বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু সরকার ও যুদ্ধশিশু

  • মুস্তফা চৌধুরী, অটোয়া, কানাডা    
  • ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৪:৪২

১৯৭২ সালে খবরের কাগজে নবজাতক যুদ্ধশিশুদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল নানাভাবে; যেমন: ‘অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু’, ‘অপ্রবঞ্চিত শিশু’, ‘অবাঞ্ছিত শিশু’, ‘বেজন্মা’, ‘পরিত্যক্ত শিশু’, ‘জারজ সন্তান’ এবং ‘শত্রু  সন্তান’। হাজার বছরের ঘুণে ধরা সমাজের আষ্টেপৃষ্ঠে যে কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতা জমে আছে, সেই ক্ষুদ্রতা ও কূপমণ্ডুকতার বেড়া ভেঙে আলোর পথে কোনো বাংলাদেশি সেই ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুদের কোলে তুলে নিতে পারেনি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ইতিহাস কমবেশি সবার জানা, বিশেষ করে বাংলাদেশের তেতুলিয়া থেকে টেকনাফের গ্রাম, গঞ্জ, শহরে পাকস্তানি সেনার হাতে অগণিত নারী হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের উপর গত ৪৯ বছরে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচার থেকে শুরু করে বাঙালির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয়ের উল্লাসের কাহিনী বিশদ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তবে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও নারী ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশুদের কোনো মৌলিক গবেষণা হয়নি।

ইতিহাসের সত্য হলো: ‘History is not concerned with the quality of the past, but with the past as such, whatever it might be.’

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনেক শূন্যস্থান রয়েছ। যথার্থ নথিবদ্ধকরণের অভাবে যৌন অপরাধ, ধর্ষণ ও ধর্ষণের শিকার কত ছিল, তাও ইতিহাসের আপেক্ষিকতায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বলা যায়, ঐতিহাসিকদের হাতে যা কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে তার বাইরে আর কিছু নেই।

এত বছর পর ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণ, গর্ভমোচন, জন্ম, মৃত্যু, পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের দত্তক গ্রহণ পর্যন্ত সব ঘটনা মিলে ১৯৭১-১৯৭২ সালের এক অলিখিত, অজ্ঞাত ইতিহাসের অধ্যায় আজ আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতাসীন সরকার স্বাধীনতা আন্দোলন এবং প্রাসঙ্গিক ঘটনার ওপর কালো পর্দা টেনে দেয়। দেশের মানুষ বহু বছর ধরে যুদ্ধকালে বাংলাদেশের নারীদের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও ধর্ষণের ভয়ঙ্কর ঘটনা এক রকম অগ্রাহ্য করেছে। এ যেন বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঘটনাপঞ্জি থেকে ওই অন্ধকার দিনগুলো মুছে দেয়ার ষড়যন্ত্র।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের অন্ধকারাছন্ন ওই অধ্যায় থেকে যারা নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন, তাদের কেউই কিন্তু তেমন লাভবান হননি। বরং এতে কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসের একাংশ অনালোকিত রয়ে গেছে। কিছু কিছু তাৎপর্যপূর্ণ সত্যও মানুষের চোখের আড়ালে থেকে গেছে।

আমাদের জানা আছে মাইলাই হত্যাকাণ্ড, যাকে বিয়োগান্তক বা শোকাবহ অভিজ্ঞতা বলা হতো। আমরা এটাও জানি যে, পরে ইতিহাসের আলোকে সেটা একটি ‘ঘটনায়’ পর্যবাসিত হয়েছিল। তেমনি বাংলাদেশি নারীদের ধর্ষণ, বলাৎকার ও বিকৃত কাম চরিতার্থ করার ঘটনা সবাই ক্রমশ ভুলে গিয়েছিল। ভোলেনি কেবল কয়েকটি নারী সংগঠন ও নারী লেখক সংঘ। এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে না, বাংলাদেশের জাতির বিবেক থেকে যুদ্ধশিশুদের জন্ম ও তাদের জীবনে ইতিহাস এক রকম মুছে ফেলা হয়েছে।

যুদ্ধশিশুদের অবিদিত ইতিহাসের কোনো তথ্যই বাংলাদেশে কোনো সমাজচিন্তক ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের পাঠক ও ইতিহাস গবেষকের কাছে নেই। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থগার ও আর্কাইভসে যুদ্ধশিশু বিষয়ে কোনো নথিপত্র নেই, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেও নেই। তবে সম্প্রতি কানাডীয় দত্তকগ্রাহী বাবা-মা, ফ্রেড ক্যাপাচিনো ও বনি ক্যাপাচিনো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শিখা ক্যাপাচিনোকে দত্তক নেয়ার বিষয়ে দলিলাদি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে দান করেন।

বিচারপতি কে এস সোবহান ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন বোর্ডের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে এক সাক্ষাৎকার আমাকে বলেছিলেন, ‘১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের সরকারগুলো যুদ্ধশিশু ও বীরাঙ্গনাদের বিষয়ে প্রাসঙ্গিক দাপ্তরিক নথিপত্রের সবই পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে দেয়। ’

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পা দিয়েই বঙ্গবন্ধু দেখতে পান নবজাত শিশুদের করুণ অবস্থা। তিনি খেয়াল করেন, কীভাবে প্রথমদিকে বাংলাদেশের মানুষ ওই শিশুদের প্রতি নির্মম ও উদাসীন মনোভাব দেখিয়েছিল। ১৯৭২ সালে খবরের কাগজে নবজাতক যুদ্ধশিশুদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল নানাভাবে; যেমন: ‘অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু’, ‘অপ্রবঞ্চিত শিশু’, ‘অবাঞ্ছিত শিশু’, ‘বেজন্মা’, ‘পরিত্যক্ত শিশু’, ‘জারজ সন্তান’ এবং ‘শত্রু সন্তান’। হাজার বছরের ঘুণে ধরা সমাজের আষ্টেপৃষ্ঠে যে কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতা জমে আছে, সেই ক্ষুদ্রতা ও কূপমণ্ডুকতার বেড়া ভেঙে আলোর পথে কোনো বাংলাদেশি সেই ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুদের কোলে তুলে নিতে পারেনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীর এ সময়ে আমি গভীরভাবে তাকে স্মরণ করছি। বঙ্গবন্ধু কালক্ষেপন না করে ১৯৭২ সালেই ব্যাপকভাবে ঘৃণা, অবহেলা ও প্রত্যাখ্যানের শিকার যুদ্ধশিশুদের মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়ে আইনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ১৯৭২ সালে জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল স্যোশাল সার্ভিসের (আইএসএস) কয়েকজন উপদেষ্টা বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তকের বিষয়ে সুপারিশ দিতে ঢাকা আসেন এবং বাংলাদেশি সংশ্লিষ্ট শিশু কল্যাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন।

বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন সোনার বাংলা গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তখন তাকে নিরন্তর নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একদিকে যেমন গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসনের চাপ, তেমনি অন্যদিকে সরকারকে ‘অনাথ’ ও ‘অবাঞ্ছিত’ যুদ্ধশিশুদের নিয়ে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়েছিল। যেহেতু সমাজ এসব শিশুদের চায়নি, বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, তার সরকারকেই তাদের লালন-পালন ও দেখাশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধশিশুর ইস্যুটিকে তার জরুরি পরিকল্পনার আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন।

যুদ্ধশিশুদের জন্মের ইতিহাসে ‘গভীর কলঙ্কের’ দাগ রয়েছে। এর ফলে ওই শিশুদের বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো অথবা দত্তক নেয়া একরকম অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেটি বুঝতে পেরেছিলেন। স্বাধীন দেশ তখন মোকাবেলা করছে অত্যন্ত গভীরভাবে প্রথিত এক সামাজিক ট্যাবুর। শুরু থেকেই ব্যাপকভাবে যুদ্ধশিশুদের পরিত্যাগ সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। যে হারে যুদ্ধশিশু জন্ম নিচ্ছিল নানা মাতৃসদনে, শহরে বন্দরে, বিলে-কান্দারে তার কোনো পরিসংখ্যান কারও কাছে ছিল না। বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে শিশুর জন্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এসব যুদ্ধশিশুর বেলায় তাদের জন্মদাতা বাবাদের অনুপস্থিতির কারণে তাদের গ্রহণযোগ্যতা সামাজিকভাবে ছিল না বললেই চলে। এ অবস্থায় জন্মদাত্রী মায়েরাও অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুদের পরিত্যাগের মাধ্যমে নিজেদের জঞ্জালমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল।

তিন মাসের মাথায় ইন্টারন্যাশনাল স্যোশাল সার্ভিসের (আইএসএস) বংলাদেশে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের আলোকে আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক প্রক্রিয়াকে একটি কার্যকর ‘বিকল্প ব্যবস্থা’ হিসেবে সুপারিশ করে। চূড়ান্ত পরামর্শ পাওয়ার পর সরকার খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে। তারপর বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে সুপারিশমালায় তার অনুমোদন দেন।

যুদ্ধশিশুদের ‘মানব-সন্তান’ আখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধু এ সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদেরও বাঁচার মৌলিক অধিকার রয়েছে। তার মন্ত্রিসভায় সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন: দত্তক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হবে কীভাবে? জন্মদাত্রী মায়েরা নবজাতকদের পরিত্যাগ করার ব্যাপারটা কীভাবে নেবেন? তার ফলাফল কী দাঁড়াবে?

সরকারকে বলা হয়েছিল, দত্তকগ্রাহী মা-বাবার কাছে শিশুদের হস্তান্তর চূড়ান্ত করতে প্রথমেই একটি আইনি কাঠামোর প্রয়োজন হবে, যার মাধ্যমে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়া আইনসম্মত করা হবে। এই শিশুদের ‘পরিত্যক্ত’ হিসেবে গণ্য করা হলে স্বাভাবিকভাবে সরকার তাদের আইনি অভিভাবক হবে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এরপর Bangladesh Abandoned Children (Special Provision) Order, 1972 অর্ডিন্যান্স প্রণয়ন সম্ভব হয়। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে নিগৃহীত যুদ্ধশিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি আরও গুরুত্ব পায় এবং তাদের দত্তক নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। সরকারি নথিপত্র ও সরকারি কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আইন প্রস্তুতের সময়েও তারা ‘শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থে’ শব্দবন্ধের তাৎপর্য দ্বারা অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত হয়েছিলেন।

১৯৭২ এ অর্ডিন্যান্সের উপর ভিত্তি করেই শুরু হয় আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তকায়ন। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ১৫টি যুদ্ধশিশু নিয়ে শুরু হয় দত্তক প্রক্রিয়া। প্রথম ব্যাচটি গিয়েছিল কানাডাতে। যুদ্ধশিশুরা কীভাবে বাংলাদেশ থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছায়, তাদের নতুন আবাসে দত্তকগ্রাহী বাবা-মা কীভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেন, সেটা আমরা জানি না। আমরা শুধু জানি, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ থেকে অগণিত যুদ্ধশিশুকে নিরাপদ আশ্রয়ে লালিত পালিত হওয়ার জন্য দত্তকায়নের মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সমাজ যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে তেমন কোনো উৎসাহ দেখায়নি, ভবিষ্যতে উৎসাহ দেখাবে বলে মনে হয় না। সেদিক দিয়ে দেখলে এটা সহজেই অনুমেয়, যুদ্ধশিশুরা কেন আত্মপরিচয় দিতে অনাগ্রহী। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক ১৯৭১ সালে ধর্ষণের শিকার নারী ও যুদ্ধশিশুদের জাতির ‘শ্রেষ্ঠ সন্তান’ আখ্যা দিয়ে সরকারকে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। পরিতাপের বিষয়, বঙ্গবন্ধু যাদের জন্য ১৯৭২ সালে লালন পালনের আইনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন; সেই দত্তকায়নের ফলাফল বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পারেননি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ এত বছরের সামাজিক নিষ্ঠুরতা প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধশিশুদের সামাজিক দায়িত্বভার নেয়ার বিষয়ে সচেতন হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ছয় বছর পার হওয়ার পরেও কোনো যুদ্ধশিশু নিষ্ঠুরতার বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে আসেনি। দেশে যারা মনোজ্বালা নিয়ে বেঁচে আছেন, যারা মানবিক অধিকার থেকে চিরবঞ্চিত, সামাজিক বৈষম্যের শিকার- তারা হয়ত দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই মিলেমিশে আছে। যুদ্ধশিশু হিসাবে তাদের পরিচিত হওয়ার কোনো দাপ্তরিক রীতি-প্রক্রিয়া নেই। ফলে একের পর এক সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের ভাগ্য উন্নয়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি।

যেসব যুদ্ধশিশু বাংলাদেশের বাইরে দত্তকগ্রাহী বাবা-মার বাড়িতে লালিত পালিত হয়েছে, তাদের সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? আমরা কি জানি, দত্তকে পালিত যুদ্ধশিশুরা তাদের জন্মের ইতিহাস কতটা জানেন? তারা কি জানেন, তাদের জন্মদাত্রী ধর্ষিত মাদের করুণ কাহিনী ও তাদের অভিশপ্ত জীবনের অলিখিত ইতিহাস?

তাদের বংশগত পরিচয় কী? তারা কি পাকিস্তানি, নাকি বাংলাদেশি? না যে দেশে লালিত পালিত হয়েছেন তারা কি সে দেশি? যার জন্মদাত্রী মা কামুকতার শিকার, যার জন্মদাতা বাবা লম্পট ও বিকৃত মানসিকতার মূর্তিমান প্রতীক, তার অন্তরজ্বালা কি আমরা উপলব্ধি করতে পারব? তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যত সহজ স্বাভাবিক হোক না কেন, জন্মদাত্রী মার কথা স্মরণ করলেই তাদের মনে হয়ত ভেসে ওঠে- মাদের জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণ ও গর্ভযন্ত্রণার কথা জনসম্মুখে প্রচার করা হয়নি।

যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসের এই অজানা দিক গবেষণা করে যে সব নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়েছি, সেটুকু আমি ৭১ এর যুদ্ধশিশু: অবিদিত ইতিহাস নামক বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছি। এ মুহূর্তে আমাদের যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা হলো যুদ্ধশিশু বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যুদ্ধশিশুদের উপর গবেষণা এক উচ্চতর মানবিক চেতনাকে উজ্জীবিত এবং শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। এই গবেষণা বর্তমান একুশ শতকের পরিস্থিতিতাড়িত বিপর্যস্ত মানুষের মনে জাগাবে নতুন অনুসন্ধিৎসা, আশা, ন্যায়বিচার ও মানব কল্যাণের সর্বোৎকৃষ্ট মতবাদ গ্রহণের আগ্রহ।

মুস্তফা চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও লেখক

mustafa.chowdhury49@gmail.com

এ বিভাগের আরো খবর