বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নিরাপদ বাহনে কেন এত মৃত্যু?

  •    
  • ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৩:৪৩

জয়পুরহাটে যে ১২ জন নিহত হলেন, সেখানে জয়পুরহাট চিনিকল কর্তৃপক্ষের অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে তিনটি। তার মানে সবগুলো অবৈধ রেলক্রসিং বানিয়েছে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অতএব, এইসব মৃত্যুর দায় আখেরে সরকারের এবং অবৈধ রেলক্রসিংয়ে কারো মৃত্যু হলে সেটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড।

নিরাপদ গণপরিবহন হিসেবে ট্রেন সারা বিশ্বেই স্বীকৃত, সমাদৃত। বাসে যাদের বমি বা অস্বস্তি হয়, তারাও ট্রেনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। রাস্তায় জ্যামে পড়তে হয় না। ফলে ট্রেন সঠিক সময়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে গেলে মোটামুটি নির্ধারিত সময়েই গন্তব্যে পৌঁছে যায়। কিন্তু তারপরও আমাদের দেশে প্রায় সারা বছরই ছোটবড় দুর্ঘটনার কারণে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় রেলসেবা। সবশেষ ১২ জনের প্রাণ গেল জয়পুরহাটে।

শনিবার সকালে জয়পুরহাট সদরের পুরানাপৈল রেলক্রসিংয়ে ট্রেন ও বাসের সংঘর্ষে এই প্রাণহানি হয়। পুলিশ সুপারের বরাতে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, পাঁচবিবিগামী বাঁধন পরিবহনের একটি বাস যখন রেলগেটে ঢুকে পড়ে, তখন ক্রসিংয়ের গেট ছিল খোলা। ফলে উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেনের সামনে পড়ে যায় বাসটি। কিন্তু সরে যাওয়ার আগেই ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, গেটম্যান ওই সময় ঘুমিয়ে ছিলেন।

পুলিশ সুপারের বক্তব্য অনুযায়ী যদি সত্যিই গেটম্যান ঘুমিয়ে থাকেন, তাহলে এই ১২ জন মানুষের মৃত্যুর দায় তার। তার বিরুদ্ধে কি হত্যা মামলা হবে? এর আগে এরকম গাফিলতির কারণে যেসব দুর্ঘটনা হয়েছে, তার কোনো বিচার হয়েছে?

বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেসব অবৈধ রেলক্রসিং বানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? যেসব রেলক্রসিং অরক্ষিত বলে সংবাদ হয়েছে, সেসব ক্রসিং বন্ধ করা বা সেখানে কি গেট ও গেটম্যান নিয়োগ করা হয়েছে? সহজ উত্তর হলো, না।

দেশে মোট লেভেলক্রসিং সংখ্যা ২,৬১২টি। এর মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত লেভেলক্রসিং হচ্ছে মাত্র ১,৪১২টি। আর অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১,২০০টি। এসব অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানানোর সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। নিজেদের প্রয়োজনেই যে যখন পেরেছেন ইচ্ছেমতো রাস্তার মধ্যে লেভেল ক্রসিং বানিয়েছেন। এসব অবৈধ ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই।

রেল বিভাগের বরাতে সময় টেলিভিশনের একটি সংবাদে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে লেভেল ক্রসিংয়ের কাটা পড়ে নিহত হয়েছেন ৫৪ জন। ২০১৫ সালে ১৩ জন। ২০১৬ সালে ১৩ জন। ২০১৮ সালে ১৭ জন। আর ২০১৯ সালে ২০ জন। অথচ অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব লেভেল ক্রসিংয়ের বিরুদ্ধে কখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

গত বছরের ২১ জুলাই প্রথম আলোর সংবাদ শিরোনাম-রেলে বিপুল ব্যয়, তারপরও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। খবরে বলা হয়, রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, তার ৮৯ শতাংশই ঘটে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে। কখনো বাসের সঙ্গে, কখনো মাইক্রোবাসসহ অন্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে এসব প্রাণহানি ঘটে। অথচ এসব ক্রসিং নিরাপদ করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকারে নেই।

ওই বছরের ১৪ নভেম্বর ঢাকা ট্রিবিউনের একটি খবরে বলা হয়, রেলের পশ্চিমাঞ্চলে অনুমোদন থাকা ৭১৫টি লেভেল ক্রসিং গেটম্যান ছাড়া চলছে। এগুলোর সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টানিয়ে দায়িত্ব সেরেছে কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে বৈধতা না থাকা ৩৩৯টি ক্রসিংয়ের সামনে সেই সতর্ক বার্তাও নেই। এতে বিভিন্ন যানবাহনকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে রেললাইন পার হতে হয়।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অবৈধ লেভেল ক্রসিং সবচেয়ে বেশি বানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তাদের লেভেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ৫১৬টি। এরপরেই আছে ইউনিয়ন পরিষদ। তাদের অবৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ৩৬৩টি। এছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ১১টি। পৌরসভার ৮০টি। সিটি করপোরেশনের ৩৪টি। জেলা পরিষদের ১৩টি। চট্টগ্রাম বন্দরের তিনটি। বেনাপোল বন্দরের একটি।

সবশেষ জয়পুরহাটে যে ১২ জন নিহত হলেন, সেখানে জয়পুরহাট চিনিকল কর্তৃপক্ষের অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে তিনটি। তার মানে সবগুলো অবৈধ রেলক্রসিং বানিয়েছে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অতএব, এইসব মৃত্যুর দায় আখেরে সরকারের এবং অবৈধ রেলক্রসিংয়ে কারো মৃত্যু হলে সেটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ডিসেম্বরে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং চিহ্নিত করে প্রতিবন্ধক দিতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধের নির্দেশনা কেন দেয়া হবে না- তা জানতে চায় উচ্চ আদালত। পাশাপাশি নিরাপদ রেল চলাচল নিশ্চিত করতে অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ ও বৈধ লেভেল ক্রসিং চিহ্নিত করে প্রতিবন্ধক দেয়ার বিষয়ে অগ্রগতি জানাতে বলে আদালত।

রেল দুর্ঘটনার পেছনে মোটামুটি যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে অপরিকল্পিত ও অবৈধ রেল ক্রসিংয়ের বাইরে রেলক্রসিংয়ে প্রহরী না থাকা, রেললাইন অতিক্রম করার সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার, বেশির ভাগ রেল ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া, ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যালিং ব্যবস্থা এবং দুর্বল অবকাঠামো, চালকদের কারিগরি অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা এবং পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতির সংকট অন্যতম।

যদিও প্রতিটি ঘটনার পরেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সবশেষ জয়পুরহাটের দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানেও তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু এসব তদন্ত কমিটি আসলে কী করে বা তদন্ত রিপোর্টে কী থাকে এবং সেই রিপোর্টে কাউকে দায়ী করা হলে তারা শাস্তির মুখোমুখি হয় কি না; নাকি এসব তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় দায়ীদের বাঁচানোর জন্য- সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

২০১৩ ও ২০১৪ সালের ১৬টি দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনের বরাতে বিবিসির একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে আট জনকে তিরস্কার এবং তিন জনকে সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া ১৮ জনের বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন ৪৫০ টাকা বেতন কাটা থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের বেতন কেটে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।

বাস্তবতা হলো, তদন্ত কমিটিগুলো এমনভাবে গঠন করা হয় যাতে করে এই কমিটিতে যারা থাকেন, তারা তদন্তে একেবারে নিচের পর্যায়ের ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন। এর ফলে উপরের পর্যায়ে কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। তাছাড়া রেল বিভাগের লোকজনই এসব তদন্ত কমিটিতে থাকার ফলে তারা নিজেদের সহকর্মীদের বাঁচিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।

আর সব আইনেই যেহেতু ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’ বলে একটা বিধান থাকে এবং দুর্ঘটনার জন্য হিউম্যান এরর (মানবিক ভুল) এবং টেকনিক্যাল এরর (কারিগরি ত্রুটি)-কে দায়ী করা হয়, ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনাকেও ‘হিউম্যান এরর’ বলে লঘু শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়। আর কারিগরি ত্রুটি হলে সেজন্য কাউকেই দায়ী করা যায় না। কারণ তখন বাজেট ও বরাদ্দের অজুহাত দেয়ার সুযোগ থাকে। এসব কারণে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্ঘটনা বা অনিয়মের তদন্ত সেই প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে দিয়ে না করানোর দাবিটি অনেক পুরনো। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই।

সুতরাং, অন্তত ১২ জন মানুষ নিহত হয়েছেন বলে সব গণমাধ্যমেই প্রধান শিরোনাম হয়েছে জয়পুরহাটের এই ঘটনাটি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সারা দেশের সবগুলো অবৈধ রেলক্রসিং সিলগালা করে বন্ধ করে দেয়া হবে বা অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলো আগামীকাল থেকেই সুরক্ষিত হয়ে যাবে। তার অর্থ এই নয় যে, সবগুলো রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগ করা হবে এবং তারা সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করবেন।

এত বড় একটি ঘটনায় এই যে এতগুলো মানুষ নিহত হলেন, তার দায় নিয়ে যে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন- তাও নয়। বরং খুব দ্রুতই এই ঘটনার রেশ কেটে যাবে। নতুন কোনো ইস্যু এলে গণমাধ্যমের শিরোনাম থেকেই জয়পুরহাট গুরুত্বহীন হতে থাকবে এবং পরবর্তীতে আরেকটি এরকম ঘটনা ঘটলে সেটি আবার প্রধান শিরোনাম হবে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গোডাউনে লাগা আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যুর পরে যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তাদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। তার প্রমাণ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ আগুনে ৭১ জনের প্রাণহানি। কারণ নিমতলীর আগুনের ঘটনায় তদন্ত রিপোর্টে আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। হলে নয় বছরের মাথায় গিয়ে এরকম আরেকটি ট্র্যাজেডি দেখতে হতো না দেশবাসীকে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনের সরল স্বীকারোক্তি, অনেক চেষ্টা করেও কেমিক্যালের গোডাউন সরানো যায়নি। এই স্বীকারোক্তির মধ্যে তার অসহায়ত্ব যেমন আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সাহসিকতার অভাব। রেলেও যে নিয়মিত বিরতিতে প্রাণহানি হয়, তারও একটি বড় কারণ এই রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

এ বিভাগের আরো খবর