এমন এক পৌষ মাসে কুড়িগ্রাম গিয়েছিলাম। সড়কপথে একের পর এক জনপদের পৌষ দেখতে। কুড়িগ্রাম পৌঁছার দ্বিতীয় দিন ভোরে নৌকায় ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রে ভাসি। কুয়াশার দেয়াল ভেঙে এগিয়ে যেতে থাকি। আমার সঙ্গীদের মাঝে একজন তরুণ শিক্ষক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। ইঞ্জিন নৌকার শব্দ মাড়িয়ে তার কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ছে দুইকূল। আকাশে ভেসে থাকা চিল বা অন্য পাখিরাও বুঝি তার কথার শ্রোতা।
তিনি জোরসে বলে যাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব কথা। ইতিহাস, তিনি যখন ছাত্র ছিলেন এবং এখন কেমন আছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। তার বলাতে আমি কিছু যোগ করতে পারছি না। কারণ, ঢাকা কেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আমার অভিজ্ঞতা নেই। তবে পেশাগত কাজে, শুধু ঘুরে দেখবার জন্যে বহুবার দেশ বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়েছে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির নানা উৎসব দেখতে।
বাঙালির উৎসব মানেই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেটা মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে কনসার্ট। সহযাত্রীর বক্তব্যের গতিরোধ করেন নৌকার মাঝি। তিনি সহযাত্রীর কাছে জানতে চান, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হচ্ছে, ওটা টিএসসি’র পাশে কিনা? এই প্রশ্ন শুনে হতভম্ব আমার সহযাত্রী। আমি শুধু মুচকি হাসলাম।
কারণ, আমার কাছে যেমন, দেশ জুড়ে সবার কাছেই দেখছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আছে। ১৯৬৪ সালে গ্রিক নকশাকারের নকশায় তৈরি দালানটি এদেশের সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
কোনো প্রতিবাদ ও জাগরণের আতুঁড় ঘরও এই টিএসসি। পরবর্তীতে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিএসসি নির্মিত হয়েছে, কিন্তু জনমানুষের সঙ্গে সেই টিএসসির যোগাযোগ ঘটেনি। এমনকি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেই টিএসসি আত্মার যোগ ঘটেছে কিনা সন্দেহ। বরং যেখানে যে প্রান্তে যে শিক্ষার্থী বা শিক্ষক থাকুন না কেন, সবার মিলন কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি। এখনও তা প্রমাণিত।
এই তো খুব বেশি দিন হয়নি হেমন্ত উপভোগে দিনে রাতে কয়েক বার গিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, স্বাদ নিতে ভুল হয়নি টিএসসি ক্যান্টিনের হট পেটিস আর গাছ তলার চায়ের।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে যাওয়া দৃশ্যপট শুধু ওই বিদ্যায়তনের ৪০ হাজার শিক্ষার্থী, চার হাজার শিক্ষককেই নয় পীড়িত করছে সবাইকেই। কেমন যেন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদয়। একের পর এক দেয়াল তুলে বিভক্তি আনা হচ্ছে। অস্বীকার করছি না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে, শিক্ষা কার্যক্রমের পরিধি বেড়েছে। এজন্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়া বা বহুতল ভবন নির্মাণের হয়ত অনিবার্যতা আছে।
কিন্তু তাই বলে একের পর এক দৃষ্টিদূষণ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক ও নান্দনিকতা বিরুদ্ধ ভবন তো মাটি ফুঁড়ে উঠতে পারে না। এখন আর গ্রিক নকশাকারের প্রয়োজন নেই। আমাদের স্থপতিরাই বর্তমানকে অক্ষুণ্ন রেখে নাগরিক স্থাপনা তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত।
অবয়বপত্রে টিএসসির সীমানা প্রাচীরের গাছ হত্যার দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছি। ভবন ভাঙার শোক সইতে পারবো কিনা জানি না। এমনিতেই ক্যাম্পাসে রাজনীতি ও সংস্কৃতির মুখরতা কমে বেড়েছে যান্ত্রিক কোলাহল। তার উপর ক্যাম্পাসের বুক চিড়ে যাবে মেট্রোরেল। নান্দনিক ক্যাম্পাসের যান্ত্রিকতা আর কুড়িগ্রামের নৌকার মাঝি পর্যন্ত পৌঁছবে না। ক্যাম্পাস থেকে হারিয়ে যাবে ষড়ঋতু।
কর্তৃপক্ষ সাফাই গাইছে, মিলনায়তনের সুযোগ সুবিধার বিস্তার থাকবে বহুতল ভবনে। কিন্তু ঐতিহ্য গুঁড়িয়ে দেয়া নির্মাণ আকাশ ছুঁতে পারে, হৃদয় স্পর্শ করতে পারে না। এই বাস্তব সত্য তাদের অজানা। জানা থাকলে নিশ্চিত ঐতিহ্য রক্ষা করেই তারা উন্নয়নের সাগর পাড়ি দিতেন। তখন একলা নয়, আমরা তাদের সহযাত্রী হতাম।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী