথা বাদ দিলে, বিশ্বের আর কোনো দেশে এ রকম কারফিউ টাইপ নিয়ম-কানুন জারি করে নববর্ষ পালন করা হয় কিনা, আমার জানা নেই। বাংলাদেশে কেন, কী জন্য এরকম নিয়ন্ত্রিত নববর্ষ উদযাপন করা হয়ে থাকে, এর কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ কেউ দেখাতে পারে না। দেখে মনে হয়, নববর্ষে হই-চই করে আনন্দ উদযাপনকে মোটামুটি একটা পাপ বা অপরাধের তালিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অনেকে ভাব করেন, নিউ ইয়ার পালনের মানে কী? এটা কি আমাদের কোনো উৎসব? অথচ এই আমরাই ইংরেজি (বা ব্যাকরণ মেনে বললে খ্রিষ্টীয়) সাল অনুসরণ করি, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হই, ইংরেজিতে চাকরি করি। তাহলে যে বছরটা আমরা অনুসরণ করি, সেই বছরটাকে বিদায় জানানো বা নতুন বছরকে স্বাগতম জানানোর মধ্যে অসুবিধা কোথায়?
হ্যাপি নিউ ইয়ারকে উপলক্ষ করে আমরা ১৯৭৮ সালে মদ নিষিদ্ধ করেছি, ১৯৮৮ সালে এসে মদবিহীন পার্টি করাও নিষিদ্ধ করেছি। ১৯৯৮ সালে এসে রাস্তায় নামাও বন্ধ করে দিয়েছি। ২০০৮ সালে ‘রাতে’ যে কোনো ধরনের উত্তেজনা নিষিদ্ধ করেছি এবং ২০১৮ সালে এসে ছাদও নিষিদ্ধ করেছি। এ বছরও ছাদ নিষিদ্ধ।
কেন ছাদেও উৎসব করা নিষিদ্ধ করা হলো – এর আসলেই কি কোনো জবাব আছে? সব নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে এইবার বাড়াবাড়ি রকমের আতশবাজি ফোটানো হয়েছে সারা শহরে। সব আনন্দ এক বাজি ফুটানোতেই আটকে গেছে।
মদ্যপান আমাদের দেশে নিষিদ্ধ। কাজেই নববর্ষে এটা খুলে দেয়া হবে, তা ভাবার কোনো মানে নেই। যদিও জানি যারা সুরা পান করার তারা নিয়মিতই করছেন, নিউ ইয়ার বা অন্য উৎসব বলে কোনো কথা নেই। তাছাড়া এ দেশে শুধু মুসলমানেরাই বাস করে না, আছে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ। ধর্মের দোহাই দিয়ে ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে আমরা কি পারি তাদের উৎসব নষ্ট করতে?
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে নিজের বা নিজেদের মতো করে আনন্দ করার বা উৎসব আয়োজনের কোনো অনুমতি নেই। সবই করতে হবে নিয়ন্ত্রণের আওতায় থেকে। অনেকটা ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভেজাব না’ টাইপ। আমরা আনন্দ করব, কিন্তু হাত-পা বেঁধে।
একটা টিনেজ শিশুকে যেভাবে পরিবার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আমাদের রাষ্ট্রও একই কায়দায় তার নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। রাষ্ট্র মনে করছে নাগরিকদের নিউ ইয়ার উদযাপনের অনুমতি দিলে এরা ‘টিনেজ মিউট্যান্ট, নিনজা টার্টেল’ হয়ে উঠবে। তাই দড়ি পরিয়ে দাও।
যারা নিয়ম মেনে, অন্য কোনোভাবে সরবত বা জুস পান করে বা পোলাও কোর্মা, তান্দুরি চিকেন খেয়ে, নেচে-গেয়ে একটি বছরকে বিদায় জানাতে চায় এবং নতুন বছরকে বরণ করতে চায়, সেখানে কী সমস্যা? এই দিনটিতে বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন চায় এক সঙ্গে বসে একটু হই-হই করে কাটাতে। আর কিছু না, শুধুই আনন্দ আয়োজন। যারা এভাবে বর্ষবরণ করতে চান না, তারা করবেন না। তারা যেভাবে খুশি থাকবেন। কিন্তু যারা করতে চাইছে, তাদের রাষ্ট্র বাধা দেবে কেন?
সেই বহু বছর আগে টিএসসি এলাকায় একটি মেয়েকে নাজেহাল করা হয়েছিল। এরপর থেকে প্রশাসন দফায় দফায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেই যাচ্ছে। এ ধরনের অনিভিপ্রেত ঘটনা যেন আর না ঘটতে পারে, সেজন্য কঠিন নিয়ম গ্রহণ করলেই চলত। অলিখিত কারফিউ জারি করার কোনো মানে হয় না।
প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ করে তুলেছে যে বর্ষবিদায়ের দিন নগরী জুড়ে সকাল থেকে একটা ভয় মাখানো অচলাবস্থা। এমনকী, যারা বাসায় গিয়ে রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে, তারাও নোটিশ দিয়েছে, গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা দুপুরের পর থেকে আর কোনো রক্ত পরীক্ষা করবে না। যারা চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল সহকারী এবং সাংবাদিক, তারা সকাল থেকে তাদের পরিচয়পত্র, অফিসের কার্ড নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য। কারণ শুনতে পেলাম, গত বছর কার্ড থাকা সত্ত্বেও অনেকে নানাভাবে হেনস্তা হয়েছেন। নতুন বর্ষ উদযাপনকে বাংলাদেশ হাতকড়া পরিয়ে কোন মাত্রায় নিয়ে গেছে!
এমনিতেই ২০২০ ছিল ভয়াবহ একটি বছর। করোনার ভয়, একটার পর একটা মৃত্যুর ঘটনা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বিঘ্নিত শিক্ষাজীবন, অভাব, দারিদ্র্য, চাকরিচ্যুতি, বন্দিজীবন, হোম অফিস, অনলাইন স্কুল এবং নানা ধরনের আতংক বিশ্বব্যাপী মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। চারিদিকে মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে কারণেই বিশ্বব্যাপী করোনার মধ্যেও মানুষ চেয়েছে একটু শ্বাস ফেলতে, আনন্দ করতে। সরকারগুলো সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে বলেছে সবাইকে। করোনার দ্বিতীয় দফা আগমন সত্ত্বেও বিশ্বের সব দেশ নববর্ষ উদযাপন করেছে নিজেদের মতো করে।
সেখানে আমরা, মানে বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম। করোনা থাক না থাক, আমরা টুঁটি চিপে ধরে নববর্ষ উদযাপন করি। এই মানসিকতা কেন আমাদের? কেন আমরা এতটা আনন্দবিমুখ হয়ে উঠলাম? কেন আমরা আনন্দ উপভোগ করা মানুষদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছি? আনন্দ রুদ্ধ করার জন্য কেন সমাজের নেতিবাচক মানসিকতার মানুষ ও রাষ্ট্র পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে?
এই করোনাকালে দমবন্ধ করা অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের উচিৎ ছিল কিছু নিয়ম হালকা করে দেয়া। তা না করে, উল্টো আমরা ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে চলেছি। যে যার নিজের মতো করে আনন্দ করুক, অসুবিধা কী। শুধু দেখতে হবে এই আনন্দ যেন লাগামছাড়া না হয়। এই দেশেই তো আমরা সব উৎসব পালন করতাম। এমনকী আমাদের বৈশাখ পালনের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন নিয়ম-কানুন বেঁধে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করছি। মানুষকে যতো বেশি বিনোদনবিমুখ করে ফেলা হবে, সমাজে অপরাধ ততোই বাড়বে। মানুষের হাত-পা বেঁধে তাকে নাচার জন্য ছেড়ে দেয়ার মানে কী?
আমাদের সব কিছুতেই ভয় দেখানোর প্রবণতা কেন? সারাদিন বেহেশত-দোজখ নিয়ে নানা কথা বলা হয়, পাপ-পুণ্য নিয়ে কথা বলা হয়, উচিৎ-অনুচিত নিয়ে বয়ান দেয়া হয় এবং এর সবই ভয়াবহ ভীতিকর ও বিদ্বেষপূর্ণ। একবারও বলা হয় না ভাল কাজ করুন, মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালবাসুন, অন্যকে আনন্দ দিন, নিজে আনন্দে থাকুন, জীবনকে উপভোগ করুন, আল্লাহর সৃষ্টিকে দু চোখ ভরে দেখুন। শুধু শাস্তি কী ভয়াবহ হতে পারে, দোজখে কীভাবে পুড়বেন – এই জাতীয় কথাবার্তা।
দেশজুড়ে রাতভর ওয়াজ চলবে, মানুষ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে, নারীদের নিয়ে, সমাজ ও লৌকিকতা নিয়ে যা খুশি তাই বলে যাবে, এতে কোনো বিধিনিষেধ নাই, কোনো মনিটরিং নাই। যা কিছু বিধিনিষেধ সব আনন্দ উদযাপন নিয়ে।
অবদমন এক ধরনের ভয়ংকর মানসিক ও শারীরিক চাপ তৈরি করে মানুষের উপর। যারা যতো আনন্দ করতে পারে, নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, জীবনকে উপভোগ করতে পারে, তারা অপরাধ ততো কম করে। এই যে আমাদের সমাজে একটা নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি চালু হয়েছে এবং গোপনে সবকিছুই চলছে, তাতে করে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই সমাজের শিশু ও তরুণেরা।
একথা সবাই জানে যে বুদ্ধিবৃত্তি, গবেষণা, উদ্ভাবন এবং মৌলিক চিন্তায় দক্ষিণ এশিয়া সারা দুনিয়া মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে। সেই দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে আবার আমরাই সবচেয়ে পিছিয়ে। আরও ভয়ংকর কথা হচ্ছে, দিনে দিনে এই পিছিয়ে পড়া বাড়ছে। আমার এক বন্ধু তার একটি লেখায় কথাচ্ছলে লিখেছেন যে, কিছুদিন আগে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর বিষয়ে এক পশ্চিমা গবেষক নাকি দাবি করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের মধ্যে নিয়ানডারথাল জিন প্রকটভাবে বিদ্যমান। আমার কথা হলো, সমস্যাটা স্থায়ী জিনগত হলে আমরা ক্রমেই পেছনের দিকে যেতাম না। যেহেতু আমরা পেছনের দিকে যাচ্ছি, তার মানে সমস্যাটা সাংস্কৃতিক অথবা জীবনাচরণ বা সংস্কৃতিচালিত জিন পরিবর্তন বা এপিজেনেটিক হতে পারে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা বোঝা যাবে। যেমন কোনো মা যদি সন্তান ধারণকালে ক্ষতিকর মানসিক চাপ থাকেন, বিষন্নতা বা উদ্বেগে ভোগেন, তাহলে তার শিশু শারীরিক ত্রুটির ঝুঁকি নিয়ে জন্ম নিতে পারে। তার মানে ঐ শিশুর ক্ষেত্রে এপিজেনেটিক সুইচিং ঘটতে পারে যেটা তার পুরো জীবন ও তার পরবর্তী প্রজন্মকে পাল্টে দেবে। এ বিষয়ে আরো জানার জন্য আমাদের দরকার মৌলিক জ্ঞান, অর্জনের বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা ও উদ্ভাবন।
ক্রমশই আমরা লক্ষ্য করছি, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র জ্ঞানহীন, একপেশে, আনন্দবর্জিত ও ক্ষুব্ধ সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। এইসব সিদ্ধান্ত উচ্ছ্বল তরুণদের নির্মল আনন্দ উপভোগ করার চেয়েও বেশি ভয়াবহ। কিন্তু আমাদের এই বিপরীত যাত্রা কেন? সমাজের এই নেতিবাচক চিন্তা বেশিরভাগ পরিবারে একটা জ্ঞানহীন, মেধাহীন, গোঁয়ার, ক্ষুব্ধ, লোভী, স্বার্থপর ও অপরিচ্ছন্ন মানসিক পরিবেশ তৈরি করে। সেই পরিবারে যখন একটি শিশু আসে সেই এপিজেনেটিক পরিবর্তন নিয়ে, সেটা ক্রমেই তৈরি করে বিকৃত পথে কগনিটিভ ডিজোনেন্স বা অস্বস্তিযুক্ত তরুণ সমাজ।
একটি সমাজে যখন বিচারবোধ কমে যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা তৈরি হয়, বাড়ে বিষন্নতা, বিরক্তি, অসহিষ্ণুতা, অবসাদ, আগ্রহহীনতা ও আগ্রাসী মনোভাব, তখন সেই সমাজকে আমরা ডিমেনশিয়াগ্রস্ত সমাজ বলতে পারি। নিয়মিত আনন্দ উদযাপন না করলে, শরীরচর্চা, পড়াশোনা না করলে এবং সামাজিক ও বুদ্ধিগত বিষয়ে অংশগ্রহণ বা সামাজিক চিন্তায় যথেষ্ট পরিমাণে জড়িত না থাকলে সমাজ ডিমেনশিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়তে বাধ্য। আমরা আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চাই। আনন্দের মধ্য দিয়ে দায়িত্বও পালন করে যেতে চাই। আমরা চাই না একটি ডিমেনশিয়াগ্রস্ত সমাজ ও অসুস্থ প্রজন্ম।
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন