আমি তখন অনেক ছোট। আমরা ঢাকার ভূতের গলিতে থাকতাম। আমাদের, মানে বাচ্চাদের, সারাদিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর খেলা ছাড়া কোনো কাজ নেই। স্কুল তেমনভাবে চলছিল না।
কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি টুংটাং বেল বাজানো বেবি আইসক্রিমওয়ালাটা তো আর আসছে না। প্রতি সপ্তাহে পাড়ায় একটা ভাল্লুকওয়ালা আসত খেলা দেখাতে, একটা বাঁদরনাচওয়ালাও, একটা সাপুড়েও বাঁশি বাজিয়ে চলে যেত, খেলা দেখাতো, সাপের খেলা। পরিস্থিতি কেমন যেন থমথমে হয়ে যাওয়াতে সবাই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। বাতাসে আনন্দ মুছে গিয়ে শুধু ঠান্ডা, গুমোট একটা অনুভূতি। ছোট হলেও বুঝতে পারছিলাম, কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে।
দেশ, দুঃখ, কষ্ট, রাজনীতি, সমাজনীতি কী এবং কেন, তাও জানতাম না। শুধু লক্ষ্য করতাম সন্ধ্যা নামার পরপরই কেমন যেন একটা শুনসান নীরবতা চারিদিকে। আব্বা, নজলু চাচা, কলিম ভাই, টুনু খালু এবং পাড়ার দু-একজন মুরব্বি একখানে হয়ে ফিসফিস করে কথা বলতেন। আব্বা সাংবাদিক ছিল বলে সবাই আব্বার কাছে এসে প্রকৃত তথ্য জানতে চাইত। আম্মা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে কথা শুনত। মাঝেমাঝে আব্বারা সবাই মিলে শরীফ চাচা ও জাহানারা চাচি (জাহানারা ইমামের ) বাসায় যেত আরো বিস্তারিত আলোচনার জন্য।
সকাল-সন্ধ্যা শুধু বিবিসি শুনত সবাই। সেই থেকে বিবিসি আমার খুব আপন একটা গণমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে আমি সেসময় এসব ঘটনার খুব একটা গুরুত্ব বুঝতাম না, বোঝার কথাও না। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো কোনো প্রবল শক্তিশালী ঘটনা, যা মনে দাগ কেটে যায়, তা শিশুরা মনে রাখতে পারে। আমাকে অনেকটাই পরিণতবয়সী করে তুলেছিল সেই একটি সময়।
২৫ মার্চের কালরাত ঠিক সেরকমই একটি রাত, যা আমি কখনও মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না । রাতের খাবার খাওয়ার পর হঠাৎ চারিদিক থেকে গুলি, মেশিন গান এবং আরও অনেক শব্দ ভেসে আসতে থাকল। আব্বা, আম্মা, আমি লাইট নিভিয়ে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের কাছে ছিল কিছু শুকনো বিস্কুট আর একটা ছোট্ট হারিকেন। পরে শুনেছি, ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্ল্যাক আউট চলছিল। কারণ পাকিস্তানিরা যেন নির্বিঘ্নে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে ।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি আমার ছোট দুইটা পুতুল নিয়ে খাটের নিচে ঢুকেছিলাম। মনে ভেবেছিলাম, যদি দুষ্টু লোকেরা আসে, তাহলে তো আমার পুতুল দুটিকে নিয়ে যাবে। সেদিন ভাবিনি ওই হায়েনারা আমার দেশকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য রাতে বর্বর হামলা চালিয়েছিল। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ওরা নির্বিচারে। অগণিত নারী-শিশুকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
আমি সেই রাতেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আব্বা কী হচ্ছে চারিদিকে? এত গুলির শব্দ, এত আগুনের আলো কেন দেখা যাচ্ছে? ওরা কি আমাদের মেরে ফেলবে?’
কী ভয়ংকর ট্রমা হয়েছিল তখন, তা আমি এখনও কল্পনা করতে পারি না। আমাদের দৈনন্দিন সাদামাটা কিন্তু আনন্দময় জীবনে কী ভয়াবহ একটা ঝড় এসেছিল। আব্বা বলেছিল, ‘মা পশ্চিম পাকিস্তান নামে একটা শয়তান দেশ আছে, ওরা আমাদের দেশকে কেড়ে নিতে চায়। আমাদের সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে। শুনিস নাই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সবাই যুদ্ধের জন্য তৈরি হও। যার যা কিছু আছে, ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমার মনে পড়ল আব্বার কাছে শোনা সেই বক্তৃতার কথা। আব্বা বলেছিল, কাঁদিস না মা। তুই তোর পুতুল সামলা, দেশের মানুষ দেশটাকে সামলাবে।’
আম্মা আমাকে বুকে চেপে ধরে শুধু দোয়া পড়ে যাচ্ছিল। এত গোলাগুলির শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল, হয় তো আমাদের পাড়ায় কেউ বোমা ফেলছে। এবং এত কমলা রঙা আগুনের ঝলকানি দেখে মনে হয়েছিল এক্ষুণি হয় তো একটা আগুনের গোলা এসে পড়বে আমাদের অন্ধকার ঘরে। নিশ্চুপ একটা রাতে শুধু বোমা আর গুলির শব্দ শুনে আমি ভয়ে কাঁদতে থাকলাম। আব্বা আমার মুখ চেপে ধরে আস্তে আস্তে কাঁদতে বলল।
আব্বা ফিসফিস করে বলল, ‘গুলির আওয়াজ আসছে রাজারবাগের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে।’
আমার মনে হয়েছিল, ওরা মনে হয় মানুষ না, আমার ঠাকুরমার ঝুলির গল্পে পড়া সেই দানোর দল, যাদের মুখ থেকে আগুন বের হয়। বড় হয়ে বুঝেছি, ওরা আসলে সেই দানবই ছিল ।
এরপর যে কখন আম্মার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ভোর হলো। আমরা খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম। রাতের আঁধার কেটে যাওয়াতে আমি শান্তি পেলাম। কিন্তু তখনও জানি না কেবল অশান্তির শুরু হলো। আব্বা কাজে বেরিয়ে গেল। আম্মাকে বলে গেল, আমাকে যেন কোথাও না যেতে দেয়। শহরের অবস্থা খুব খারাপ। কিছু চাল, ডাল, আল, তেল, লবণ, মোমবাতি আর ম্যাচ কিনে রাখতে বলল পাড়ার দোকান থেকে।
তখন পুরো পাড়ায় একটাই ফোন ছিল, সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ চাচার বাসায়। আব্বা কাজ করত এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানে (এপিপি), এখন সেটা বাসস। দুপুরে আব্বাকে ফোন করে জানলাম, শহরের অবস্থা খুব খারাপ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নেমেছে। ওরাই গত রাতে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। শহরের অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। পুলিশ, ছাত্রছাত্রী কেউ বাদ যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে গেছে। আম্মা ফোন রেখে কাঁদতে শুরু করল। আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরে এল। আব্বা বলে দিল, আমি না আসা পর্যন্ত তোমরা সাবধানে থেকো।
১৯৭১ এর সেই রাতটা ছিল বিশ্বাসঘাতকতার একটা রাত। বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলি ভুট্টো, পাকিস্তানের কসাই টিক্কা খান। শুধু মুসলমান হিসেবে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল, সেই জন্মের সাথেই পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধিতা করেছিল। তারাই চেয়েছিল তদানীন্তন সবুজ পূর্ব পাকিস্তানকে দমড়ে মুচড়ে ধ্বংস করে দিতে।
আর তাই শুরুতেই তারা বঙ্গবন্ধুকে ধরে আমাদের নেতৃত্বহীন করতে চেয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতের এই নৃসংশ পরিকল্পনা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ছিল রাও ফরমান আলী এবং খাদিম হোসেন রাজার। তারা আলোচনায় আমাদের ব্যস্ত রেখে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে করে লাখ লাখ আর্মি আর অস্ত্র এনে হাজির করেছিল ঢাকায়। আমাদের যখন গণ হারে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন পাকিস্তানের টপ বসরা বসে অপারেশন সার্চলাইট এনজয় করছিল। অপারেশনটা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে। ওদের বার্তাটি ছিল এমন: ‘বিগ বার্ড ইন দ্য কেইজ’। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুকে ধরলেই খেল খতম হবে। কিন্তু ওরা জানতো না সাত কোটি বাঙালির শক্তি কতটা।
২৬ মার্চ শুনলাম আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি। বুঝিনি ব্যাপারটা কী। পাকিস্তানিরা মাইকে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। কেউ বাসা থেকে বের হবে না। আমরা আব্বার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম।
আব্বা সেদিন বাসায় এসে বলল, ‘মা আজ থেকে আমরা স্বাধীন দেশ। বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের নতুন দেশের নাম হবে বাংলাদেশ। আমরা আজ থেকে যে যেভাবে পারি যুদ্ধ করব পাকিস্তানি দৈত্যদের বিরুদ্ধে।’
সেই বয়সে আমাকে বোঝানোর জন্য দৈত্যই সবচেয়ে সঠিক শব্দ ছিল। আব্বা সেদিন পাকিস্তানি পতাকাটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘এই পতাকা আর আমাদের নয়, আমাদের নতুন পতাকা হবে, নতুন দেশ হবে।’
আমাদের পুরো পাড়াটা খালি হয়ে গেল। আমাদের বাড়িওয়ালা রাতের আঁধারে চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে আব্বাকে ফিস ফিস করে বলে কুমিল্লায় গ্রামের বাড়ি চলে গেল। রাতেই নাকি পাকিস্তানিরা হামলা করবে পাড়ায়। এভাবে পাড়া পুরো খালি হলো, শুধু আমরা তিন চারটি পরিবার ঘরে আটকা পড়ে থাকলাম। আব্বা আম্মাকে বলে যেত, অফিস থেকে আমি ফিরে না এলে আসাদগেটে লিলিবুর ওখানে চলে যাবা, তারপর যুদ্ধ থামলে রংপুরে। আমি শুধু একা একা এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই। প্রতিদিন পাড়ার বন্ধুরা একে একে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এ যেন এক অঘোষিত মৃত্যুপুরী।
আমরা এই পাড়া ছেড়ে পাশে নর্থ সার্কুলার রোডে আরেকটু লোকসমাগমওয়ালা পাড়ায় গেলাম। সেখানে থাকত ফখরুল হাসান বৈরাগী, সংবাদ পাঠক শামীম আহমেদ, অভিনেতা আরিফুল হক। সেখানে বাচ্চাটাচ্চার সংখ্যাও ছিল বেশ কিছু।
একদিন সেখানেও বাসায় তল্লাশি করতে পাকিস্তানি বাহিনী এলো। সব জিনিসপত্র ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দেখছিল। আম্মা মাথায় কাপড় দিয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। আমি হাতে পুতুল নিয়ে একমাত্র সম্বলটা লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছিলাম। আব্বার খুব অ্যাজমার টান উঠেছিল। আব্বা শুধু বলছিল, ‘তোমরা যাই কর, আমার মেয়ের পুতুলটা নিয়ে নিও না। ও খুব ভয় পাচ্ছে।’
ওরা তেমন সন্ত্রাস করে নি সেদিন। তবে এত ভয়াবহ, অচেনা চোখমুখ আমি আর দেখিনি।
তবে ওই পাড়ায় আমাদের পাশের বাসায় একটি পরিবার থাকত, যাদের কথা বলে লেখাটি শেষ হবে। সম্ভবত শিউলী ছিল ওই বাসার আপার নাম। এক বোন, পাঁচ ভাই ছিল ওরা। শিউলী আপাকে নিয়ে পাড়ায় একটা কানাঘুষা যে ছিল, তা আমরাও শুনেছিলাম। উনি নাকি পাকিস্তানি আর্মিদের ক্লাবে গিয়ে গান শোনাতেন।
সেই আপা পাড়ায় কারো সাথে তেমন মিশত না। পাঁচ ভাইকেও মাঝেমধ্যে পাড়ায় দেখা যেত এবং এক সময় আর তাদেরও আর দেখা যেত না। তবে আমি দেখেছিলাম দু-একদিন রাতে শিউলী আপা আব্বার কাছে বেশ রাত করে এসেছিল। খুব দ্রুত কথা বলে চলে যেত।
পরে আব্বা বলেছিল, শিউলী মুক্তিযোদ্ধাদের চর ছিল। আর ওর পাঁচ ভাইই মুক্তিযোদ্ধা ছিল। শিউলী আপা পাকিস্তানিদের সাথে মিশে, তাদের সাথে নেচে-গেয়ে খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিত।
বড় হয়ে মনে মনে অনেক খুঁজেছি শিউলী আপাকে। আব্বা বেঁচে থাকলে সুবিধা হতো। হয়ত তাকে খুঁজে পেতাম।
আজকে বিজয় দিবসে আমার এই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা শিউলী আপার পায়ে নিবেদন করতে চাই।
যুদ্ধ শেষ হলো। ১৬ ডিসেম্বর আমরা মেইন রোডে গিয়ে দাঁড়ালাম। ট্রাকে করে বিজয়ী বাহিনী ঢুকছে। ভারতীয়, দেশী মুক্তিযোদ্ধারা সবাই। আমরা হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলাম। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম শিউলী আপাও সেই মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমরা পৌঁছে গেলাম শহীদ স্বপ্নের কাছাকাছি।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সাংবাদিক, গবেষক, উন্নয়নকর্মী।