বাংলাদেশের জন্য ২০২০ সাল কয়েকটি বিশেষ কারণে মনে রাখার মতো। না, শুধু করোনার প্রভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন-বিষণ্ণ হয়ে যাওয়া নয়। এই বছর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ গর্বের সঙ্গে উদযাপনের বছর। এই বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি উদযাপনের প্রস্তুতির বছর। করোনাকে অতিক্রম করে যারা টিকে আছি, তাদেরও ভালো লাগার বছর।
ব্যক্তিগতভাবে আমি আরও বিশেষভাবে এই বছর স্মরণ করছি আমার বাবাকে। এই লেখা ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের জন্য প্রকাশিত হলেও স্মরণ করছি গত ২৭ নভেম্বরেই ছিল আমার বাবা শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর জন্মদিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আর আমার বাবার ৯৫তম জন্মবার্ষিকীর সন্ধিক্ষণে এই দুই মানুষের সম্পর্ক ও যোগাযোগ উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে আজকের দিনে তাদেরকে সম্মান ও ভালোবাসা জানাই।
এ শুধু নিছক ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নৈকট্য বোঝানোর জন্য নয়, বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষ তার জীবদ্দশায় অনেককেই কাছে টেনে নিয়েছেন। তবে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত মুক্তির যুদ্ধে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কের পরিপূরকতা ও সম্পূর্ণতার উপলব্ধি পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দেবার বাসনায় এই বিশেষ দিনে এই বিশেষ দৃষ্টিকোণের লেখা।
জাতির পিতা ও আমার পিতা (৪০-৫০ দশকের অনেক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদসহ) একটি বড় ঐতিহাসিক ঘটনার অংশ, তা হলো ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ের ভাষা আন্দোলন, যেই আন্দোলনের সঙ্গে আরও নানা আন্দোলন জড়ো হতে হতে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ পেয়েছে। আমার বাবা শহীদ মুনীর চৌধুরীর কথা সাধারণত ভাষা সৈনিক হিসেবে উচ্চারিত হয় না, তবে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সৃজনশীল লেখনী-সমাবেশ-প্রতিবাদ-গবেষণা ১৯৪৭-উত্তর অব্যাহত রেখেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় জীবনে দু’বার জাতির পিতা ও আমার পিতা একই আন্দোলনের অংশ হিসেবে একই সময়ে কারাবরণ করেছিলেন। একবার ১৯৪৯ সালে, আরেকবার ১৯৫৪ সালে।
তবে যতদূর জানি, সেখানে তাদের সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ হয়নি। কারণ হয় রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কারাগার ভিন্ন, নয়ত প্রকোষ্ঠ ভিন্ন চৌহদ্দিতে। তবে বঙ্গবন্ধু জানতেন কোন কোন রাজনীতিবিদ, শিক্ষক বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে কারাবন্দি হয়েছেন। আর মুনীর চৌধুরীসহ অজিত গুহ, রনেশ দাসগুপ্ত এবং আরও অনেকে খোঁজ-খবর নিতেন শেখ মুজিব কোথায় অন্তরীণ আছেন, কেমন আছেন, কী ভাবছেন আর কী পরিকল্পনা করছেন। ভবিষ্যতের জাতির পিতা তখন এবং তৎপরবর্তী সময়ে আমাদের বাবা ও অন্যান্য শিক্ষক-লেখকদের সংগ্রামী চেতনার অনুপ্রেরণা হয়েই ছিলেন।
তবে পঞ্চাশের দশকেই একবার এই দু’জন খুব কাছাকাছি এসেছিলেন, যদিও পরাধীন বাংলাদেশে নয়- প্রবাসে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকে সাম্প্রতিককালে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছেন, যেখানে মুনীর চৌধুরীসহ কয়েকজন তরুণ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দাঁড়ানো। এই ছবির পটভূমি হলো, মুনীর চৌধুরী ১৯৫৪ সালে কারামুক্তির পর যখন আবার অধ্যাপনা ও লেখালেখিতে নিবিষ্ট, এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের (মার্কিন) উপাচার্য ও বাংলা বিভাগ প্রধান অধ্যাপক আব্দুল হাই-এর আগ্রহে বৃত্তিসহ ভাষাতত্তের ওপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান ১৯৫৬ সালে। এম.এ. ডিগ্রি লাভ করার সময় পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সপরিবারে তিনি বস্টনে ছিলেন।
এসময় হার্ভার্ডে বাঙালি ছাত্র ছিল হাতে গোনা, কাজেই নিজেদের মধ্যে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ থাকত। তাদেরই একজন, প্রাক্তন সচিব মতিউল ইসলামের লেখা থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের শেষার্ধে চিকিৎসার কারণে অল্প কিছুদিনের জন্য বস্টন গিয়েছিলেন। তখন জনাব মতিউল ইসলাম ও মুনীর চৌধুরী পালা করে শেখ মুজিবকে হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসতেন, তার চিকিৎসার খোঁজ খবর নিতেন। আর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বিশ্রাম ও পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত আমার বাবা-মা’র বাড়িতে শেখ মুজিব কয়েকদিন ছিলেন। সেসময় বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবরণের সময়ের স্মৃতিচারণ করতেন বঙ্গবন্ধু ও মুনীর চৌধুরী। আমার বড় ভাই ভাষণ তখন শৈশবে, তাকে শেখ মুজিব একটি খেলনা গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। আর বলাই বাহুল্য ওই কয়দিন বঙ্গবন্ধুকে আপ্যায়নের কাজটি করেছিলেন আমার মা লিলি চৌধুরী। দুর্ভাগ্য যে এতদিনে ভাষণ ভাই বা মায়ের স্মৃতিতেও এর চেয়ে বেশি কিছু নেই, তবে এও কম কী!
অনুমান করা যায়, আলাদা প্রকোষ্ঠে বা চৌহদ্দিতে থেকেও একদিকে বঙ্গবন্ধুর মতো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, অন্য দিকে মুনীর চৌধুরীসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীবৃন্দ ভাষা আন্দোলনকে সক্রিয় রাখার ক্ষেত্রে একই সূত্রে গ্রন্থিত ছিলেন। অনুমান করতে পারি, মুনীর চৌধুরীর জন্য ১৯৫৭ সালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টানা কয়েক দিন বঙ্গবন্ধুর মতো মাপের মানুষের সাহচর্য, বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তার মাঝে নতুনভাবে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। মতিউল ইসলাম সাহেবের লেখায় জানা যায়, ‘হার্ভার্ড গ্রুপ’ নামে একদল মার্কিন শিক্ষক অনেক আগ্রহ নিয়ে সেসময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, যারা পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনেও কাজ করেছেন।
এরপর তাদের দু’জনের আর কখনো সরাসরি যোগাযোগ হয়নি। তবে মুনীর চৌধুরী সবসময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের, আন্দোলনের অনুসারী ছিলেন। সত্তুরের নির্বাচনে মুনীর চৌধুরী সস্ত্রীক সোৎসাহে ভোট দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগকে। একাত্তরের সাতই মার্চের ভাষণ কাছে থেকে না হলেও অদূরেই মাইকে শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের শরীক হতে মুনীর চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের দেয়া রাষ্ট্রীয় সম্মান ১৯৭১-এর মার্চ মাসে বর্জন করেন। এরপরেই তো মুক্তিসংগ্রাম যে যার অবস্থান থেকে, যার শেষ একদিকে বিজয় অন্যদিকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড দিয়ে।
শুনেছি, বঙ্গবন্ধু শেষবারের মতো কারামুক্তির পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছিলেন। অনস্বীকার্য যে বিশ্বাসঘাতকদের হাতে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ যুদ্ধাপরাধের বিচার হতে এত বিলম্ব হতো না। তারপরেও বিচার ও রায়, দুটাই হয়েছে এটাই বড় কথা। আবার বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের রায়ের সাত বছর পরেও সেই রায় কার্যকরী করা যায়নি কারণ আসামি পলাতক, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ও সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা যায়নি, কারণ সেই বিচারের আসামিদেরও কেউ কেউ এখনও পলাতক।
বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের উদযাপনে এই দুটি রায়েরও পূর্ণ বাস্তবায়েন অগ্রগতি হবে, এই প্রত্যাশা রইল। বঙ্গবন্ধু ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।
তথ্যসূত্র: ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’; মুনীর চৌধুরী জীবনী গ্রন্থ– অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী; স্মৃতিচারণমূলক লেখা, প্রাক্তন সচীব মতিউল ইসলাম; পারিবারিক আলোচনা
লেখক: শহিদ সন্তান, সাংস্কৃতিক, মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মী