এবারের এই নতুন বছরে প্রথম মাসেই পৃথিবীর বড় গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপ্রধান দায়িত্ব নেবেন। নতুন এই রাষ্ট্রপ্রধানের সব থেকে বড় দায়িত্ব ওই দেশের জন্যে শুধু নয়, পৃথিবীর জন্যে উজ্জ্বলতর দিন আনার কাজ করা।
দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিলেও তাকে সেজন্য অনেকগুলো কঠিন কাজ করতে হবে, যদিও বলা হচ্ছে আমেরিকার অর্থনীতি মহামন্দায় পড়তে যাচ্ছে। তাই আমেরিকার এই নতুন প্রেসিডেন্টকে তাদের ১৯৩৩ সালের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মতোই সুচিন্তিত পথে দূর করতে হবে আসন্ন মহামন্দা।
বাস্তবে ১৯৩৩ সালের পৃথিবী আর ২০২১-এর পৃথিবী এক নয়। প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন পৃথিবীর চরিত্র বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি। যে কারণে অনেকেই মনে করছেন, ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক হাব এশিয়ায় একটি সুচিন্তিত নীতি প্রয়োগ করবেন তিনি। যার ফলে দেশীয় দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে বিরোধ এড়িয়ে অর্থনীতিতে মন দেবার সময় পাবে বেশি। যার সুফলও ঘরে তুলতে পারবে আমেরিকা।
ঠিক এই একই সুফলের আশায় ২০২০-এর একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমান পৃথিবীর নতুন অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেছে। যে সময়ে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করছে, সে সময়েই এ চুক্তির পথ ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নও নতুনভাবে এশীয় অর্থনীতির সুফল ঘরে তুলতে চাচ্ছে। বিশেষ করে এশীয় অর্থনীতির এই অগ্রযাত্রা থেকে তারা দূরে থাকতে চাচ্ছে না, বা তাদের জন্যে চায়নার সঙ্গে এ সম্পর্ক প্রয়োজন।
তবে ২০২১-এ ইউরোপীয় ইউনিয়নে নতুন পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি যতই সম্পন্ন হবে, ততই ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানির প্রাধান্য বাড়বে। ইউরোপের অতীতের ইতিহাস বলে, ইউরোপে যখনই জার্মানির প্রাধান্য বেড়েছে, তখনই ইউরোপ কোনো না কোনোভাবে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে একটা সংশয় এই ২০২১-এর শুরুতেই অতি ক্ষীণও রেখার মতো হলেও মানুষের মনে আসে। তাছাড়া আজ যে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেল, এর এক ধরনের ইঙ্গিত বেশ আগেই আধুনিক সিঙ্গাপুরের নির্মাতা লি কুয়ান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে একটু আগেই গড়া হলো, এ কারণে এর ভবিষ্যত শতভাগ ভালো নাও হতে পারে। এমনকি লি কুয়ান অবশ্য বেশ স্পষ্ট করে এটার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
তারপরেও বলা যায় ২০২১-এ ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়তো এশীয় বাণিজ্য থেকে আগের চেয়ে বেশি সুযোগ নিতেই সমর্থ হবে। কারণ, অনেক কিছুই যখন শুরু হয়, তখন হয়তো ওই কাজটি করার পুরোপুরি সময় আসে না। যেমন আসিয়ান যে গড়া হয়েছে, এই আসিয়ান থেকে কি এশীয় দেশগুলো পুরোপুরি কোনো সফলতা পাচ্ছে? পাচ্ছে না। তারপরেও আসিয়ানের বেশ কয়েকটি দেশ ও এশিয়ার বাইরের তিনটি দেশ মিলে যে রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) গড়ে তুলেছে, গত বছরের শেষ দিকে তাতে চায়না ও জাপান যোগ দেয়াতে এর একটা প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়বে ২০২১-এ। আর তা যে ঘটবেই, সেটা বোঝা যায় ভারতের অবস্থান থেকে। ভারত আরসিইপিতে যোগ না দিলেও বলেছে তারা এর বাইরে নয়। বাস্তবে এই সত্য ২০২১-এ আরো সামনে এসেছে, শত বৈরিতা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে, ঐক্য নিয়েই চলতে হবে এ বছরটি জুড়ে। আর এই ঐক্যের সব থেকে বড় কারণ ২০২১ সালটি মূলত ২০২০-এর কোভিড-১৯ এর ছোবল পৃথিবীকে যেখানে নিয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। এ বছর ধরেই থাকবে পৃথিবীজুড়ে মানুষকে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন দেবার এক বিশাল কাজ। এই কাজ পৃথিবীকে ঐক্যবদ্ধভাবেই করতে হবে। এখানে ঐক্য ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সারা পৃথিবী জুড়ে এই সাত শ কোটির বেশি মানুষের জন্যে টিকা উৎপাদন, মানুষের শরীরে এই টিকা দেয়া এক বিশাল কাজ, যার সঙ্গে জড়িত বিপুল পরিমাণ অর্থ। আর এ কাজ পারস্পারিক সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। সর্বোপরি ধনী দেশগুলোকে এ কাজে প্রয়োজনে একক ফান্ড তৈরি করে এগিয়ে আসতে হবে। আবার এই টিকা যে পৃথিবীর বাণিজ্যের একটি নতুন উপাদান হবে, তাও নয়। ২০২১ সালে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ শেষ হবে না কোনো মতেই। তারপর ২০২১-এ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এই কাজ কত বেশি এগিয়ে নেয়া যায়, পৃথিবীকে সেটাই করতে হবে। কারণ টিকা দেয়ার কাজ পৃথিবীতে যত বেশি এগুবে, ততই পৃথিবী স্বাভাবিকতার দিকে যাবে। আর ততই উজ্জ্বলতর হবে দিনগুলো।
২০২১-এ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার পাশাপাশি পৃথিবীকে আরো মনোযোগের সঙ্গে তাকাতে হবে আফ্রিকার দিকে। কারণ আফ্রিকা যে সময়ে এইডসে ভুগেছে, তাদের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ মারা গেছে, সেই কয়েক দশকে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে একটা উদাসীনতা কাজ করেছে। মনে করা হয়েছে, এটা আফ্রিকার রোগ। যদিও বিজ্ঞানে কোনো তাড়াহুড়ো কাজ করে না। তাছাড়া সব মহামারির টিকা যে স্বল্প সময়ে আবিষ্কার হয়, তাও নয়। তারপরেও এইডসের টিকা আবিষ্কার না হওয়া পৃথিবীর ব্যর্থতা। তবে সে ব্যর্থতার থেকেও এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে করোনার নতুন স্ট্রেইন এখন আফ্রিকাকে আক্রমণ করছে। আফ্রিকার দেশগুলোর সাধ্য নেই এককভাবে নিজেকে রক্ষা করা। তাই এ দায় ২০২১-এ পৃথিবীকে সম্মিলিতভাবে নিতে হবে। কারণ পৃথিবীর কোনো একটি প্রান্ত অন্ধকার রেখে কখনই উজ্জ্বল দিনের আশা করা যায় না।
২০২১ সালে গোটা পৃথিবীর এই কর্মযজ্ঞের বাইরে থাকবে না পৃথিবীর ছোট বড় কোনো দেশই। কারণ সব দেশকেই এই ২০২১-এ শতভাগ চেষ্টা করতে হবে ২০২০-এর করোনার ক্ষত থেকে বের হয়ে আসার। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। বাংলাদেশে তুলনামূলক মূত্যু কম হয়েছে অন্য অনেক দেশের থেকে। অর্থনীতিও অন্য অনেক দেশের থেকে তুলনামূলক বেশি সচল ছিল। তারপরেও ২০২০-এ যা ঘটেছে, তা হলো একটি বিদ্যুতচালিত দূরন্ত গতির ট্রেনকে চলতে হয়েছে স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেনের মতো ঝিকঝিক করে। তাই ২০২১-এ বাংলাদেশের সামনে অনেক কাজ। এর ভেতর নিঃসন্দেহে বেশি গুরুত্ব পাবে করোনার টিকা আনা এবং তা মানুষকে দেয়া। ১৮ বছর বয়স অবধি কাউকে টিকা দেবার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশের জনগোষ্টির একটি বড় অংশ ১৮ বছরের নিচে। তাই আমাদের মানুষ ১৭ কোটি হলেও টিকার পরিমাণ অনেক কম লাগবে। এজন্যে এখনই সরকারের প্রয়োজন টিকা আনা ও টিকা দেয়ার জনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি দক্ষ কমিটি তৈরি করা, যারা সুচারুভাবে এ কাজ করতে পারবে। ব্যবসায়িকভাবে যারা টিকা আমদানি করবেন, তারাও যাতে ২০২১-এ যত বেশি সম্ভব আমদানি করতে পারেন, তাও সরকারকে দেখতে হবে। কারণ, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি যদি বেসরকারি উদ্যোগ কাজ করে, আর যাদের সমর্থ আছে, তারা যদি সেটা নিতে পারে, তাতে বাধা দেবার কোনো কারণ নেই। বরং সহায়তাই করতে হবে। কারণ, যত তাড়াতাড়ি দেশের ভেতর স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানো যাবে, ততই দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করা যাবে। কারণ একটা বিষয় ঘটবে ২০২১-এ, তা হলো, এই বছরটিতে অনেক কিছুই থাকবে প্রস্তুতি পর্যায়ে। কারণ এ বছরটিই হলো অস্বাভাবিকতা থেকে স্বাভাবিকতায় ফেরার প্রস্তুতির বছর। অন্ধকার থেকে উজ্জ্বলতর দিনে ফেরার বছর। এ বছর পৃথিবীর সঙ্গে শতভাগ যোগাযোগ বাড়বে না। তাই দেশের ভেতর অনেক কাজ, অনেক পরিকল্পনা নিয়েই এগুতে হবে। পাশাপাশি এশীয় বাণিজ্য থেকে, প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্য থেকেও সুযোগ নিতে হবে। সর্বোপরি সুযোগ নিতে হবে আমেরিকার এই পরিবর্তনের। বাংলাদেশ সেই সুযোগই গ্রহণ করুক। যার ভেতর দিয়ে উজ্জ্বলতর আলোর দিকে এগিয়ে যাক দেশের সকল মানুষ। ২০২১ হোক উজ্জ্বলতর আলোর বছর। আর এই বছরের প্রথম দিনে এই শুভকামনা দেশ ও সকল মানুষের জন্যে।