করোনার মহাতাণ্ডবে পৃথিবী বিপর্যস্ত। আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। পৃথিবীতে ২১৮টি দেশ ও অঞ্চলে করোনা আঘাত হেনেছে। ক্ষতির দিক দিয়ে বৈশ্বিক সূচিতে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম। এশিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত ৫৭টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
ভাইরাস আকৃতিতে অতি ক্ষুদ্র। এটি পূর্ণাঙ্গ জীবনধারী নয় আবার পুরোপুরি জড়পদার্থও নয়। ভাইরাসের অবস্থান জীবন ও জড়ের মাঝামাঝি। এটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজেকে পরিবর্তন করা। করোনা ভাইরাস নিজেকে ঘন ঘন বদলায়। শুরুর সময় থেকে এপর্যন্ত অর্থাৎ গত একবছরে ভাইরাসটির অনেক রূপান্তর ঘটেছে। তবে এইসব রূপান্তরের কারণে করোনা ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। বৈশিষ্ট্য বলতে প্রধানত সংক্রমণ করার গতি, তীব্রতা, মারণ ক্ষমতা, উপসর্গ ও লক্ষণ তৈরি ইত্যাদি বোঝানো হয়।
অতিসম্প্রতি লন্ডনে করোনা ভাইরাসের একটি রূপান্তরিত ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা হয়। এটির সংক্রমণ গতি আগেরগুলোর চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ আগের ভাইরাস যেসময়ে ১০০ জন মানুষকে সংক্রমিত করতো এই নতুন ধরনটি সেই সময়ে ১৭০ জনকে আক্রান্ত করে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে করোনার দ্রুত বিস্তার ঘটছে। এই নতুন ভাইরাসের জন্য সেটা হচ্ছে। ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশে লন্ডনের এই রূপান্তরিত ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি বিমান যোগাযোগ রয়েছে। ফলে যেকোনো সময় এই ধরনটি বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি রাশিয়া, পেরু ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও করোনা ভাইরাসের রূপান্তরিত ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এগুলোর সঙ্গে লন্ডনের নতুন ভাইরাসের হুবহু মিল নেই। তাই মনে করা হচ্ছে প্রতিটি রূপান্তর স্থানীয় ভিত্তিতে হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে দুজন রোগী পাওয়া গিয়েছে যাদের শরীরে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এটির সংক্রমণের তীব্রতা বেশি হতে পারে। এরকম বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআরআই) ঘোষণা করেছে তারা বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের একটি নতুন রূপান্তর শনাক্ত করেছে। সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তাহলে আমরা কি করোনার আরো ভয়াবহ ছোবলের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি?
লন্ডনের নতুন ভাইরাসের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য বোঝা গিয়েছে। যেমন এটির কারণে করোনা রোগের লক্ষণে নতুন কিছু যোগ হয়নি। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা এবং মৃত্যু আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা নেই। আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির হারেও কোন বৃদ্ধি ঘটেনি। করোনার যেসব টিকা দেয়া শুরু হয়েছে অথবা শীঘ্রই দেয়া হবে সে সবগুলো এই ভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম হবে। তাহলে ঝামেলা কোথায়? করোনা ভাইরাসের এই ধরনটির সংক্রমণের গতি আগের চেয়ে অনেক বেশি। আগের ভাইরাস যে সময়ে এক হাজার মানুষকে সংক্রমিত করতো, নতুন ভাইরাস সে সময়ে ১৭০০ জনকে আক্রান্ত করবে। সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়লে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। ধরা যাক করোনা সংক্রমিত রোগীর হাসপাতালে ভর্তির হার দশ শতাংশ। তাহলে আগে ১০০০ জন রোগীর মধ্যে ভর্তি হতো ১০০ জন। এখন হবে ১৭০ জন। একইভাবে মৃত্যুর হার ঠিক থাকলেও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে। দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হবে। ফলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন দেখা দিবে। একসময় হাসপাতালগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। তখন একটি মহাসংকট তৈরি হবে।
করোনা ভাইরাসের স্পাইক বা কাঁটার মতো জায়গায় থাকা প্রোটিনের স্থান পরিবর্তন করার কারণে এই রূপান্তর ঘটেছে। আরটিপিসিআর হচ্ছে করোনা শনাক্তের জন্য সবচেয়ে ভালো পরীক্ষা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই পরীক্ষা দ্বারা রূপান্তরিত ভাইরাস শনাক্ত করা যাবে কি? আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে ‘জিন কিট’ ব্যবহার করা হয়। ‘ওয়ান জিন বা এস-জিন’ কিট ব্যবহার করলে রূপান্তরিত ভাইরাস অনেক সময় শনাক্ত করা নাও যেতে পারে। পরীক্ষার এই ফলাফলকে বলা হয় ‘ফলস নেগেটিভ’। অর্থাৎ রোগ রয়েছে কিন্তু পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছে। ওয়ান জিন কিট ব্যবহারে ‘ফলস নেগেটিভ’ ফলাফলের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এজন্য ‘থ্রি জিন’ কিট ব্যবহার করতে হবে। এই কিট ব্যবহারে মানসম্মত ফলাফল পাওয়া যাবে।
এই নতুন ধরনের ভাইরাসের উপর করোনার টিকা কি কার্যকর হবে? করোনার টিকা দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। একটি হলো এমআরএনএ (MRNA) প্রযুক্তি। এটি নতুন পদ্ধতি। অন্যটি হচ্ছে প্রথাগত প্রক্রিয়া। এখানেও আবার দুটো পদ্ধতি। একটি হলো করোনা ভাইরাসকে অকার্যকর করে অথবা মেরে ফেলে সেটা দিয়ে টিকা প্রস্তুত করা হয়। আরেকটি হলো করোনা ভাইরাসের কাঁটা বা স্পাইকের প্রোটিন বের করে সেটিকে একটি নিরীহ ভাইরাসের ভিতর প্রবেশ করিয়ে টিকা তৈরি করা হয়। নিরীহ ভাইরাসটিকে বলা হয় বাহক বা ভেক্টর। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী দুই ধরণের টিকাই নতুন ভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম হবে। তবে বিষয়টিকে প্রমাণের জন্য অবশ্যই ট্রায়াল হতে হবে।
বাংলাদেশে করোনার যে নতুন রূপান্তরটি শনাক্ত হয়েছে তার সার্বিক প্রভাব কেমন হবে? যেসব নমুনা থেকে নতুন রূপান্তরিত ভাইরাসকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে গত নভেম্বর মাসে। নভেম্বরের পর করোনার সংক্রমণ রেখাচিত্রে কোনো ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। সংক্রমণ, হাসপাতালে ভর্তি, মৃত্যুহার ইত্যাদি বিষয়গুলো অনুমিত সীমার ভিতরেই রয়েছে। তাই শনাক্তকৃত নতুন ভাইরাস থেকে আমাদের ভীত বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে শিশুদের সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে। এই বিষয়টিকে অবশ্যই পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এখন আমাদের দুটো কাজ গুরুত্বের সাথে করা দরকার। একটি হলো সকল আরটিপিসিআর পরীক্ষায় বাধ্যতামূলক ভাবে ‘থ্রি জিন’ কিট ব্যবহার করা। আরেকটি হলো নিয়মিতভাবে করোনা ভাইরাসের ‘জিনোম সিকুয়েন্স’ বিশ্লেষণ করা। করোনার একটি টিকা আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে দেয়া হবে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় এটি রূপান্তরিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে।
যুক্তরাজ্যের নতুন ভাইরাস বাংলাদেশে আসার সম্ভবনা আছে কি? করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। কোনো ব্যক্তি যুক্তরাজ্য থেকে নিজ শরীরে ভাইরাস বহন করে বাংলাদেশে আসতে পারে। বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাজ্যের সরাসরি বিমান যোগাযোগ রয়েছে। তাই বিমানপথে সংক্রমিত ব্যক্তির প্রবেশ ঘটা সম্ভব। ইতালি থেকে যেভাবে হয়েছিল। আমরা মনে করতে পারি ইতালি ফেরত দুই ব্যক্তি এবং তাদের একজনের স্ত্রী বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী হিসাবে নির্ণীত হয়েছিল। সংক্রামক মহামারি নিয়ন্ত্রণের প্রধান কৌশল হচ্ছে - রোগবহনকারীর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা। এজন্য যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বিমান যোগাযোগ জরুরি ভিত্তিতে স্থগিত করা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে পৃথিবীর বহুসংখ্যক দেশ যুক্তরাজ্যের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করেছে। কোনো বিশেষ কারণে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করা না গেলে বিমানে আগত সবাইকে ১০ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। অবশ্যই এটা হবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন। এক্ষেত্রে হোম কোয়ারেন্টাইন একটি প্রমাণিত অকেজো পদ্ধতি। সরকার সাত দিনের কোয়ারেন্টাইনের কথা ঘোষণা করেছে। রোগতত্ত্বীয় বিশ্লেষণ থেকে ৭দিন নয় ১০দিনের কোয়ারেন্টাইন যথাযথ বলে মনে হয়।
যুক্তরাজ্যের দ্রুত সংক্রমণশীল নতুন করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশ করলে করোনা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হবে। তাতে মৃত্যু, ভোগান্তিসহ সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে ‘রোগ বহনকারীর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা’ জরুরি।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, শিশু অধিকার, স্বাস্থ্য অধিকার ও পরিবেশ কর্মী।