প্রতিটি মানুষের আলাদা-আলাদা ব্যক্তি সত্তা থাকে, থাকে মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি। আর বিষয় কিংবা কোনো বস্তুকে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাও সবার এক হয় না। আবার প্রতিটি মানুষ কী ধারণ করে, কী পালন করে, কী তার দর্শন- এটিরও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে, মানুষ যে বৃত্তের মাঝ থেকে বেড়ে উঠে, বড় হয়েছে-এটির বাইরে চিন্তার জগৎ তেমনটা সাজাতে পারে না।
অর্থাৎ শিশুকাল থেকে প্রতিটি মানব সন্তান কোথায় বেড়ে উঠেছে- পরিবার, পারিবারিক অভিভাবক-শিক্ষা, বিশেষ করে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ধর্ম চর্চার বিষয়গুলো কীভাবে পেয়েছে- এর উপরেই বেশিরভাগ মন-মগজের জায়গাটি সৃষ্টি হয়, নিজেকে সেভাবে গঠন করে।
এ অঞ্চলের দেশগুলো- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, বার্মার দিকে তাকালে এর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থনীতি বা স্বাবলম্বী-সক্ষমতার বিষয়টি জড়িত থাকলেও অনেকে আবার সমাজ-রাষ্ট্রে প্রভাব-প্রতিপত্তির জায়গাজুড়েও তাদের সন্তানকে মৌলিক বিষয়গুলো- শিক্ষা দিতে অনেকটাই ব্যর্থ। শুধু একাডেমিক শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষার দৌড়ে যতটা এগিয়ে, ততটাই পিছিয়ে আছে মানবিক মূল্যবোধ বা নৈতিক শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে!
আরেকটি বিষয়ও প্রতীয়মান হয়েছে, ধর্মীয় শিক্ষা বিশেষ করে মৃত্যুর পর ‘ভোগ-বিলাসী’ স্বপ্নগুলো একশ্রেণির মানুষকে এতটাই প্রলুব্ধ করে, যার ফলে অনেকের দুটি ছেলে হলে একটিকে ধর্মীয় পণ্ডিত বানাতে হয়, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হয়। আমার ব্যক্তিগত অনেক পরিচিত থেকে দূরের আত্মীয়স্বজনও এমন চিন্তা-ভাবনা থেকে ইসলাম ধর্মের শিক্ষা গ্রহণের জন্য সন্তানকে মাদ্রাসায় দিয়েছেন। আবার এমন অনেককে পেয়েছি, বাবা-মা উভয় জীবিত অথচ, তাদের সন্তান এতিমখানায় পড়াচ্ছেন।
তাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারি, একজনকে কোরআনে হাফেজ বানালে চৌদ্দগোষ্ঠী জান্নাতে যেতে পারবে। বংশে একজন আলেম বা হাফেজ থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তারা। আবার যাদের সন্তান এতিমখানায় পড়াচ্ছেন, তারা অনেকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে, আবার অনেকে হুজুরের কথা শুনে, অথবা অজানাশোনা জ্ঞান-পরামর্শ থেকেই এতিমখানায় পাঠাচ্ছেন।
এই যে নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে নানামুখী ব্যক্তি সত্তা তৈরি হচ্ছে- এর দায় কার? রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কেন সার্বজনীন শিক্ষা পদ্ধতি সৃষ্টি করতে পারেনি, কেন বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছরের বয়সের ঘরে দাঁড়িয়ে আজকের তৃতীয় প্রজন্মকে একমুখী বা বাস্তবসম্মত শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে- তা খতিয়ে দেখা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। আগামী প্রজন্ম কোনমুখী হবে- সেই সিদ্ধান্ত নেয়া সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। কারণ, পারিবারিক শিক্ষাও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ।
আমরা জানি, আমাদের দেশের এক সময়কার স্বীকৃত রাজনীতি ছিল পাকিস্তানপন্থি! সরকারও পাকিস্তানি ছায়া সরকার হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। আবার এই পাকিস্তানি ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করতেই মূলত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেই সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমোদন পেয়েছে।
সর্বোপরি রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র থেকেই ‘বিসমিল্লাহি রাহমানির রাহিম’ এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’কে যুক্তকরণের মধ্য দিয়ে আজকের যে তৃতীয় প্রজন্ম সমাজ-রাষ্ট্রে বিচরণ করছে, তাদের এক শ্রেণি কথায়-কথায় ইসলামকে টেনে নিয়ে আনছে, ইসলামিক শরিয়া মোতাবেক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে, ভাস্কর্য-মূর্তির বিতর্কে অজানা ধ্যান-ধারণা আর কথিত হুজুরের ধার করা জ্ঞান নিয়ে মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করছে। মূলত এগুলো অপরাজনীতি ধারণ-লালন করার বহিঃপ্রকাশ!
কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ-চৌদ্দ দলের সরকার কী করছে- এটিও মূল্যায়নের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এই সরকার উন্নয়নের রাজনীতিতে যতটা সফল, ততটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে, মন-মগজ বিকশিত করার উদ্যোগ চোখে পড়েনি। একটি দেশের জনগণ কেমন হবে, কী ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করবে, কীভাবে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ধর্ম চর্চার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেবে, একটি দেশ ও জাতি গঠনে কার কী ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সন্তানের অঙ্কুর থেকেই শেখানো হবে কি না- সে ব্যাপারে ইতিবাচক দর্শনগুলো রাষ্ট্রকেই নির্ধারণ করতে হয়, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
আর এখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় কর্মকর্তার দক্ষতা, আন্তরিকতা কিংবা দায়িত্ববোধের জায়গাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
যেমন, ২০২০ শিক্ষাবর্ষের জন্য ২০১৯ সালে পুনর্মুদ্রিত নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতি দেখা গেছে। ১০৬ নম্বর পৃষ্ঠার ৭.২ পরিচ্ছেদে ‘বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থা’ অধ্যায়ের তিন নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে’।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মূলত কী অর্জন করে- সে বিষয়ে পঞ্চাশ বয়সের ঘরে বাংলাদেশ দাঁড়িয়েও সঠিক তথ্যটি শিক্ষার্থীদের জানাতে ব্যর্থতা রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ছিল মুজিবনগর সরকার আর ‘স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। কিন্তু, বইটির ২২ নম্বর পৃষ্ঠার ৬ ও ৭ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে ‘তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি।’
এভাবে নবম ও দশম শ্রেণির পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ের জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি অনুচ্ছেদের ৪ নম্বরে (৬৬ নম্বর পৃষ্ঠায়), অষ্টম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ের ৩০ নম্বর পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারার ৪ ও ৫ নম্বর লাইনে, ১৭ নম্বর পৃষ্ঠার ২ নম্বর লাইনে, ৭৯ পৃষ্ঠার ১০ ও ১১ নম্বর লাইনে, ৮০ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে, সপ্তম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ৭ নম্বর পৃষ্ঠার, ১০ নম্বর পৃষ্ঠার ৫ ও ৬ নম্বর লাইনে, ৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায়, ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস অধ্যায়’-এর ২ নম্বর পৃষ্ঠার শেষ লাইনের শেষ শব্দ ও ৩ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে বিকৃতি তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘শীর্ষ নেতা’ হিসেবে। নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ের ২২ নম্বর পৃষ্ঠায় একাধিক বিকৃতি দেখা গেছে, জাতীয় চার নেতার নামের আগে জাতীয় নেতা লেখা হয়নি, ‘শীর্ষ নেতা’ লেখা হয়েছে। এমনিভাবে ওই বইয়ে অজস্র ভুল আসলে ইতিহাস বিকৃতি, যা অঙ্কুর থেকেই বিভ্রান্ত করার কৌশল।
বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, বন্যতা থেকে বর্বরতা আর বর্বরতা থেকে মানব সন্তান ধীরে ধীরে সুশৃংঙ্খল জীবন-যাপনে এগিয়ে আজকের এই আধুনিক সভ্যতায় এসে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা মানব জীবন মানের উন্নয়ন করেছে। আর এই বর্বরতা থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স তথা জ্ঞানী মানুষের আবির্ভাব দুই লক্ষ বছর আগে হলেও মানব সভ্যতার গোড়া পত্তন হয়েছেন আজ থেকে মাত্র পাঁচ হাজার বছর আগে।
অভিধানের ভাষায়, সভ্য জাতির জীবনযাত্রা নির্বাহের পদ্ধতি, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও বিদ্যার অনুশীলনহেতু মন-মগজের উৎকর্ষ সাধন করাই হচ্ছে সভ্যতা।
আর মানব সন্তানকে সভ্য করে তুলতে হলে শিক্ষার বিকল্প এখনো সৃষ্টি হয়নি যেটা রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারণ করা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি রাজনৈতিক হোঁচটের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার হোঁচটও বড় আকারে খেয়েছে, বিভ্রান্ত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। আর শ্রেণিবিভেদ শিক্ষার মাঝে প্রকৃত শিক্ষা থেকে যেমন একদিকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রজন্মের মাঝে বিভ্রান্ত জন্ম নেয়ার সুযোগও বিদ্যমান।
আর এই জায়গায় গবেষণা করে রাষ্ট্রকেই ঠিক করতে হবে, দেশ ও জাতি গঠনে কী ধরনের শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে আগামীর প্রজন্মের বাংলাদেশ গঠন করবে, কোন প্রজন্মের হাতে বাংলাদেশ তুলে দেবে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)