বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার’, বাংলাদেশকেই সম্মানিত করল ইউনেস্কো

  •    
  • ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৯:৫৬

সৃজনশীল অর্থনীতিতে ‘ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধু’ পুরস্কার সংস্থাটির প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার। প্রতি দুই বছর অন্তর এ পুরস্কার প্রদান করা হবে, যার অর্থমূল্য ৫০,০০০ মার্কিন ডলার। প্রথম বারের মতো ২০২১ সালের নভেম্বরে সাধারণ সভা চলাকালে এ পুরস্কার প্রদান করা হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির উপর গভীর মমত্ববোধ, বাংলা ভাষার প্রতি গভীর আবেগই তাকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।

রাষ্ট্রটির দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এবং সব সমস্যার সমাধান হবে শান্তিপূর্ণ। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই পলিসি খুব অল্প সময়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বিশ্বের ১১৬টি দেশের স্বীকৃতিসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে মর্যদার সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হিমালয়সম আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আর বঙ্গোপসাগরের মতো বিশাল হৃদয় দিয়ে তিনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেখানেই গিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন।

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বিশ্বের ছয়জন বরেণ্য নেতার নামে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল। তার মধ্যে দুইজন নেতা জীবিত ছিলেন। একজন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যজন যুগোস্লোভিয়ার নেতা মার্শাল জোসেফ ব্রজ টিটো।

প্রয়াত চার নেতা ছিলেন ভারতের পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ন, ঘানার কাউমি নক্রুমা ও মিসরের জালাল আবদুল নাসের। সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।

১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন বঙ্গবন্ধু। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তব্য রাখেন। প্রিয় মাতৃভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকেই তিনি সেদিন বলেছিলেন, মাননীয় সভাপতি আমি আমার মাতৃভাষা বাংলায় বক্তব্য রাখতে চাই। তখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘকে ‘মানব জাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে বিশ্বব্যাপী শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন তিনি।

গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তিতে অবদান রাখায় ২৩ মে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়। সফল পররাষ্ট্রনীতি ও বিশ্ব শান্তির পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য দেয়া হয় এই স্বীকৃতি।

বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে। প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহিদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।

বঙ্গবন্ধু যে শুধু বাঙালির বন্ধু নন, বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত অসহায় মানুষেরও বন্ধু সেটা তিনি কাজের মধ্য দিয়েই বারংবার প্রমাণ করে গেছেন।

একদিকে চলছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, অন্যদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। এমন একটি মহেন্দ্রক্ষণে ইউনেস্কো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘোষণা করে বাংলাদেশকেই সম্মানিত করল। গত ১১ ডিসেম্বর ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদের শরৎকালীন ২১০তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিন্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

ইউনেস্কো (UNESCO) জাতিসংঘের একটি বিশেষ সংস্থা। বিশ্বে শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতির প্রসার এবং উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনের উন্নয়ন ঘটানো এই সংস্থার প্রধান কার্যক্রম।

শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শান্তি বিষয়ে ইউনেস্কো এতদিন যাবৎ ২২ ধরনের পুরস্কার দিয়ে এসেছিল। এর সাথে যুক্ত হলো বঙ্গবন্ধুর নামে ‘সৃজনশীল অর্থনীতি’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ‘Bangabandhu sheikh Mujibur Rahaman International Prize in the field of Creative Economy’।

এই প্রথম কোনো বাংলাদেশির নামে পুরস্কার প্রবর্তন করল ইউনেস্কো। এ পুরস্কার সৃজনশীল অর্থনীতিতে যুব সমাজের উন্নয়নে সাংস্কৃতিক কর্মী, কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা কর্তৃক ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগকে স্বীকৃতি দেবে। সৃজনশীল শিল্পের ভিত্তি হলো সাহিত্য, সংগীত, হস্তশিল্প, চিত্রকলা, চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন মাধ্যম।

সৃজনশীল অর্থনীতিতে ‘ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধু’ পুরস্কার সংস্থাটির প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার। প্রতি দুই বছর অন্তর এ পুরস্কার প্রদান করা হবে, যার অর্থমূল্য ৫০,০০০ মার্কিন ডলার। প্রথম বারের মতো ২০২১ সালের নভেম্বরে সাধারণ সভা চলাকালে এ পুরস্কার প্রদান করা হবে।

ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১৯ সালে ইউনেস্কোর ৪০তম সাধারণ সভায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ইউনেস্কোর শতবর্ষী কর্মসূচির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে পালনের সিন্ধান্ত নেয় জাতিসংঘের শিল্প, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা- ইউনেস্কো।

করোনা পরিস্থিতির কারণে এখনও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আড়ম্বরভাবে করা সম্ভব হয়নি। সরকার আগামী ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিববর্ষ বর্ধিত করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দর্শন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ইউনেস্কো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

ইউনেস্কো সেই সব মহান ব্যক্তির জন্মবার্ষিকী পালন করে যাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বাক স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। বঙ্গবন্ধু স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিল্প-সংস্কৃতি এমনকি মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের দৃঢ়তাকে ইউনেস্কো জন্মশতবার্ষিকী পালনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিয়েছে।

ইউনেস্কো বরাবরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার কর্ম ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড আন্তর্জাতিক রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউনেস্কো।

সাধারণত আন্তর্জাতিক তাৎপর্য আছে- এমন বিষয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মেমোরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৭ই মার্চের ভাষণটি বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এই ভাষণটির জন্য নিউজউইক সাময়িকী বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘রাজনীতির কবি' হিসেবে।

ইউনেস্কোর স্বীকৃতির আগেই আড়াই হাজার বছরের সেরা ভাষণ নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে জ্যাকব এফ ফিল্ড সংকলিত ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্যা বিচেস- দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টোরি’ নামক গ্রন্থে ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইস দ্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেস’ শিরোনামে স্থান করে নেয় ভাষণটি।

১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে বাংলা ভাষাকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছে। আজ শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের প্রতিটি দেশই মর্যদার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালন করে।

১৯৯৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘The Felix Houphout-Boigny-UNESCO Peace Prize’ নামে শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়। এরপর ২০১৪ সালেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

বাংলাদেশের ঐতিহ্য ষাট গম্বুজ, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ও সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য এবং বাউল গান, জামদানি, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও শীতল পাটিকে বিশ্ব অপরিমেয় ঐতিয্য হিসেবে ঘোষণা করে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে সংস্থাটি।

ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক’ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা প্রতিটি বাঙালির কাছেই গর্বের। এ পুরস্কার বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ, সারা জীবনের ত্যাগ, সংগ্রামের ইতিহাস সারা বিশ্বে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত, অসহায় মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা যোগাবে।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

এ বিভাগের আরো খবর