শার্টটি রাখা ছিল একটা সুটকেসে। মাঝে মাঝে দেখতাম। শহিদের রক্তে ভেজা একটা খদ্দরের শার্ট। লেখাটা শুরু করতে চেয়েছিলাম এভাবে- ‘আলমারিটা খুললেই চোখে পড়তো শহিদ মতিউলের রক্তে ভেজা একটা শার্ট।’ কিন্তু এভাবে লেখাটা শুরু করতে পারলাম না।
কারণ সে সময়ে, ‘৭২-৭৩ সালে আমাদের কোনো আলমারি ছিল না; কথাটা আমার স্ত্রী রুমা স্মরণ করিয়ে দিলেন। আমাদের তেমন কোনো কাপড়-চোপড় ছিল না। আমার দুটি মাত্র শার্ট ছিল। একটা অবিশ্বাস্য কম দামে কেনা টেট্টনের শার্ট। এটার সুবিধা ছিল, একটু সাবান মেখে ধুয়ে নিলেই হতো, ইস্ত্রি করা লাগত না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একটা শার্ট বানাই, সম্ভবত ১২ আনা অথবা ১৪ আনা গজের খদ্দরের কাপড়ে।
১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পর আমাদের মিছিলে গুলি হয়। আমাদের স্বাধীন দেশের পুলিশ বাহিনী বিনা উসকানিতে আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। ওই হামলায় কয়েক জন নেতাকর্মী আহত ও নিহত হন। এর মধ্যে এক জন হলেন মতিউল ইসলাম। তিনি জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়তেন। আরও একজন শহিদ হয়েছিলেন, তার নাম মির্জা কাদেরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র।
রক্তে ভেজা শার্টের কথায় আবার ফিরে যাই। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসুর যৌথ উদ্যোগে একটি মিছিল বের হয় ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধের সঙ্গে সংহতি জানানোর জন্য। তখন আমরা স্লোগান দিতাম ‘তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।’
আমি ছিলাম মিছিলের মাঝামাঝি জায়গায়। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি শুরু করল। সরাসরি বুক বরাবর পুলিশ গুলি চালাতে থাকে অবিরাম। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হঠাৎ দেখলাম, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক জন পড়ে যাচ্ছে। তাকে ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। সে ছিল আমার চেয়ে লম্বা ও স্বাস্থ্যবান। আমি তাকে রাস্তা থেকে তুলতে চেষ্টা করলাম। আমার জামা-কাপড় তার রক্তে সিক্ত হয়ে গেল। তখনও গুলি চলছিল। মনে হচ্ছিল যেন একেবারে যুদ্ধক্ষেত্র।
আমি তাকে ধরে রাস্তার কিনারায় আনতে চেষ্টা করলাম। ঠিক তখন আরও দুজন এসে আমার সঙ্গে যোগ দেয়। আমরা তিন জন তাকে একটু একটু করে টেনে আনার চেষ্টা করছি আর পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। আমরা প্রায় রাস্তার সঙ্গে মিশে তাকে আনার চেষ্টা করছিলাম। আমরা নিচু হয়ে একেক জন চলে আসছি, আবার যাচ্ছি। ক্রল করে অনেকবার চেষ্টার পর গুলিবিদ্ধ মতিউলকে প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে নিয়ে আসলাম। একাত্তরে আমরা যে ট্রেনিং নিয়েছিলাম তা আজ কাজে লাগলো।
এ সময় রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। তৎকালীন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্র নেতা মাহবুব জামান প্রেসক্লাবের সামনে যেখানে একটা বাস স্টপেজের ছাউনি ছিল, সেখানে একাই দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিচ্ছিল। তখনকার প্রেসক্লাব আজকের মতো এমন সুন্দর প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল না। প্রেসক্লাবের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া ছিল, তাও আবার খুবই জীর্ণশীর্ণ ও নিচু। প্রেসক্লাবের গেট দিয়ে ঢুকে এর ভিতরের প্রাঙ্গণ দিয়ে ওপারের আব্দুল গনি রোডে যাওয়া যেত। জঙ্গলের মতো ছিল ভেতরটা। তার মাঝ দিয়ে পায়ে হাঁটার সরু রাস্তা।
আমরা আহত মতিউলকে কখনও কোলে করে, কখনও টেনেহিঁচড়ে ওই রাস্তা দিয়ে আব্দুল গনি রোডে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তখনও মাহবুব জামান একা একা দাঁড়িয়ে অকুতোভয় শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে আবার ছাত্ররা জড়ো হতে থাকল প্রেসক্লাবের সামনে।
এদিকে দুই জন ফটোসাংবাদিক পথিমধ্যে থামিয়ে আমাদের ছবি তোলেন। যা পরদিন ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ অবজারভার ও দৈনিক পূর্বদেশের প্রথম পৃষ্ঠায় অনেক বড় করে ছাপা হয়। সেই ছবি দেখে পরে আমাদের অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা হয়। সেটা অন্য কথা।
আমরা মতিউলকে একটা রিকশায় উঠিয়ে অতিকষ্টে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখন ওখানে অনেক আহত সহযোদ্ধাদের নিয়ে আসা হয়েছিল। ইতোমধ্যে আহত বেশ কয়েক জন ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকে হাসপাতালের বেডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই দিন ডাক্তারদের তৎপরতা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। কী গভীর মমতায় আন্তরিকতার সঙ্গে অতি দ্রুততায় তারা আহত ছাত্রদের চিকিৎসা করেছেন, সেটা না দেখলে বোঝানো যাবে না। আমি এই সুযোগে ৪৮ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় সেইসব চিকিৎসক বন্ধুদের জানাচ্ছি বিপ্লবী অভিনন্দন।
ততক্ষণে মতিউল ইসলাম মারা গেছেন। তার মৃতদেহ জরুরি বিভাগে রেখেই ছুটে যাই হাসপাতালের উপরতলায়, যেখানে আহত সহযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত সহসভাপতি ছাত্র নেতা আবুল কাশেম একটি বেডে শোয়া ছিলেন।
কাছে গেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘হায়দার ভাই, আমার মাকে একটু খবর দেবেন। বলবেন, তোমার ছেলে ভালো আছে।’ সে কথা মনে হলে আজও আমার চোখ জলে ভরে যায়।
কাশেম ভাইয়ের হাতের তালুসহ আঙ্গুলে গুলি লেগেছিল। আমি কাশেম ভাইকে সান্ত্বনা দিলাম ‘আপনার কিছু হবে না, খালাম্মাকে অবশ্যই জানিয়ে দেব। আমি তখন অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। শুধু দেখে চলে আসি। কারণ আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় রক্তে ভেজা ছিল।
একটা রিকশা নিয়ে আমার গ্রিন রোডের বাসায় চলে আসলাম। এসে শার্টটা ছাড়া আর সব কাপড় বালতিতে জলে ভিজিয়ে রাখি। আমার সহযোদ্ধাদের রক্ত মিশে গেল অন্য জলে। তাদের রক্তের ঋণ এখনও আমরা শোধ করতে পারিনি।
আমার রক্তে ভেজা খদ্দরের শার্টটি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। এই শার্টটির একটু ইতিহাস আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানা কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার দেশে বানানো কাপড় পরবো। তাই কুমিল্লার খদ্দর কাপড় দিয়ে শার্ট, পাঞ্জাবি বানানো শুরু করি। আমার মাত্র দুটি শার্ট ছিল, পূর্বেই বলেছি। এই ঘটনার পর একটা শার্ট পরেই আমাকে চলতে হত। তখন খুব সম্ভবত আমার একটাই প্যান্ট থাকায় ওটাকে ধুয়ে ফেলতে হয়।
যা হোক, ঘটনার পরদিন হরতাল পালিত হয় সারা দেশে। আমার ছোট ভাই নাসির হায়দার তখন ঢাকা কলেজের তুখোড় ছাত্রনেতা। অসমসাহসী আমার ছোট ভাই নাসির হায়দার মুক্তিযুদ্ধে একজন নৌ কমান্ডো হিসেবে অংশ নিয়েছিল। পহেলা জানুয়ারির মিছিলে নাসিরও অংশ নেয়। শহিদ মির্জা কাদেরুল ইসলাম ছিল ওর ক্লাসমেট ও বন্ধু। নাসির মির্জা কাদেরের মরদেহ তার দেশের বাড়িতে নিয়ে সমাহিত করে ঢাকায় ফিরে আসে। এর পরের কয়েক দিন পুলিশের ভয়ে সে বাসায় ফিরতে পারেনি। আমার এই ছোট ভাইটা মাত্র ৩৯ বছর বয়সে প্রয়াত হয়।
আমার জীবনের অন্যতম প্রধান দুঃখ ছিল, শহিদের রক্তে ভেজা সেই শার্টটি আমি রক্ষা করতে পারিনি। কারণ এরপরও অনেকদিন পর্যন্ত আমার নতুন শার্ট বানানোর সামর্থ্য হয়ে উঠেনি। তাই মতিউলের রক্তে ভেজা আমার শার্টটি ধুয়ে আবার পরা শুরু করি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও কৃষক নেতা।