বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চিনিকল বন্ধ কাদের স্বার্থে?

  •    
  • ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৯:২৯

চিনিকলগুলো শুধু মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদন করত না। অনেক ধরনের সামাজিক দায়িত্ব তারা পালন করত। যেমন ছাত্র বৃত্তি দিয়ে দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষা অব্যাহত রাখা, স্কুল, রাস্তা ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণসহ অনেক কাজ করা হয় চিনিকলের টাকায়। সে সব কিছু বিবেচনায় না নিয়ে লোকসান কমানোর প্রথম ধাপ হিসেবে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করা হয়েছে।

দেশের কৃষিভিত্তিক ভারী শিল্পগুলো ক্রমাগত বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার। রাষ্ট্রীয় পাটকলের মৃত্যু ঘোষণার পরপরই এবার আঘাত এল চিনিকলের উপর। দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পিতভাবে দুর্বল করে ফেলার পর সরকার এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো বন্ধ করার।

যে লোকসানের জন্য চিনিকল শ্রমিক ও আখচাষিরা দায়ী নয়, সেই লোকসানের দায় শ্রমিকের উপর চাপিয়ে লোকসানের বোঝা কমাতে প্রাথমিকভাবে ছয়টি চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)।

আপাতত এসব চিনিকলে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের আখ মাড়াই বন্ধ করা হয়েছে। বাজানো হচ্ছে সেই পুরনো ক্যাসেট, লোকসান!

কিন্তু লোকসানের কারণ জানা থাকলেও দূর করার উদ্যোগ নেই। আবার এ কথাও বলা হচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগে জরাজীর্ণ কারখানাগুলো আধুনিকায়ন করা হবে। চিনির পাশাপাশি স্পিরিট, অ্যালকোহলসহ অন্যান্য উপজাত পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং এইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে চিনিকলগুলো বন্ধ করা হল।

প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর আখ মাড়াই শুরু হলেও এ বছর তা শুরু হয়নি। ঘোষণা করা হয়েছিল ১৫ ডিসেম্বর মাড়াই শুরু হবে। এর আগে ৩ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হল চিনি কলের উৎপাদন বন্ধ রাখা হবে।

এ বছর থেকে উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া চিনিকলগুলো হচ্ছে- কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর (রংপুর), রংপুর ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকল। বন্ধ হওয়া ছয় চিনিকলে ২ হাজার ৮৮৪ জন শ্রমিক-কর্মচারি কর্মরত।

কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর, রংপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৩৮০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। তার মধ্যে কুষ্টিয়া চিনিকল ৬১ কোটি, পাবনা ৭৪, পঞ্চগড় ৪৭, শ্যামপুর ৫৯, রংপুর ৫৩ এবং সেতাবগঞ্জ ৮৪ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর লোকসান ছিল ৪০১ কোটি টাকা। এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো ৩১০ কোটি টাকা এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৯০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছিল।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারি চিনিকলগুলোতে লোকসান ছিল ৩১৩ কোটি টাকা। বলা হয়েছে, চিনিকলগুলোতে গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে করপোরেশন। তার মধ্যে বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরেই লোকসান ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। তা ছাড়া ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের দায় রয়েছে করপোরেশনের ঘাড়ে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও গ্র্যাচুইটি, ভবিষ্য তহবিল, আখের মূল্য ও সরবরাহকারীর বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে ৫৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

স্বাধীনতার পর আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন গঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন ও বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনকে একীভূত করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন গঠন করা হয়। এটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। চিনিকল এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৭২টি শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন গড়ে তোলা হয়েছিল।

পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে ৫৯টি প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। সংকটের শুরু তখন থেকেই। বর্তমানে করপোরেশনের আওতায় ১৫টি চিনিকল রয়েছে এ ছাড়াও একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা, একটি ডিস্টিলারি ও একটি জৈব সার কারখানা আছে।

বিএসএফআইসি সূত্রে জানা যায়, দেশে সরকারি মালিকানাধীন চিনিকলগুলো হচ্ছে- জিলবাংলা সুগার মিলস লিমিটেড, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস লিমিটেড, শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড, সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড, রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড, পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেড, নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর সুগার মিলস লিমিটেড, মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড, কুষ্টিয়া সুগার মিলস লিমিটেড, জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেড, ফরিদপুর সুগার মিলস লিমিটেড, রাজশাহী সুগার মিলস লিমিটেড ও কেরু এন্ড কোং সুগার মিল।

চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন গড়ে তোলা হয়েছিল চিনি ও চিনিজাত খাদ্য পণ্য তৈরির লক্ষ্য নিয়ে। এদিকে চিনিশিল্পের সহযোগী শিল্প হিসেবে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড, একটি ডিস্টিলারি কারখানা এবং চিনিকলের যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য কুষ্টিয়া শহরে রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা গড়ে তোলা হয়। করপোরেশনের অধীনে জমির পরিমাণ ১৯ হাজার ৮৫ একর এবং পুঞ্জিভুত সম্পদের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।

হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান, লোকসানের অপবাদ থাকলেও করপোরেশনে অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ১৬ হাজার ২৩৫। বর্তমানে কর্মরত আছেন ৯ হাজার ১৬ জন। তাদের মধ্যে কর্মকর্তা ৭১৪, কর্মচারী ৪ হাজার ৪০১ ও শ্রমিকের সংখ্যা ৩ হাজার ৯০১ জন। কী অদ্ভুত! শ্রমিকের তুলনায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। উৎপাদনের জন্য আখমাড়াই মৌসুমে প্রয়োজন অনুযায়ী অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে।

সব কর্মকর্তা কর্মচারীর বেতন বাবদ মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকা খরচ হয় করপোরেশনের। কিন্তু আখের স্বল্পতার কারণে মিলভেদে বছরে আখমাড়াই কার্যক্রম ৪৭ থেকে ১২৬ দিন পর্যন্ত চলে।

বছরের এক তৃতীয়াংশ সময় উৎপাদন আর দুই তৃতীয়াংশ সময় বসে থাকা এই হল চিনিকলের বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে চিনি এবং তার উপজাত তৈরির পরিকল্পনা নিয়েই চিনিকল স্থাপন করা হয়েছিল।

প্রচার মাধ্যমের মাধ্যমে এটা সবাই জানে, চিনি শিল্প করপোরেশন বহু বছর ধরে লোকসানে জর্জরিত। লোকসান কমিয়ে লাভজনক করতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকল্পের কথা বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যে সব কারণে লোকসান হচ্ছে তা বহাল রাখার কারণে দুর্নীতির অভিযোগ ক্রমাগত বাড়ছে। এর সামগ্রিক ফলাফল হিসেবে লোকসান দিনের পর দিন বাড়ছেই।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চিনি শিল্প করপোরেশনের লোকসান ছিল ৫১৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। সেটা বাড়তে বাড়তে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত হিসাবে প্রায় ৯৮২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএসএফআইসির বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।

দেশে বছরে প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন চিনি আমদানি হলেও চিনি শিল্প করপোরেশন উৎপাদন করে মাত্র ৬০ হাজার টনের মতো। ভাবতে অবাক লাগলেও এটা সত্যি যে এই সামান্য পরিমাণ চিনিও বিক্রি করতে পারে না চিনিকলগুলো। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই, সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয়া সত্ত্বেও এই চিনি অবিক্রিত থাকে। ফলে প্রায়ই চিনিকলগুলো আখচাষিদের পাওনা ও শ্রমিকের মজুরি দিতে পারে না। তখন সরকারের কাছে অর্থ সহায়তা নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা পর্যন্ত তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করে প্রথম আলো পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কারখানাগুলোতে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বেতন বকেয়া। চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে এখনো মার্চ মাসের বেতন হয়নি।

তিনি বলেন, বেতন-ভাতা দিতে ২১০ কোটি টাকা দরকার। আর আখচাষিদের পাওনা বাবদ বকেয়া ১৬১ কোটি টাকা। তিনি বলেন, শ্রমিক ও কৃষকেরা খুব কষ্টে রয়েছে। আমার নিজের মার্চের বেতনও হয়নি।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, চিনি উৎপাদন করতে যে খরচ হয় সেই দামে চিনি বিক্রি করা অসম্ভব। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয় সেই দামে বিক্রি করলে আবার উৎপাদন খরচ মেটানো সম্ভব হয় না। ফলে বছরের পর বছর সরকারের ভর্তুকি নিয়ে তাদের চলতে হয়। কিন্তু সেই ভর্তুকিও তারা ঠিকভাবে পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

কেন উৎপাদন খরচ এত বেশি, তার দায় কে নেবে, ভুল নীতি বা দুর্নীতি কতটা দায়ী সে আলোচনা করা হয় না কখনো।

চিনিকলগুলোকে লাভজনক করতে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি চিনিকলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন, চিনিকলগুলোর আধুনিকায়ন, ডিস্টিলারি ইউনিট স্থাপন, জৈব সার উৎপাদন, মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট, জুস প্লান্ট স্থাপনসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়ার কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। পাশাপাশি সুগার মিলগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বসানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে সুগার মিলগুলো নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে অবশিষ্ট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের মাধ্যমে বড় অঙ্কের মুনাফা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে বলা হয়েছিল। এ ছাড়া কেরু অ্যান্ড কোম্পানি আধুনিকায়নে ১৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কোম্পানির ডিস্টিলারি ইউনিট অটোমেশন করা হচ্ছে।

জানা গেছে, রাজশাহী চিনিকলে আধুনিক জুস ফ্যাক্টরি করা হবে। গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে রংপুর সুগার মিলস জায়গা জমি আছে ১৮০০ একর, যেখানে ১৯টি বড় পুকুর রয়েছে। সেগুলো উদ্ধার করে বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য চাষ প্রকল্প হাতে নেয়া হবে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।

এ ছাড়া পঞ্চগড় ও সেতাবগঞ্জ সুগার মিলে মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি সরকারি চিনিকলগুলোতে মিলে রিফাইনারি স্থাপন করার কথাও বলা হচ্ছে। এ ছাড়া জিলবাংলা সুগার মিলসহ আরো তিনটি চিনি কলকে আধুনিক করা হবে বলে বলা হচ্ছে। এসব ঘোষণা, প্রতিশ্রুতি আর পরিকল্পনার পাশাপাশি চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার কাজ কিন্তু ঘটেই গেল।

প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের এক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানে থাকার মূল কারণ পাঁচটি।

প্রথমত, কোনো কারণ ছাড়াই এই কারখানাগুলোয় উৎপাদিত চিনির ব্যয় বেশি।

দ্বিতীয়ত, এসব কারখানার চিনির দাম বেশি হওয়ায় বাজারে বিক্রি হয় না। বিক্রি না হওয়ায় মূলধন আটকে যাচ্ছে, আর এর ফলে বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদের পরিমাণ।

তৃতীয়ত, সরকারি চিনিকলগুলোয় ব্যবহৃত প্রধান কাঁচামাল আখ পাওয়া যায় না। আখের অভাবে চিনিকলগুলো বন্ধ থাকে মাসের পর মাস। তবে বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে সারা বছরের বেতনভাতা দিতে হয়। ফলে লোকসানের পরিমাণও বাড়ছে।

চতুর্থ কারণ, উৎপাদিত চিনি বিক্রি না হওয়ায় যথাসময়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। যে কারণে প্রতিদিন ব্যাংকগুলোর কাছে চিনিকলগুলোর দায় বাড়ছে।

পঞ্চমত, আখ চাষে কৃষকের আগ্রহ কমে গেছে। কারখানাগুলোয় আখ সরবরাহ করতে সরকারি দলের আধিপত্য বিস্তার, সরকারি কর্মকর্তাদের নানা রকম ঝামেলা এবং সরবরাহ করা আখের মূল্য সময়মতো না পাওয়ায় চাষিরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সারা বছর কারখানা চালু রাখার মতো আখ পাওয়া যায় না। বছরের প্রায় নয় মাসই কারখানা বন্ধ রাখার ফলে লোকসান বাড়ছে।

অনুসন্ধানে আর একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে, আখ উৎপাদনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে আখ চাষিদের কারখানার মাধ্যমে যে ঋণ দেওয়া হয়, চাষিরা সেই ঋণের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ পুরো টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করে না। তাতে শুধু ঋণের পরিমাণ বাড়ে তাই নয়, ঋণের সুদ জমতে থাকে। এর দায় এসে পরে চিনিকলের উপর। এটাকে কোন ধরনের দুর্নীতি বলা যাবে?

প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের শনাক্ত করা এসব কারণ ছাড়াও অন্যান্য কারণে সরকারি চিনিকলগুলো লোকসান দেয়। রাজনৈতিক প্রভাবে অধিক জনবল নিয়োগ, কাঁচামাল বা উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের যানবাহন কারখানার কর্মকর্তা বা সিবিএ নেতাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত বিল আদায়, উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য বিপণন ব্যবস্থা না থাকা, পণ্যের প্রচারণার অভাব সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানের কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এর সব কারণের সঙ্গে যুক্ত আছে রাষ্ট্র ক্ষমতা আর দুর্নীতি। যার সুফল ভোগ করছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন আর দুর্ভোগ পোহাবে ২৫ হাজার শ্রমিক, পাঁচ লাখ কৃষক পরিবার আর পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে যুক্ত ৫০ লাখ মানুষ। চিনিকল বন্ধ হলে রাষ্ট্র হারাবে সম্পদ, লুণ্ঠনকারীদের হবে পোয়াবারো। চিনিকলের জায়গা দখলের সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধিত চিনির উপর নির্ভরশীল করে একচেটিয়া ব্যবসা করার স্বার্থে চিনিকল বন্ধের তৎপরতা চলছে।

চিনিকলগুলো শুধু মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদন করত না। অনেক ধরনের সামাজিক দায়িত্ব তারা পালন করত। যেমন ছাত্র বৃত্তি দিয়ে দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষা অব্যাহত রাখা, স্কুল, রাস্তা ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণসহ অনেক কাজ করা হয় চিনিকলের টাকায়। সে সব কিছু বিবেচনায় না নিয়ে লোকসান কমানোর প্রথম ধাপ হিসেবে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করা হয়েছে।

লোকসানের হাতি পুষবেন না একথা বলার পাশাপাশি আবার কর্তৃপক্ষ বলছে, জাপান ও থাইল্যান্ড নাকি আমাদের চিনিকলগুলোতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চায়। এতদিন নাকি সে পদক্ষেপের বাস্তবায়ন হয়েই যেত, শুধু করোনার কারণে বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছে। বিদেশিরা চিনিকল চালু, বিনিয়োগ ও লাভের সম্ভাবনা দেখতে পেলেও সরকার তা দেখতে পাচ্ছে না কেন বিষয়টি বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না।

লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাসদ এবং সম্পাদক, ভ্যানগার্ড

এ বিভাগের আরো খবর