কিছুদিন আগে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার এক জরিপের উপর আমাদের দেশের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ও নিকটবর্তী কিছু দেশের অর্থনৈতিক সূচকের পূর্বাভাসের তুলনামূলক আলোচনা হচ্ছিল আমার বন্ধু মহলে।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সূচকগুলো যথেষ্ট নিচের দিকে অবস্থান করায় অর্থনৈতিক ওই আলোচনাকে কেউ কেউ ‘রাজনৈতিক আলোচনা’ বলে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাদের অজুহাত ছিল, আমাদের ওই বন্ধু ফোরামটি একটি ‘অরাজনৈতিক ফোরাম’। তাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় উজ্জীবিত বন্ধুরা ব্যাঘ্রের মতো গর্জে উঠে। ফোরামে রীতিমতো প্রতিবাদের ঝড় ওঠে যা সম্পূর্ণ দেশপ্রেমের আবেগ থেকে উত্থিত, যেখানে রাজনীতির চিহ্নমাত্র ছিল না।
আমাদের প্রজন্ম (ছেষট্টিত্তোর) যথার্থ মুক্তিযুদ্ধেরই প্রজন্ম, তাই তাদের এই আবেগ প্রশংসার দাবিদার। তাদের প্রতিবাদই জানান দেয়, ‘আমরা এখনও জীবিত আছি।’ এই জানান দেয়াটাই তাদের দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ।
যে কোনো ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, জাতি, সমাজ বা মানবের কাছেই যুদ্ধ কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। যুদ্ধের নির্মমতা ও হিংস্রতা কখনও একটি নির্যাতিত জাতির স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। এ যে রক্তে লেখা একটা ইতিহাস। যে ব্যক্তি বা জাতি যুদ্ধে তার বা তাদের নিরপরাধ আপনজন হারিয়েছে, অকারণে অত্যাচারিত হয়েছে- তারাই বোঝে হারানোর বেদনার গভীরতা কতটুকু! এ ক্ষত মুছে ফেলার নয় বরং তা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকে আজীবন।
আমার বন্ধুমহলের সেদিনের ঘটনাটি ছিল অনেকটা স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তানি শাসকদের ধর্মের দোহাই দিয়ে এই এলাকার শিল্প ও সাহিত্যচর্চাকে থামিয়ে দেয়ার মতো একটা অপচেষ্টা মাত্র। অথবা তার চেয়েও জঘন্য। কারণ, স্বাধীনতার আগে ১২০০ মাইল দূরে দুটি ভূখণ্ডের অবস্থান হলেও তখন রাষ্ট্র ছিল একটি।
পাকিস্তানিদের অত্যাচার আর শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেই আমরা স্বাধীন হয়েছি, তাই সেই অত্যাচারী দেশের কথা বলায় আমাদের দেশের লোক কেন অসন্তুষ্ট হবে? কী দায় আছে তাদের? কেনই বা তারা বিরক্ত হবে এবং কেনই বা তাদের বিরুদ্ধে সঠিক কথাটি বলতে গেলে আলোচনা থামানোর ঔদ্ধত্য দেখাবে?
ওই আলোচনায়, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যথেষ্ট সুযোগ থাকার পরেও দেশটি কেন পিছিয়ে যাচ্ছে, তার কারণগুলো মূলত তুলে ধরা হচ্ছিল। যার মধ্যে পাকিস্তানে নেতৃত্বের সঙ্কট ও নেতৃত্ব নিয়ে কিছু নেতিবাচক কথা থাকায় পাকিপ্রেমী বাংলাদেশি কারো কারো গাত্রদাহ শুরু হয়। অথচ আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়কে পাকিস্তান যখন তাচ্ছিলতার সঙ্গে অগ্রাহ্য করে এবং তাদের পার্লামেন্টে আমাদের রায়ের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করে, তখন কিন্তু তারা হাতে তালি বাজিয়েছে।
পাকিস্তান সরকার তাদের বক্তব্যে এবং পার্লামেন্টে আইন পাশের মাধ্যমে একটা বিষয় সুষ্পষ্ট করে দেয় যে, আমাদের দেশের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীরা আসলে তাদেরই লোক এবং তাদেরই মানসপুত্র। দীর্ঘ ৪৯ বছর অতিবাহিত হলেও এদেশে গণহত্যাকারী পাকিস্তানের নেতিবাচক নেতৃত্বের কথা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কেন তাদের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো- ভাবলে সত্যি বিস্মিত হতে হয়, তাদের জন্য লজ্জা পেতে হয়।
ভগ্ন হৃদয়ে বলতে হচ্ছে, দেশে এখনো বহাল তবিয়তে একটা বিশাল গোষ্ঠী আছে, যারা পাকিস্তানে বৃষ্টি হলে এ দেশে ছাতা ধরে। পাকিস্তানি কোন নেতার পিঠ চুলকালে তারা নিজের পিঠ চুলকিয়ে স্বস্তি পায়, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
ছত্রধারকরা যখন কোনঠাসা ঠিক তখন আমাদের এক বন্ধু ফোরামের হোয়াটসঅ্যাপে একটি পোস্ট দেয় (আমার মনে হয়েছে বিষয়টাকে স্বাভাবিক করার জন্য)। পোস্টটি আমার কাছে আমাদের ফোরাম ও সময়োপযোগী বলে মনে হয়েছে। পোস্টের সার কথা হচ্ছে, মানুষের জীবন খুব সংক্ষিপ্ত তাই মানুষের ক্ষুদ্র দোষগুলো এড়িয়ে চলা বা ক্ষমা করে দেয়াই শ্রেয়। বিষয়টি আমাদের ফোরামের জন্য বেশ প্রাসঙ্গিক হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে ওই পোস্টের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। পাশাপাশি এ কথাও স্বাভাবিকভাবে আমার মনে উদয় হয় যে, সব ক্ষেত্রে কি ক্ষমা করা উচিত? বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলে বা যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধাচারণ করলেও কি কোনো বাক্যব্যয় ব্যতিরেকে ক্ষমা করা যুক্তিসংগত?
এ বিষয়টি যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন একটি পছন্দসই প্রসঙ্গ মাথায় চলে আসে। এ বিষয়ে ইসলামিক আইন কী বলে বা রাষ্ট্রীয় আইন বিষয়টিকে কীভাবে দেখে? এর অনুসন্ধান হওয়া আবশ্যক।
এই লেখার মূল উপজীব্য দুটি: সংক্ষিপ্তভাবে বললে তা হচ্ছে- আইনের দৃষ্টিতে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা ও শাস্তি। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে একাত্তরের পাকিস্তানি জান্তার সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয় ও ইসলামিক আইনের চোখে ক্ষমা ও শাস্তি। পাশাপাশি থাকবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রাসঙ্গিক বিষয়।
আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধী বা তাদের দোসররা মনে করে, তারাই দেশের প্রকৃত ‘ইসলামের ধারক ও বাহক’। তারা এটাও আশা করে, অন্যেরা তাদের অনুসরণ করবে। তাই এখানে এটাও দেখার চেষ্টা করা হবে, প্রকৃতপক্ষে তাদের ইসলামিক আইন বা পবিত্র কোরআনের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাবোধ ও আনুগত্য রয়েছে। দুটি আইনে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির বিষয়টি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে ইসলামিক আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় আইনের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তাও অনুধাবন করা যাবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। যে ব্যক্তি অন্যকে ক্ষমা করে তাকে তিনিও ভালোবাসেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ধৈর্যধারণ করে এবং ক্রোধ সম্বরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে, আল্লাহ সে সকল সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত: ১৩৪)।
পারিবারিক, সামাজিক ও জীবনের অন্যান্য পর্যায়ে মানুষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেতেই পারে। তবে এমন হলে, প্রত্যেকের দায়িত্ব হলো অন্যকে ক্ষমা করে দেয়া এবং একইসঙ্গে পারস্পরিক ভুল-ত্রুটি শুধরে দেয়া। এতে সম্পর্ক ও বন্ধন অধিকতর মজবুত ও অটুট হয়। এখানে যে বিষয়টি আমরা সাধারণত ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাই তা হচ্ছে- পারস্পরিক ভুল-ত্রুটি শুধরে দেয়ার কাজটি। বাস্তবে মানুষ প্রায়ই নিজের স্বার্থে বা সবলের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে শুধু দুর্বলকেই সবলের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে বা সবলের দোষ-ত্রুটি ঢাকার জন্য আপস-মিমাংসা অথবা সন্ধির কথা বলে। অর্থাৎ নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বা সবলের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় ইসলামের নির্দেশনার ভুল ব্যাখ্যা করে শুধু দুর্বলকেই বলা হয়- ইসলামে ক্ষমা হচ্ছে মহত্বের লক্ষণ। এটা হচ্ছে শ্রেফ এক ধরনের মোনাফেকি।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম কি সব ক্ষেত্রে ক্ষমা করতে বলে?
না, ইসলাম সব ক্ষেত্রে ক্ষমা করতে বলে না বরং ক্ষেত্রবিশেষে, অপরাধ দমাতে অসৎকাজকে নিষেধ বা প্রতিহত করার আদেশ দেয়। প্রথমত, বুঝিয়ে শুনিয়ে অপরাধীকে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে অপরাধ দমাতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তা সম্ভব না হলে, অসৎকাজ দমানোর জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, তাও সম্ভব না হলে, অন্তত অপরাধীকে শুধু অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতে বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি মনে মনে ঘৃণাটুকুও পোষণ করে না, সে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃত মুমিন নয়।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, চোখের সামনে একটা অন্যায় দেখলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে মারপিট শুরু করে দিলাম। কাজটি প্রকৃত পক্ষে ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায় কিনা এবং প্রতিহত করার মতো শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক শক্তি ব্যক্তির রয়েছে কি না- তা বিবেচনায় নিতে হয়। এ বিষয়ে ইসলামে একটা নির্দেশিকা রয়েছে যা প্রতিহতকারীর জানা থাকা প্রয়োজন, নইলে প্রতিহতকারী অনেক ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হলেও হতে পারেন। তাই নিজের শক্তি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে মনে মনে ঘৃণা পোষণ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিষয়টি ছেড়ে দেয়াই উত্তম। সেটিও ধর্মীয় অনুশাসনের পর্যায়ভুক্ত।
এটা মনে করাই যেতে পারে যে, আমাদের সেই বন্ধুর দেয়া পোস্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ছোটখাটো দোষত্রুটি বা অপরাধ সংগঠিত হলে এবং তার ভুক্তভোগী যদি তিনি একাই হন, সে ক্ষেত্রে ক্ষমা করে দেয়ার এখতিয়ারও একান্তই তার একার। সে ক্ষেত্রে ক্ষমা করলে সেটা হবে তার উদারতা। এ ধরনের ক্ষমাকে ইসলাম উৎসাহিত করে। কিন্তু সে অপরাধের ভুক্তভোগী যদি একাধিক ব্যক্তি বা দল বা প্রতিষ্ঠান বা সমাজ বা রাষ্ট্র হয়, সে ক্ষেত্রে ক্ষমা করার এখতিয়ার শুধু তার একার আর থাকে না। এমন অবস্থায়, কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা সমাজ তাদের নিজস্ব আইনের বিধান দিয়ে বিচার করে শাস্তি বা ক্ষমা নিশ্চিত করে। আবার এমন কিছু অপরাধ রয়েছে যার বিচার সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা সমাজকে ছাড়িয়ে রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। তখন রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী বিচারের রায়ে শাস্তি বা ক্ষমা নির্ধারিত হয়ে থাকে। আর এ কারণেই আজ পৃথিবীব্যাপী এত আইন-আদালত গড়ে উঠেছে।
এ কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, এমন কিছু দোষ-ত্রুটি বা অপরাধ রয়েছে, যেক্ষেত্রে অপরাধী অনুতপ্ত হওয়ার আগেই ক্ষমা করে দিলে সে অনেক ক্ষেত্রে অনুভবই করতে পারবে না যে সে কোন অপরাধ করেছে। তাই সে আবার একই অপরাধে প্রবৃত্ত হয়। বিচার না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ আজ সমাজে অহরহ ঘটে চলেছে। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্ষমা কোনো দুর্বলতার লক্ষণ নয়. তবে ক্ষমা করার আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, অপরাধী তার কৃতকর্মের ভুল বুঝতে পেরেছে বা অনুতপ্ত হয়েছে।
আর সেই অপরাধ যদি (১) খুন বা হত্যার মতো মারাত্মক হয়, তাহলে তো কথাই নেই। হত্যা প্রমাণিত হলে ইসলামে বিচার একমাত্র মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ডকে পশ্চিমা ভাবাদর্শে দীক্ষিত কিছু বুদ্ধিজীবী সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখে থাকেন, তবে ইসলামে এর পক্ষে যথেষ্ঠ শক্তিশালী এবং অভাবনীয় যুক্তি রয়েছে।
এই বিশ্বচরাচরে আল্লাহ তায়ালার যত সৃষ্টি রয়েছে, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে মানুষ। মানুষ আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয়তম সৃষ্টি। আর তাই তিনি ফেরেশতাদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে মানুষকে এই জমিনে তার প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দিয়েছেন (সূরা বাকারা: ৩০)।
শুধু তাই নয়, আল্লাহর সুস্পষ্ট বাণী হচ্ছে, এই বিশ্বের সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন কেবল মানুষেরই জন্য (সূরা বাকারা: ২৯)। আল্লাহ তায়ালা যেমন মায়া ও ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি মায়া ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি মানুষ জাতির সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আল কোরআনে আল্লাহ পাক একজন মানুষকে হত্যা করাকে গোটা মানব জাতিকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে একজন মানুষের জীবন রক্ষাকেও তিনি গোটা মানবজাতির জীবন রক্ষা বলে সাব্যস্ত করেন (সূরা মায়েদা: ৩২)।
যেহেতু একজন মানুষের জীবনের দাম এত বেশি, তাই তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যেও কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছেন (সূরা বাকারা: ১৭৮, ১৭৯)। এখানে বলা হচ্ছে, অন্যায়ভাবে যখন কোনো ব্যক্তি কোনো মানুষকে হত্যা করে তখন সে এতটাই অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে যে, সে পৃথিবীতে থাকার বা মনুষ্য সমাজে বাস করার অধিকার হারায়। সে হয়ে পড়ে মানব সমাজের জন্য এক মারণঘাতী ব্যাধি, মানব সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য যার অপসারণ অপরিহার্য। আর অপসারণের কাজটিই হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে।
এখানে প্রণীধানযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে, ইসলাম এখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব মানুষের কথা বলেছে। ফলে, এ কথা সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কোনো ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মানেই হচ্ছে অন্যান্য মানুষের নিরাপত্তা বিধান ও নিরাপদ জীবন লাভের নিশ্চয়তা প্রদান।
মানবজাতির মধ্যে যারা আবার আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের বিনাবিচারে অন্যায়ভাবে হত্যা করার ব্যাপারে কোরআনে রয়েছে আরও কঠিন হুঁশিয়ারি। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন (সূরা নিসা: ৯৩)।
সার কথা, ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তছাড়া, ঘাতকের জন্য আল্লাহর রোষানলে পড়ে ধ্বংস হওয়ার মতো কঠোর শাস্তি তো রয়েছেই। আখেরাতে তার জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। মৃত্যুর শাস্তির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনের সঙ্গে ইসলামি আইনের তেমন কোনো বিরোধ নেই।
(২) ইসলামি আইন শাস্ত্রে ধর্ষকের শাস্তি মূলত ব্যাভিচারকারীর শাস্তির অনুরূপ। ব্যাভিচার উভয়ের সম্মতিতে সংগঠিত হয়। তাই এখানে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য একই শাস্তির বিধান রয়েছে। অবিবাহিত হলে প্রকাশ্যে এক শ বেত্রাঘাত এবং বিবাহিত হলে ঢিল মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু ধর্ষণ যেহেতু একপেশে, এখানে শুধু ধর্ষকের শাস্তি হয়। নির্যাতিত বা নির্যাতিতার শাস্তি হয় না। এ ক্ষেত্রে শাস্তি ব্যাভিচারকারীর শাস্তির অনুরূপ, তবে বলপূর্বক হওয়ায় অতিরিক্ত সাজা আরোপের বিধান রয়েছে। ধর্ষণে মৃত্যু হলে অবিবাহিত হোক বা বিবাহিত, উভয়ই ক্ষেত্রে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হয় (সূরা নূর, ইবনে মাজাহ: ২৫৯৮, সহিহ বোখারি: ৬৯৪৯, সহিহ মুসলিম)। ধর্ষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়েও ইসলামি আইনে শাস্তির পরিমাণ কিছুটা বেশি।
(৩) অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ, চুরি, ডাকাতি এগুলো জুলুমের পর্যায়ে পড়ে। জুলুম একটি আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ নির্যাতন বা অবিচার। ‘জুলুমের শাস্তি না পেয়ে কেউ মরবে না (সুরা ইউনুস আয়াত: ২৩ শেষাংশ)।’ জুলুম শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে হতে পারে। রাসূলে কারিম (সা.) বলেছেন, দুটি এমন গুনাহ আছে যার শাস্তি পরকালে অবধারিত থাকার পরেও দুনিয়াতে দিয়ে দেয়া হয়। এর একটি হলো- কারো ওপর জুলুম করা, অন্যটি হলো আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা (তিরমিজী ও আবু দাউদ)।
আরেকটি হাদিসে আছে রাসূল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার বান্দা! আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং এই জুলুমকে তোমাদের মধ্যেও হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর জুলুম করো না।’” (মুসলিম শরিফ: ৬৭৩৭)। জুলুম ছোট বড় হাজার হাজার ধরনের হতে পারে, এজন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রে, বিভিন্ন সমাজে বা গোত্রে এর শাস্তিও নানাবিধ হয়ে থাকে।
(৪) এছাড়া, অন্য ধর্মের মানুষের উপর মুসলমানের নির্যাতনের বিষয়ে হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন ‘জেনে রেখ! কোনো মুসলমান যদি অমুসলিম নাগরিকের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন করে, কোনো অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোনো জিনিস বা সহায়-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়; তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমি তাদের বিপক্ষে অমুসলিমদের পক্ষে অবস্থান করব’ (আবু দাউদ)। হাদিসে আরও এসেছে হযরত আবুবকর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ঘোষণা করেছেন ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিমকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’ (মুসনাদে আহমেদ)।
(৫) আল্লাহ মানুষকে মোকলুকাতে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে ঘোষণা করেছেন, তাই রাসূল (সা.) সব ধর্মের মানুষের প্রতি সম্মান দেখাতেন। একবার এক ইয়াহুদির লাশ রাসূল (সা.) এর সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে ওই লাশের সম্মানার্থে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাকে তখন হজরত জাবের (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এটি তো ইয়াহুদির লাশ! তখন রাসূল (সা.) বললেন তিনি কি মানুষ নন? (বুখারি)।
এবারে একটু অবিভক্ত পাকিস্তানের সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখা যাক। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ ভোটে বিজয়ী হয় (পূর্ব পাকিস্তানে গণপরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৬৭ আসন)।
সে অনুযায়ী পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের এককভাবে সরকার গঠনের কথা, কিন্তু কখনোই এ বিষয়টি পাকিস্তানের পাঞ্জাবি-সিন্ধু চক্র এবং তথাকথিত ইসলামি নামধারী কোনো রাজনৈতিক দল মেনে নিতে পারেনি। তারা আওয়ামী লীগ তথা বাঙালির হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করে বাঙালি নিধনে নেমে পড়ে। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সবকয়টি তথাকথিত ইসলামি দলও ইসলামের তাগিদকে বিসর্জন দিয়ে পাঞ্জাবি-সিন্ধু- মওদুদি গংয়ের সঙ্গে হাত মিলায় এবং এদেশে গণহত্যায় তাদের সহযোগী হিসেবে সামিল হয়।
তাদের কাউকে তখন দেখা যায়নি এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে বা আপস-মীমাংসার জন্য কাজ করতে, বরং তখন প্রত্যেকটি ইসলামের সাইনবোর্ডধারী দল জাতীয় নির্বাচনে হেরে, নাস্তানাবুদ হয়ে, অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য একজোট হয়ে পাকিস্তানি জান্তার ছত্রছায়ায় বাঙালি নিধনে নেমে পড়ে। তাদের ভাষায় বাঙালিরা হলো কাফের, গাদ্দার এবং ভারতের চর। তারা নির্বিচারে ধর্মনির্বিশেষে বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধদের হত্যা করে, গনিমতের মাল আখ্যায়িত করে বাঙালি মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করে, মালামাল লুণ্ঠন করে।
তাদের বিভৎসতা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, তখন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নাগরিকের মধ্যে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এদের রোষানলে পড়ে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানি জান্তা তাদের দেশীয় সহযোগীদের নিয়ে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে, লাখ-লাখ ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ও লুটপাট করে এবং দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানি করে, যা ছিল সম্পূর্ণ ইসলামবিরোধী, অমানবিক, ভয়ঙ্কর, নিদারুণ এক ধ্বংসযজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধে ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের এমন কী ভূমিকা ছিল যাতে তাদের আমরা প্রকৃত ইসলামের ধারক ও বাহক বলতে পারি? বরং সত্তরের জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং পরে উপরের বর্ণনা মতে তাদের কোনো কর্মকাণ্ডই ইসলামের সঙ্গে যায় না।
এখন দেখা যাক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাত্তোর সময়ে পাকিস্তানিদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, আল শামস, রাজাকার এবং তথাকথিত শান্তি কমিটির সদস্যদের কীভাবে বিচার করা হয়েছে বা হচ্ছে। তারা রাষ্ট্রীয় আইন এবং ইসলামিক আইনের দৃষ্টিতে কতটুকু ক্ষমা বা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে সব রাজাকার, আলবদর, আল শামস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছে তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ বা দালাল আইন জারি করা হয়। এ আইনের আওতায় মোট ৩৭,৪৭১ ব্যক্তিকে তখন গ্রেফতার করে বিভিন্ন আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু করা হয়। এরপর পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’ পাস করা হয়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাহাত্তরের দালাল আইনের আওতায় মোট ২,৮৮৪টি মামলা করা হয়।
এসব মামলায় সাজা দেয়া হয় মাত্র ৭৫২ জনকে। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট যুদ্ধাপরাধের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার আলোকে দালাল আইনে আটক ৩৭,৪৭১ ব্যক্তির ভেতর থেকে প্রায় ২৬ হাজার (৬৯.৩৯%) জনকে সাধারণ ক্ষমতার আওতায় ছাড় দেয়া হয়। এরা কিন্তু প্রায় সবাই রাজাকার, আলবদর, শান্তিকমিটির সদস্য বা যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী ছিল। এরা কেউই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ৫নং ধারায় বর্ণিত শাস্তিযোগ্য অপরাধের মতো বড় অপরাধে অভিযুক্ত না হলেও অনেকেই স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের বাড়ি-ঘর, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি-ঘর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখিয়ে দেয়ার মতো দোষণীয় কাজ করেছিল। এর পরেও এদের ছেড়ে দেয়া হয়।
এটি কি ইসলামের দৃষ্টিতে মহান একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন নয়? বাকি ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তির তখনও দালাল আইনে বিচার চলছিল। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ৫ নং ধারায় বলা হয়, ‘যারা আদেশের নিচের বর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনোটি অথবা সব ক’টি অভিযোগ থাকবে সে সকল অপরাধী কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়।’
ধারাগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো অথবা চালানোর চেষ্টা), ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র), ১২৮ ক (রাষ্ট্রদ্রোহিতা), ৩০২ (হত্যা), ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা), ৩৬৩ (অপহরণ), ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ), ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ), ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা), ৩৭৬ (ধর্ষণ), ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি), ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তিকালে আঘাত), ৩৯৫ (ডাকাতি), ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি), ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি), ৪৩৫ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন), ৪৩৬ (বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার), ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোনো জলযানের ক্ষতিসাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান।
তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর পর দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। এর পরপরই অবৈধ সামরিক সরকার যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধীদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ও ইসলামিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দিখিয়ে দালাল আইন বাতিল করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। দালাল আইনে সাজা পাওয়া কয়েক হাজার এবং বিচারাধীন হাজার হাজার অপরাধীকে রাতারাতি ছেড়ে দেয়া হয়।
যিনি একাত্তর সালে পাকিস্তানের হয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিপক্ষে কথা বলতে গিয়েছিলেন, সেই শাহ আজিজকে ৩০ লাখ শহিদের রক্তে বিধৌত বালাদেশের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। একাত্তরের ঘাতক মওলানা মান্নান এবং আবদুল আলিমকে মন্ত্রিসভার সদস্য করা হয়। রাজাকার ও আলবদর সৃষ্টিকারী ও সব কুকর্মের নির্দেশক, পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী ঘাতক-প্রধান গোলাম আযমকে দেশে ডেকে এনে রাজনীতি করার অধিকার দেয়া হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের মাস্টারমাইন্ড এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের হয়ে পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ করা সামরিক জান্তার কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানকে প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। একাত্তরে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারত হয়ে পাকিস্তান ফেরত যাওয়া ১৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে পুলিশ বাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়. যাদের বেশ কয়েকজন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক পর্যন্ত পদোন্নতি পান।
২১ আগস্ট যখন শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য গ্রেনেড হামলা করা হয় তখন পুলিশের মহাপরিদর্শক ছিলেন মো. শহুদুল হক, যিনি একাত্তরে পুরো নয়মাস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৯ ট্যাংক রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হিসেবে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তখনকার বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য চট্টগ্রামে খোদ পুলিশ তাকে বহনকারী ট্রাকে গুলি করে। এতে আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। সে সময় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ছিলেন মির্জা রকিবুল হুদা, যিনি একাত্তরে আর্টিলারি রেজিমেন্টের একজন মেজর হিসেবে যশোর সেক্টরে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
মার্শাল ল সরকারের গর্ভে জন্ম নেয়া পরবর্তী বিএনপি সরকারের সময় একাত্তরের ঘাতক মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদকেও মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়। তাদের গাড়িতে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের অপমান করা হয়। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়া হয়। পদদলিত করা হয় দেশের পবিত্র সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন।
পাকিস্তানিদের ছত্রধারক এবং ইসলামের তথাকথিত একচ্ছত্র ধারক দলগুলোর নেতাদের কাছে প্রশ্ন ইসলামের কোথায় আছে-
(ক) একটি বৈধ গণতান্ত্রিক সরকারকে সামরিক শক্তি দিয়ে উৎখাত করা এবং সরকার প্রধান এবং তার পরিবারের নারী ও শিশু সদস্যসহ সবাইকে বিনা বিচারে হত্যা করার কথা।
(খ) মোকলুকাতে আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় বান্দা মানুষকে বিনাবিচারে হত্যাকারী দণ্ডপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও তাদের সংগঠক এবং নির্দেশদাতাদের রাতের অন্ধকারে ছেড়ে দেয়ার কথা।
(গ) যুদ্ধাপরাধী, ধর্ষক, অগ্নিসংযোগকারী এবং লুটারদের বিচার না করে জেল থেকে ছেড়ে দেয়ার কথা।
(ঘ) বিনাবিচারে অবৈধভাবে জেলের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চার স্তম্ভ হিসেবে খ্যাত জাতীয় চার নেতাকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করার কথা।
(ঙ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিচার না করে পুরস্কৃত ও পুনর্বাসন করা।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনটি পঁচাত্তরের সামরিক সরকারের চোখের আড়ালে থেকে যায়। পরে ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারিতে উল্লেখিত আইনের আলোকে দেশের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাব পাস হয় জাতীয় সংসদে। আইনটিতে বেশ কিছু সংশোধনীর পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের পূর্বক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৪২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, বিচার পর্যায়ে আছে ৩৪টি মামলা।
উপরোক্ত আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এগুলো রাষ্ট্রীয় আইন হলেও ইসলামি আইনের সঙ্গে এর তেমন কোনো বিরোধ নেই বরং একটি অপরটির পরিপূরক।
ইসলামে উল্লেখিত অপরাধের বিচার সম্পর্কে আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ইহকালে কী বিচার হওয়া উচিত এবং পরকালে কী শাস্তি হতে পারে সে বিষয়ে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। তাদের গুটিকয়েকের ইহলোকে শাস্তি হলেও প্রায় নিরান্নবই ভাগই সাজা পাননি। তাদের উচিত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর আইনানুযায়ী পরকালে সাজার জন্য প্রস্তুত থাকা এবং ইহলোকে আর মোনাফিকি না করে আল্লাহর কাছে তওবা করা।
আল্লাহর আইন অনুযায়ী শুধু জীবিত অবস্থায় নয়, তাদের জন্য মৃত্যুর পরেও অকল্পনীয় শাস্তি অপেক্ষা করছে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর ১; সাবেক পরিচালক, বিনিয়োগ বোর্ড, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়