বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মন্ত্রীর দেশে পাখি হত্যার হোটেল!

  •    
  • ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ ২০:৪২

মৌলভীবাজার-১ থেকে নির্বাচিত মো. শাহাব উদ্দিন আমাদের পরিবেশ-বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী। একটা সময় বিশ্বের বৃহৎ হাওর হাকালুকিকে বিষ দিয়ে নির্বিচার পাখিহত্যা হতো। এই হত্যা কিছুটা কমেছে, কিন্তু হরিপুর বাজারে থামেনি পাখিহত্যার হোটেল।

‘এথনোগ্রাফ’ নামে সমাজ ও জনসংস্কৃতির এক বহুল চর্চিত বিধিবদ্ধ অধ্যয়ন বিদ্যার কথা আমরা কমবেশি জানি। গবেষককে এখানে গবেষিত ময়দানের একজন হয়ে উঠতে হয়। জনসমাজের চোখে চারপাশ জানাবোঝার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। মর্গান, ফ্রানজ বোয়াস, ম্যালিওনস্কি, লেভি স্ট্রস, মার্গারেট মিড কিংবা ম্যুলারের এথনোগ্রাফগুলো নানা তর্ক-বিতর্কসমেত জগতবিখ্যাত। মানিকের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, তারাশংকরের ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’, দেবেশ রায়ের ‘তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত’ কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ সবই জনসমাজের এক একটি অবিস্মরণীয় ‘এথনোগ্রাফ’।

‘এথনোগ্রাফ’ হয় সরাসরি শারীরিক বাস্তবতার দুনিয়ায়। কিন্তু শারীরিক বাস্তবতার পাশাপাশি ভার্চুয়াল জগতেও তো তৈরি হচ্ছে অভিনব সব ‘বাস্তবতা’। কিংবা বাস্তবতা আরেক রূপ পাচ্ছে ইন্টারনেটের ডিজিটাল বলয়ে। এই ভার্চুয়াল বাস্তবতাকে পাঠ করে যারা এথনোগ্রাফ তৈরি করছেন তারা এর নতুন নাম দিচ্ছেন ‘নেটনোগ্রাফ বা ইন্টারনেট এথনোগ্রাফ’।

প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের ভাবনার ময়দানকে বোঝার জন্য একটা ‘নেটনোগ্রাফির’ প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দৈনিকের অনলাইন সংস্করণের খবর, ইউটিউবের কিছু ভিডিও, ফেসবুকে কিছু পোস্ট-কমেন্ট দেখে কলিজা কেঁপে উঠল! কী নিদারুণ, কী সাংঘাতিক।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজারে কিছু খাবার হোটেলে বুনো পাখির মাংস বিক্রি হয় আর মানুষ দলবেঁধে সেসব খেতে যায়। জীবন্ত পাখি, পাখির লাশ রান্না থেকে শুরু করে সেসব লাশের নির্দয় খানাপিনার ছবি ও ভিডিও তারা মহাসমারোহে আপলোড করে। এসব ভিডিও ও পোস্ট দেখে অন্যরা ‘আহা-ইহি’ করে লাইক দেয় কিংবা এখনও যায়নি বলে আফসোস করে।

অনেকে বলবেন, এভাবে বুনোপাখি বিশেষত দেশীয় আবাসিক ও পরিযায়ী পাখিদের হত্যা ও বাণিজ্যিক ভক্ষণ বাংলাদেশের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। হোটেল-রেন্টুরেন্ট এবং যারা মহাসমারোহে বুনোপাখির মাংস-ভক্ষণকে চাঙা রেখেছে তাদের বিচার চাইবেন অনেকে। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি স্রেফ আইনের লঙ্ঘন বা পরিবেশ সম্পর্কে অসচেনতার বিষয় নয়।

হরিপুর বাজারে দীর্ঘদিন থেকেই হোটেল-রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানে শীত মওসুমসহ বছর ধরে বুনোপাখির মাংস বিক্রিও হতো। প্রশাসন, পরিবেশ আইন এসব হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ করতে পারেনি। বরং পাখি হত্যাকারী হোটেল-রেস্টুরেন্টের সংখ্যা বেড়েছে। কেন বেড়েছে? কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে বুনোপাখি হত্যা ও এর বাণিজ্যিক ভক্ষণকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে।

এখনকার প্রজন্ম শারীরিক ও ভার্চুয়াল দুটি বাস্তবতায় বসবাস করে। দুই বাস্তবতাই তার চিন্তা ও মগজে প্রভাব ফেলে। দেশের এক বৃহৎ প্রজন্মের কাছে বুনোপাখি হত্যা ও ভক্ষণের বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিকভাবে বৈধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এরাই একসময় দেশের প্রশাসক, উৎপাদক, নীতিনির্ধারক, শিল্পী কি সংরক্ষণবিদ হবে।

কিন্তু তাদের মগজ থেকে বুনোপাখি হত্যার বৈধতা কি ‘ডিলিট’ বা ‘ব্লক’ হবে? মানুষের চিন্তার জটিল জমিনে এর কি চিরস্থায়ী কোনো দাগ থাকবে না?

ইচ্ছে করলেই বক, ডাহুক, কালিম, সরালী, বালিহাঁস নিদারুণভাবে হত্যা করে হোটেলে বসে খাওয়া যায়; এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই কি তবে বড় হবে নতুন প্রজন্ম? এমন নির্দয় চিন্তাধারী জনগণের একটা ভূগোল কতদিন তাহলে টিকে থাকতে পারবে? স্বকীয় স্বর, সত্তা, বৈচিত্র্য আর বৈভব নিয়ে? একটা বিচ্ছিরি অন্যায় আর সর্বগ্রাসী লোভাতুর মানসিকতা নিয়ে?

বিজ্ঞান বলে, চাহিদা থাকলেই উপায় তৈরি হয়। বুনোপাখি মানুষ খেতে চায় বলেই হরিপুরের হোটেলে এর লাশ বিক্রি হয়। আর বিক্রি জমজমাট বলেই হোটেলগুলো নির্দয়ভাবে পাখিদের হত্যা করে। প্রথমত থামাতে হবে ভোক্তা-ক্রেতার লোভ। একজনও যদি হরিপুরের হোটেলে গিয়ে বুনোপাখির লাশ না খায় তবে বন্ধ হবে এই নিদারুণ খুনখারাবি।

তারপর প্রশ্ন হল, দেশের আর কটি বাজারে হরিপুরের মতো এমন প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে বুনোপাখি বিক্রি হয়। এটি প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, কাঠামো, নজরদারি, সচেতনতা এবং সুশাসনের প্রশ্ন। চলতি আলাপখানি প্রশ্নহীনভাবে হরিপুর বাজারে বুনোপাখি বিক্রি বিষয়ে একটা ছোট্ট ‘নেটনোগ্রাফি’ নমুনা।

আমি নিশ্চিভাবে জানি এ বিষয়ে অনেকে এর চাইতেও বেশি তথ্য, জিজ্ঞাসা ও প্রশ্ন জারি রেখেছেন। চলতি আলাপখানি কেবল আইনের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রস্তাব রাখছে না, বরং চাইছে প্রাণ-প্রকৃতি ঘিরে তরুণ প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক জাগরণ। যারা আজকে বুনোপাখির লাশের ছবি/ভিডিও প্রচার করছে তারাই পারে এই অপরাধ রুখে দাঁড়াতে। বদলে দিতে পারে নিজেদের যোগাযোগ মাধ্যমের ভাষা ও ভঙ্গিমা। দাঁড়াতে পারে পাখিদের সঙ্গে, পাখিদের নিয়ে। তাহলেই এই প্রজন্মকে নিয়ে দাঁড়াবে এক মুগ্ধ স্বদেশ।

ইউটিউব জুড়ে পাখির লাশ

হরিপুরে পাখি হত্যার বিষয়টি বোঝার জন্য ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘হরিপুরে পাখির মাংস’ লিখে ইউটিউবে একটি সার্চ দেই। একের পর এক হোটেলের ডেগ-ডেগচি, হাড়ি-কড়াই, উনুন আর টেবিলে ভোক্তাদের থালায় থালায় পাখিদের ঝোলমাখা লাশের দৃশ্য।

এর ভেতর সবচেয়ে পুরোনো ভিডিওটি করোনা মহামারির আগে আপলোড করা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ‘আবেদ আবদুল্লাহ রাব্বানী (Abed Abdullah Rabbani)’ এটি তার ইউটিউবে ‘সিলেটের হরিপুরে মাটির চুলায় পাখির মাংস’ শিরোনামে আপলোড করেছেন।

হরিপুর বাজারের ‘পুরান ড্রাইভার হোটেলের’ ভেতর ঢুকে তিনি ভিডিও করে বুনোপাখি রান্না ও বিক্রির দৃশ্য দেখিয়েছেন। ভিডিওতে দেখা যায়, একজন বাবুর্চি রান্না করছেন আর ভিডিওগ্রাহক তাকে প্রশ্ন করছেন, কী রান্না হচ্ছে? বাবুর্চি মাংস নাড়িয়ে নাড়িয়ে জবাব দিচ্ছেন, বালিহাঁস। এরপর ভিডিওগ্রাহক বলছেন, ফ্রেশ বালিহাঁস আমাদের সামনেই জবাই করা হয়েছে।

তারপর ভিডিওগ্রাহক রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে রান্না করা তরকারি দেখিয়ে পাখিদের দাম বলেন। বালিহাঁস ১৫০ টাকা, বকপাখি ১৭০। তারপর একটা টেবিলে কিছু ভোক্তাদের দেখিয়ে ভিডিওগ্রাহক বলছেন, হুজুরেরা খেতে বসে গেছেন। তারপর সেখানকার একজন ‘হুজুর’ হোটেলের কর্মীদের সিলেটি ভাষায় বললেন, …অবা আমাকে বকপাখি দিলাও একটা। আমি যখন দেখেছি তখন পর্যন্ত ভিডিওটি ১৬৫ বার দেখা হয়েছিল। এরপরের সব ভিডিওই করোনা মহামারির সময়ে আপলোড হয়েছে।

‘হরিপুরের পাখির মাংস শিরোনামে ২০২০ সালে ২১ জুলাই একটি ভিডিও ইউটিউবে আপলোড হয় ‘এক্সপ্লোর উইথ শায়খুল (Explore with Shakhul)’ চ্যানেলে। সেখানে দেখা যায়, হরিপুরের ‘নিউ ড্রাইভার রেস্টুরেন্টে’ পাখি বিক্রি হচ্ছে। ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ‘নাহিদ নাজিমের (Nahid Najim)’ ইউটিউবে ‘হরিপুরের বিখ্যাত পাখির মাংস ভক্ষণ, ৪ ধরণের পাখিভোজ’ শিরোনামে একটি ভিডিও আপলোড হয়। এই ভিডিওটি প্রায় ১,২৮০ বার দেখা হয়েছে, ১৩৪টি লাইক ও পাঁচটি ডিজলাইক পেয়েছে।

এই ভিডিওতে নাহিদ অনেকগুলো ধলাবকের মাথা নিচে দিয়ে পা উল্টে ধরে দেখাচ্ছেন এগুলো এখানে রান্না হবে। পরে এই বকের লাশের রান্না দেখানো হয়, এরপর ভিডিওতে তিনি হোটেলের ভেতর বালিহাঁস এবং কোড়া পাখির রান্না তরকারিও দেখান। ভিডিওটির বিজ্ঞাপনে রান্না করা ধলাবকের একটা পা ধরে তিনি নির্দয় হাসির ছবি দিয়েছেন। তার ভিডিওতে বকের দাম ১৩০ এবং বালিহাঁস ১২০ টাকা বলা হয়েছে।

‘চ্যানেল জে টিভি (Channel J Tv)’ ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাদের ইউটিউব চ্যানেলে ‘তারুমিয়া পাখির মাংসের দোকান হরিপুর’ শিরোনামে একটি ভিডিও আপলোড করে। ভিডিওটিতে তারা দেখান, তারুমিয়ার হোটেলে বালিহাঁস ও বক রান্না করে রাখা হয়েছে।

ভিডিওর প্রোফাইলে লেখা আছে, ‘..পাখির মাংস সবসময় মজা হয়, যারা একটু শহরের বাইরে ঘোরাঘুরি পছন্দ করেন আর একটু ডিফারেন্ট খাওয়ার টেস্ট করতে চান তারা শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার বাহিরে হরিপুর যেতে পারেন। ১৫০/১৬০ টাকায় বিভিন্ন ধরণের পাখি-ভাত খেয়ে আসতে পারেন।’

ভাবা যায়! যে দেশে পাখি হত্যা আইনত দণ্ডনীয়, সেখানে পাখিহত্যার এমন বিজ্ঞাপন প্রকাশ্যে বহাল আছে এখনও।

‘হরিপুরে পাখির মাংস খেতে চলে গেলাম’ শিরোনামে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর একটি ভিডিও আপলোড করেন ‘মোহাম্মদ মুরাদ (Mohammed murad)’। কোমরে মাস্ক ঝুলিয়ে তিনি হরিপুর বাজারের ‘তারু মিয়া রেস্টুরেন্টে’ কুড়া ও বালিহাঁস মাংস বিক্রি করা দেখিয়েছেন।

২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ‘আরিয়ান আহমেদ সৌরভ (Ariyan Ahmed Sourav)’ তার ইউটিউব চ্যানেলে ‘বালিহাঁস পাখির মাংস খেতে হরিপুর ভ্রমণ’ শিরোনামে একটি ভিডিও আপলোড করেন। এই ভিডিওতে দীর্ঘসময় ‘তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট (কুমিল্লা)’ এর দোকানের সাইনবোর্ড দেখানো হয়েছে। হরিপুর বাজারের হোটেলে পাখি খাওয়া এভাবেই ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অদরকারি ‘তারুণ্যের স্ট্যাটাস’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে যেন।

বিশেষ করে এসব পাখিহত্যার ভিডিও ও পোস্ট দেখে যারা ‘লাইক’ দিচ্ছেন বা নিজেদের ভেতর এক লুকিয়ে থাকা লোভকে চাঙা করছেন তারা প্রকাশ্যে ‘বন্যপ্রাণী হত্যাকে’ বৈধতা দিয়ে চলেছেন। ভার্চুয়াল বাস্তবতা থেকে মনের গহীন কোণের শরীরী বাস্তবতায়।

ফেসবুকে ডিলিট, কিন্তু মনের খাতায়?

জায়েদ আহমেদ জাদু। ফেসবুক প্রোফাইলে নিজের যত পরিচিতি হাজির করেছেন তাতে বোঝা যায় তিনি এক বিখ্যাতজন। স্ন্যাপথেটিকের প্রধান আলোকচিত্রী, আরবানলি ডিজিটালের বাণিজ্যিক আলোকচিত্রী, এনভিশন অ্যানালাইটিকসের প্রধান, রুলাল টু আরবানের সহ-সম্পাদক এবং যাযাবরের সহ-মালিক। সবকিছু ছাপিয়ে তার আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় তিনি দিয়েছেন। সিলেট ব্লাড ডোনেশন কমিউনিটি-বিডিসির তিনি প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপ্রধান এবং সিলেট বিএড সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে পড়াশুনা করেছেন। এই বিখ্যাতজন ‘বালিহাঁসের মাংস দিয়ে খেয়েদেয়ে ট্যুর সমাপ্ত’ লিখে বেশকিছু ছবি প্রমাণ সমেত তার ফেসবুকে পোস্ট করেন।

তার এই পোস্ট নিয়ে তুমুল তর্ক ওঠে। বন্যপ্রাণীপ্রেমী সোহেল শ্যাম লেখেন, ...বালিহাঁস রান্না করা থাকলেই কি খেতে হবে। হরিপুরে যে হোটেলগুলোতে দেশি পাখি ও পরিযায়ী পাখির মাংস বিক্রি করে তারা অপরাধ করছে। একই অপরাধ আপনিও করলেন। আপনি বনবিভাগকে জানাতে পারতেন বিষয়টা। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে দেশি পাখি ও পরিযায়ী পাখি শিকার, ক্রয়-বিক্রয়, লালন, বহন করা দণ্ডনীয় অপরাধ।

আলোকচিত্রী খোকন থৌনাজম লেখেন, ডমেস্টিক এত এত অপশন থাকতে ওয়াইল্ড বার্ডস কেন খাইতে হবে বুঝিনা..বিবেক জাগ্রত করুন প্লিজ। বিজয় পিকে জয় লিখেন, একজন ফটোগ্রাফার হয়ে এইসব কাজ করেন কষ্ট লাগে আপনাদের এই কাজগুলোতে। এরপর আহসানুল হোসাইন সিয়াম লেখেন, ‘...বালিহাঁস কথাটা রিম্যুভ কর। সেন্সিটিভ অনেকের জন্য। ক্যাপশন এডিট করার পরে আমার কমেন্টটিও ডিলেট করে দে।’

এরপর জাদু তার পোস্টটিকে না সরিয়ে ক্যাপশন মুছে প্রথমে লেখেন, ‘পাখির মাংস দিয়ে খেয়েদেয়ে ট্যুর সমাপ্ত’। আবিদ রহমান লেখেন, ‘খাড়াও পাখিলাভারদের নিয়া আইতাসি।’ আবিদের কমেন্টে জাদু রিপ্লাই দেন, ‘যারা আইছইন এরাও কম নায়।’ আবিদ আবার রিপ্লাই দেন, ‘মান্না চাই’।

সবশেষে তিনি ক্যাপশনটি সংশোধন করে লেখেন, ‘খেয়েদেয়ে ট্যুর সমাপ্ত’।

জাদুরা না হয় পাখি হত্যার এমন নির্দয় স্মৃতি ফেসবুকে মুছে দিতে পারছেন অবলীলায়, কিন্তু জাদুদের মনস্তত্ত্ব থেকে কি মুছে যাচ্ছে পাখির লাশের ঝোল মাখানো লোভ?

সিলেটের পাঁচ কাউন্সিলর!

হরিপুর বাজারে পুরান ড্রাইভার রেস্টুরেন্টে বুনোপাখির মাংস খেতে গিয়েছিলেন সিলেটের সিটি প্যানেল মেয়র ও ২৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ তৌফিক বকস, ১১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রকিবুল ইসলাম ঝলক, ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান, ১৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল মহিত জাবেদ এবং ১০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ।

তাদের সঙ্গে ছিলেন ব্যবসায়ী পারভেজ মাহমুদ অপু এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রায়হান আহমদ। রায়হান আহমদ ২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর রাত ১১ টা ১০ মিনিটে প্রায় দুই মিনিটের একটি ফেসবুক লাইভ ভিডিও আপলোড করেন। যেখানে দেখা যায় উল্লেখিত সবাই ডাহুক পাখি দিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছেন। যদিও তিনি পরে ভিডিওটি মুছে ফেলেন। কিন্তু গণমাধ্যমের কাছে সেই ভিডিওর কপি এবং ফেসবুকে আপলোড করার স্ক্রিনশট রয়ে গেছে।

মন্ত্রীর দেশ কি পাখিশূন্য হবে?

ইউটিউব-ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাবলিক কনটেন্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হরিপুর বাজারে ‘নিউ ড্রাইভার রেস্টুরেন্ট (মালিক-মো. আবদুল হান্নান)’, ‘পুরাতন ড্রাইভার হোটেল (মালিক-মো. তারু মিয়া ও আবুল কালাম), ‘তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট-কুমিল্লা (মালিক-মো. রহমত উল্লাহ)’ এবং বিসমিল্লাহ হোটেলসহ বেশ কটি হোটেল-রেস্টুরেন্টে বুনোপাখি বিক্রি হয়। বুনোপাখি হত্যা ও বাণিজ্যিক ভক্ষণের বাস্তব প্রমাণ ভোক্তারাই হাজির করে রেখেছেন।

বনবিভাগ ও প্রশাসন এসব কনটেন্ট বিশ্লেষণ করতে পারে এবং হরিপুরে বুনোপাখি বিক্রি বন্ধে এক অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক গণসচেতনতা শুরু করতে পারে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী, কোনো বুনো পাখি বা পরিযায়ী পাখি বা মাংস ক্রয়-বিক্রয় দণ্ডনীয় অপরাধ। আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান আছে।

কাউন্সিলরদের পাখি ভক্ষণের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হরিপুর বাজারে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তারু মিয়া হোটেল ও তার পাশের রেস্টুরেন্টকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

মৌলভীবাজার-১ থেকে নির্বাচিত মো. শাহাব উদ্দিন আমাদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী। একটা সময় বিশ্বের বৃহৎ হাওর হাকালুকিকে বিষ দিয়ে নির্বিচার পাখিহত্যা হতো। এই হত্যা কিছুটা কমেছে, কিন্তু হরিপুর বাজারে থামেনি পাখিহত্যার হোটেল।

পরিবেশমন্ত্রীর সিলেট অঞ্চল কি তাহলে একসময় এভাবেই পাখিশূন্য হবে? ভার্চুয়াল বাস্তবতা ও শরীরী বাস্তবতা জাগতে হবে সব ময়দান জুড়েই। জাগাতে হবে মনের গহীন কোণ।

আশা করি শ্রদ্ধেয় মন্ত্রী হরিপুরের পাখিদের সুরক্ষায় দৃষ্টান্তমূলক নজির তৈরি করবেন। ফেসবুকে এই নজির কেউ মুছে দিলেও মানুষ বা পাখির মনের খাতায় যা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।

লেখক: গবেষক

এ বিভাগের আরো খবর