২২ ডিসেম্বর এক জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য বলছে দেশে ৩০ শতাংশ তালাকের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনার কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক এক ধরনের চাপে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে তালাকের দিকে যাচ্ছে।
সব সম্পর্কের মাঝে ধৈর্য্য সহিষ্ণুতা প্রয়োজন। কিন্তু তা হতে হয় দ্বিপাক্ষিক। নতুবা সম্পর্কের সম্পর্কটি সমপাক্ষিক হয় না। আমার প্রশ্ন জেগেছে তালাকের কারণগুলো দেখে। পিতৃতন্ত্রের পিরামিড খুব স্বচ্ছ বিশ্লেষণে এসেছে এই কারণে।
খুব সুক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করুন। নারীরা কারণ হিসেবে দেখিয়েছে- ১. যৌতুকের জন্য নির্যাতন ২. স্বামীর সন্দেহবাতিক ৩. স্বামীর অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয় এবং ৪. মাদকাসক্তি।
আর পুরুষরা যে কারণগুলো বলেছেন, ১. বদমেজাজ ২. সংসারের প্রতি উদাসিনতা ৩. সন্তান না হওয়া এবং ৪. অবাধ্য হওয়া।
এই কারণগুলো একে একে বিশ্লেষণে যাই। যৌতুক একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এর আইনগত ভিত্তি আছে। একজন মানুষ হিসেবে অন্য আরেকজন মানুষের কাছে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হব না এটা আমার, আপনার মানবাধিকার। কেউ আমাকে নির্যাতন করলে আমি মুক্তি চাইব এটাই স্বাভাবিক।
‘যদি সন্দেহ বাসা বাঁধে বিশ্বাসে, সে প্রেমের দাম বলো কী আছে’ একটি গানের লাইন। সত্যিই সন্দেহ থাকলে প্রেম থাকে না। আর একই ছাদের নিচে একসঙ্গে প্রেমবিহীন জীবনের থেকে আলাদা থাকাই উত্তম। একটি সম্পর্কে ভিন্ন একটি সম্পর্ক জন্ম নিলে আগের সম্পর্কটি বাস্তবিক অর্থে আর সম্পর্ক থাকে না।
যুগল সম্পর্কের কেন্দ্র বিন্দু বিশ্বাস, মর্যাদা, ভালোবাসা আর কমিটমেন্ট। এই চারটি সহাবস্থানে না থাকলে সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা না থাকাই ভালো।
মাদকাসক্ত সুস্থ সমাজে কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। মাদকাসক্তির পরিণতি স্বরূপ আসে নির্যাতন, দাম্পত্য সম্পর্কে টানাপড়েন, অপারগতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
মেয়ে হয়েছ, সয়ে যাও। মেয়ের আবার রাগ কিসের? নারীর রাগে বেশ্যা, পুরুষের রাগে বাদশা, পুরুষ রাগলে সেখানে কল্যাণ আর নারী রাগলে সংসারের অমঙ্গল। নারীর মেজাজ মানেই বদমেজাজ। রাগ, দুঃখ, আনন্দ-ভালোবাসা এগুলো মানুষের অনুভূতি। এর সাথে হরমোনাল কিছু সম্পর্ক রয়েছে। পরিবেশ পরিস্থিতি উপর মানুষের অনুভূতির প্রভাব অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। বদমেজাজ এবং মেজাজ শব্দ দুটো সামাজিকীকরণ প্রেক্ষাপটে লিঙ্গ পরিচয়ে অর্থের তারতম্যে অবস্থান করে।
দক্ষিণ এশীয় প্রেক্ষপটে সংসারী শব্দটি লিঙ্গ পরিচয়ে নারীর পাশে অবস্থান করে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নারী এই আদলেই তৈরি। ব্যতিক্রম গ্রহণযোগ্য নয়। সন্তান হওয়া বা না হওয়া একটি শারিরীক প্রক্রিয়া। বন্ধাত্বতা আমাদের নিয়ন্ত্রণে না। একজন পুরুষেরও এই সমস্যা থাকতে পারে। আমার শোনা এবং জানামতে কোন পুরুষের এই সমস্যার কারণে নারী তালাক দিয়েছে এমনটা নাই। কিন্ত একেবারেই নাই এটা আমি বলছি না।
‘বাধ্য থাকা’ এই শব্দটি আমার কাছে অনেকটা ভীতিকর। একটি সমসম্পর্কে একজন আরেক জনের বাধ্যগত হবে, এটা কী কোনো সম্পর্কের সংজ্ঞায়নে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কি না।
যদি কোনো সম্পর্কের অভিধানে এই শব্দ অবস্থান করে তবে জোর গলায় বলতে পারি এটা দাম্পত্য সম্পর্ক নয়। প্রতিটি মানুষ আলাদা স্বত্বায় বেড়ে উঠে। কেউ কারও বাধ্যগত হয়ে জীবনযাপন করবে এটা কোন স্বাভাবিক চিন্তা হতে পারে না।
অথচ সমাজ পরিচালিত নিয়মে নারীকে বাধ্যগত হতে হবে পুরুষের। ব্যতিক্রম ঘটলেই ‘অবাধ্য হওয়া’ শব্দটির সংযোজন করে আমার চারিত্রিক স্খলন ঘটানো হবে। আর এতে আমি কাঠগোড়ায়, আঙ্গুলের পর আঙ্গুল আমার দিকে। আমাকে সহনশীল হওয়ার সংজ্ঞায়নে বাধ্যগত করার মন্ত্র পড়বে পরিবার, সমাজ।
ধর্মীয় ব্যাখ্যায় বিয়ের সংজ্ঞায়নে চারটি ধর্মের প্রেক্ষাপটকে দেখার চেষ্টা করেছি আমি। আমার জানার পরিধি খুবই সীমিত, সে অর্থে জ্ঞানও সীমিত। আমার এই সীমিত জ্ঞানে যতটুকু বুঝেছি মোদ্দা কথায় দুটো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্মতিকে এক কথায় বিয়ে বলা যায়। এখানে বয়স, শ্রেণি, বাধ্যগত হওয়া বা করা কোনো পক্ষের জন্যই বলা হয়নি।
পিতৃতন্ত্র পিরামিডের চূড়ায় অবস্থান করে দাম্পত্য সম্পর্কে জড়িয়ে, বাধ্যগত করা মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে গাঁটবাঁধা সিদ্ধান্ত থেকে বের হয়ে আসতে হবে সমাজকে। এক্ষেত্রে সমাজের ভূমিকা অগ্রগামী। ‘বাধ্যগত হয়ে থাকতে হবে’ এ বাক্যটি জিইয়ে রেখেছে সমাজ।
পৌরুষের বৈশিষ্ট্য হারাবে পুরুষ নারী অবাধ্য হলে। এই ধারণা এবং ব্যক্তিত্বের চাপে, এক অর্থে বলা যায় সামাজিক চাপে সমকোণী ত্রিভুজের পরিপূরক কোনো নারীর সহাবস্থানে অবস্থান করতে চান না তারা।
ফলশ্রুতিতে নারীত্ব এবং পুরুষত্ব পরিপূরক না হয়ে সম্পূরক শব্দে পরিণত হয়েছে। সমাজের ভাবনাই নেই যে একটি ছাড়া আরেকটির অস্তিত্ত্ব কোথায়। নারীকে বাধ্য করা যায় এই ভাবনাটি তখনই ভাবা যায় যখন মনে করা নারীর অবস্থান পুরুষের নিচু স্তরে।
শুধু বাংলাদেশেই নয় দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে ক্রমশ। পাশ্চাত্যের কোনো কোনো দেশে একশটির মাঝে ৪০টি বিয়েই বিচ্ছেদের দিকে যাচ্ছে। অনেক পরিবার ভেঙে যাচ্ছে কারণ পুরুষ নারীকে তার সহাবস্থানে ভাবতে পারছে না। আবার অনেক পরিবার ভাঙছে কারণ নারী অবদমিত অবস্থানে বসবাসে অপারগ হয়ে উঠছে। আবার কোনো কোনো নারী সংসার সন্তানের বোঝা নিতে চাচ্ছে না বলে গাঁটছড়ায় আবদ্ধ হচ্ছে না।
প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায় এই সকল ধারণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো যা ভৌগলিক অবস্থান বা সমাজ ভিন্নতায় পিড়ামিড আকারেই অবস্থান করছে।
আজ থেকে ৪৯ বছর আগে এই ডিসেম্বর মাসেই বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত হয়েছিল আমার দেশ। এ উল্লাস ছিল সবার, বিজয় অর্জনের পেছনে নারী-পুরুষের সবার অংশগ্রহণ ছিল সমতালে। কেউ লড়েছেন রণাঙ্গনে কেউবা পেছনে থেকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে। পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাধ্য হয়ে থাকতে চাইনি বলেই, অবাধ্যতার তেজদীপ্ততায় এই বিজয়।
এ মানচিত্রের স্বত্বাধিকারী আমরা সমভাবে। কিন্তু আমার বোধদয়, মানচিত্রে আমার অবস্থান ‘বাধ্যগত’ শব্দের সীমানায়। পিড়ামিডের নীচে অবস্থান করে বিজয়ের আনন্দে উল্লাস নিয়ে আমার ভাবনা ‘আমার বিজয় ঈষানকোণে’।
লেখক: মানবাধিকার কর্মী, ডেপুটি ম্যানেজার, উইমেন রাইটস এন্ড জেন্ডার ইক্যুইটি, একশনএইড বাংলাদেশ