ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চলছে অনলাইনে। বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীরা আধুনিক প্রযুক্তির সুফল ভোগ করছে। এ এক বিস্ময় বটে! গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুবাদে আমিও ক্লাসে হাজির থাকি।
ক্লাসের অভিজ্ঞতা কেমন? এ প্রশ্নে এক কথায় উত্তর দারুণ উপভোগ্য। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ইন্টারনেট সুবিধায় সমস্যার কথা বলে। কারও বাসায় বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। এ জন্য অবশ্যই খারাপ লাগে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় বৈকি।
তবে তার আগে বলি ‘ছুটির মধ্যে ছুটির’ কথা। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ১০ দিন ছুটি জানাল শিক্ষার্থীরা। শীতের ছুটি এটা। প্রায় ১০ মাস আগে সেই মার্চ থেকে ক্লাস নেই। অনলাইনে ক্লাস হবে এ সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক মাস চলে গেছে। বাস্তবায়ন হতেও আরও কয়েক মাস। তারপর কি ১০ দিনের শীতকালীন ছুটি অপরিহার্য ছিল?
বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটির তালিকা দীর্ঘ। করোনা তো অনির্দিষ্টকাল ‘ছুটি’ এনে দিয়েছে। যতই আমরা ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’-এর কথা বলি, অনেকের কাছে এটা নিছকই ছুটি, উপভোগের বিষয়।
সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি জানুয়ারির (২০২১) মাঝামাঝি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মাসের পর মাস ‘সাধারণ ছুটির’ মধ্যে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাস চলছে। এ ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা সামনে এসেছে। এক, ইন্টারনেট সুবিধা সবার নেই, যাদের রয়েছে তারাও দুর্বল সংযোগের কারণে বিড়ম্বনার শিকার। দুই, ‘ক্লাসে উপস্থিতির হার’ আশাব্যঞ্জক নয়।
ক্লাস ফাঁকি নতুন কোনো বিষয় নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা হয় ভর্তির জন্য। কিন্তু সেখানেও চালু রাখতে হয়েছে ‘ক্লাস-এ হাজির না কারণে জরিমানার’ নিয়ম। অর্থনীতি বিভাগের এক অধ্যাপক করোনাকালে ভার্চুয়াল ক্লাসে অনুপস্থিতির উচ্চ হারের সমস্যার কথা বলছিলেন। অথচ এ বিভাগে সেরাদের সেরারা ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, প্রতিটি বিষয়ে ৬০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে ১০০-এর মধ্যে ১০ নম্বর কাটা পড়ে। কিন্তু তারপরেও গরহাজির ঠেকানো যায় না। অনেক বিদ্যালয়ে নিজে দেখেছি অর্ধেক বা তারও বেশি ছাত্রছাত্রী গরহাজির।
প্রকৃতপক্ষে, এ সমস্যা নতুন নয়। রাতারাতি সমাধানও মিলবে না। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবশ্যই চাই। তবে আমার বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাজির থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘শ্রেণিকক্ষকে আকর্ষণীয় করে তোলা’। করোনাকালে অনেক অসুবিধে, কিন্তু কিছু সুবিধাও রয়েছে। যেমন, আমার কিছু ক্লাস নিতে হয় বিকেলে। ছাত্রছাত্রীরা জানাল শীতের সময় বিকেলে রোদ কমে যায়। আলোর স্বল্পতায় ভিডিও চালু রাখতে সমস্যা হয়। নেটওয়ার্ক পেতে ঘরের চেয়ে বাইরে সুবিধা। উঠান বা আঙিনায় রোদ থাকলে ভালো। আমরা সিদ্ধান্ত নিই ক্লাস হবে সকালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক সময়ে এটা করা যেত না। মূল কারণ ক্লাস রুমের স্বল্পতা।
আরও সুবিধা আছে। যেমন, যানজটের কারণে সময়মতো পৌঁছাতে না পারার কথা শোনা যায় না। ভার্চুয়াল ক্লাসে যে কোনো পোশাকে ‘উপস্থিত’ থাকা যায়। যে কোনো এলাকায়, যে কেনো স্থানে বসেও ক্লাস করা যায়। বেড়াতে গেলেও সমস্যা নেই। ঘরের কাজ করতে করতেও ক্লাস করা যায়। এক ছাত্রীর কাছে শুনেছি বাড়িতে রান্নার কাজে মায়ের সঙ্গী থেকেই ক্লাসে অংশ নিয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল আলোচনায় এক ছাত্রীর ফোনে তার বাবার কণ্ঠ শুনি। তিনি বলেন, মেয়ের পাশে থেকে আমার পুরো আলোচনা শুনেছেন। আমার সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ছিল। মেয়ের ক্লাসের সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আমার সঙ্গে কিছু সময় গল্প করেন।
বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ রয়েছে বেশ ভালোভাবেই। যারা আক্রান্ত হয়ে ‘ভালো হয়ে গেছেন’, তাদের অনেকে বলছেন পোস্ট-করোনার যন্ত্রণা অসহনীয়। ঘরের বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক নির্দেশনা জারির পরও বহু নারী-পুরুষ তা উপেক্ষা করছে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ যে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, নিকটজনের জন্য এ বোধ জন্মাচ্ছে না অনেকের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করছে ‘সরকারের নির্দেশ’ উপেক্ষা করার মধ্যে বাহাদুরি আছে।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যদি ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপ্রেরণা দিতে পারেন মাস্ক পরার, দারুণ ব্যাপার হবে না? পাঁচ কোটি ছাত্রছাত্রী তাদের পরিবারকে অনুপ্রাণিত করতে পারলে এ গুরুতর সমস্যার অনেকটাই নিরসন হতে পারে।
‘সব কিছু যখন স্বাভাবিক’ তখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে সমস্যা কোথায়, এ প্রশ্ন অনেকে করছেন। মাদ্রাসাগুলোর একটি অংশ চালুর অনুমতি মিলেছে সরকারের কাছ থেকে। তাহলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কী দোষ করল?
আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদের ভূমিকা। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস ফাঁকি দিতে পারে। পড়াশোনায় গাফিলতি করতে পারে। কিন্তু শিক্ষকদের তা করার অবকাশ নেই। বাংলাদেশে এখন পাঁচ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রী। শিক্ষক সংখ্যা দশ লাখ কিংবা তারও বেশি। পাবলিক বিশ্বদ্যিালগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা মেলে সরকারি তহবিল থেকে। সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের বেতন ভাতাও দেয় সরকার। প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকরা স্বাধীনতার পর থেকেই ‘সরকারি’।
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা খুব যে আকর্ষণীয়, সেটা বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর সেরা ছাত্রছাত্রীরা যাতে বিসিএস ক্যাডার, পুলিশ অফিসার বা সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার কিংবা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরির মতোই শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হয় তেমন বেতন স্কেল কাঙ্ক্ষিত। আরও বেশি দরকার সামাজিক মর্যাদা। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি যথেষ্ট। বিপুল সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় এমন অনেককে যুক্ত করা হয়েছে, যাদের নিজেদের সামাজিক মর্যাদায় ঘাটতি প্রকট। ছাত্রছাত্রীরা তাদের সম্মান দেওয়ার মত উপযুক্ত মনে করে না। শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তাদের কাছ থেকে উপযুক্ত পরামর্শ-নির্দেশনা পায় না। দশকের পর দশক ধরেই চলছে এ অবস্থা। এ জন্য ক্ষোভ আছে অনেকের মধ্যে এবং তা অমূলক নয়।
একইসঙ্গে শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার প্রশ্নও বিবেচনায় আসা উচিত। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে দেখা যায় অনেক প্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করে না। এর দায় কে নেবে? বিদ্যালয়ে এবার ‘ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট’ নিয়ে মেধা যাচাই করা হচ্ছে। মিলছে প্রমোশনের ছাড়পত্র। শিক্ষকদের প্রত্যেকে নিরপেক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়ন করবেন, এমন ভরসা কি করা চলে? অনেকেই বলেন এ ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি আছে শিক্ষকদের মধ্যে। শিক্ষকেরা যদি নিরপেক্ষ হতে পারেন এবং যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে, তেমন নিশ্চয়তা দিতে পারেন তাহলে করোনাকালেও ‘পরীক্ষা’ নেওয়া সম্ভব। এ পরীক্ষা যার যা বাসায় বসেও হতে পারে। তবে তার চেয়েও বড় কথা পরীক্ষার জন্য শুধু নয়, জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুত করা। সেটা যথেষ্ট মাত্রায় হচ্ছে, এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারি না।
করেনাকালেও সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সবাই বেতন-ভাতা পেয়েছেন। কিন্তু তাদের সবাই কি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন? ‘ইন্টারনেট নেই’ কী করব আমরা? এমন কথা বলছেন অনেকে। কিন্তু ‘সবাই যখন ঘরের বাইরে চলাচল করছে নির্ভয়ে’, শিক্ষকেরা কি সে সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন? ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে আসে না সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে। কিন্তু শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী সবাই তো নানা স্থানে ঘুরে বেড়ায়। এ সুযোগ কি শিক্ষকরা কাজে লাগিয়েছেন?
প্রায় এক বছর ক্লাসে নেই ছাত্র-ছাত্রীরা। বহু দরিদ্র পরিবার রয়েছে, করোনাকালে যাদের আয় কমেছে কিংবা একেবারেই নেই। অনেক পরিবারের অভিভাবকেরা শিক্ষার গুরুত্বও বোঝেন না। ইন্টারনেট সুবিধা নেই। মোবাইল ফোন থাকলেও সাধারণ মানের। তারা যাতে পড়াশোনর মধ্যে থাকে, সেটা নিশ্চিত করায় শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাদের সবাই কি এ দায়িত্ব পালন করেছেন? ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের কত অংশই বা এ বিষয়ে যত্নবান ছিলেন?
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য এসব হচ্ছে ভাবনার বিষয়। প্রায় এক বছর সামান্য পড়াশোনা করে কিংবা অনেকে একেবারেই না করে ওপরের ক্লাসে প্রমোশন পাচ্ছে। স্কুলে স্কুলে তাদের হাতে উঠবে সরকারের দেওয়া নতুন বই। কিন্তু জ্ঞান কতটা বাড়ল এ সময়ে? কঠিন সময় অতিক্রম করছে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকরা। এ অভিজ্ঞতা মূল্যবান। তবে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সংস্পর্শে রাখাও কিন্তু অপরিহার্য। শিক্ষকদের জন্য এটা হচ্ছে দারুণ এক চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠনের কাছেও চাই বাড়তি দায়িত্বশীলতা।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক