পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছি করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এইবার বইমেলার আয়োজন মাঠকেন্দ্রিক না করে ভার্চ্যুয়াল করার একটা চিন্তা ভাবনা করছে বাংলা একাডেমি। সংবাদটা পড়ার পর একটা বেদনাবোধ কাজ করেছে।
বাংলাদেশে অধিকাংশ পুস্তক ব্যবসা বইমেলা কেন্দ্রিক। আমাদের লেখকেরা ফেব্রুয়ারিকে ডেডলাইন ধরে বই লিখে থাকেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশক, লেখক, পাঠক একত্রিত হন। সারা বছর প্রকাশকগুলো যা বই বিক্রি করে তার ৭০ ভাগই এই সময় বিক্রি হয়। ফলে সারা বছরে একটা বইমেলা খুবই প্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার আমাদের জন্য।
লেখক হিসাবে আমি জানি, অন্য লেখকদের সাথে আড্ডা, চিন্তা শেয়ার করার জন্য খুবই উপযুক্ত একটা জায়গা এই বইমেলা। সারা বছর দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সতীর্থের সাথে মন খুলে কথা বলার উন্মুক্ত উদ্যানটি হলো আমাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এইটার নতুন ভার্চ্যুয়াল রূপান্তরের সংবাদ প্রাথমিকভাবে আশাহত করতে পারে আমার মতোই যে কাউকে। কিন্তু করোনাকালীন পরিস্থিতে এটা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নাই।
যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেলা করার কথা বলছেন, তারা আসলে কথার কথা বলছেন। স্বাস্থ্যবিধি কতোটা মেনে চলা হচ্ছে, সকলে দেখতেই পাচ্ছি। ফলে আমাদের স্বভাবগত কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে না। মেলায় যারা যাবেন ও কাজ করবেন তাদের নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব কে নেবে? শুধু বইমেলার কারণে হাজার হাজার লোক করোনা আক্রান্ত হতে পারে।
আমাদের দেশের লেখকদের বড় একটা অংশ যে কোনো মূল্যে মাঠে মেলা করার পক্ষে। এরাই করোনার শুরু থেকে যে কোনো গণজমায়েতের বিপক্ষে ছিলেন। লকডাউনকে দীর্ঘায়িত করার কথা বলেছেন তারা। লকডাউনের সূচনায় যখন ঈদে মানুষ একসাথে ফেরি পারাপার করে বাড়ি গিয়েছে, তখন তারা ‘হায় হায়’ করেছে। মসজিদ-মন্দির খোলার পরও গালি দিয়েছে। জানাজা অনুষ্ঠান নিয়ে গালি দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার কথা বলেনি একবারও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার বিকল্প কী, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যাথা দেখি নাই।
দুনিয়ার কোথাও সরকারিভাবে কোনোরকম মেলার কোনো আয়োজন নেই। ফ্রাঙ্কফুট বুক ফেয়ার অনলাইনের ভেতরই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে এ বছর। তারপরও আমরা কীসের ভিত্তিতে উদ্যানে মেলার দাবি করছি?
মুদির দোকান, কাঁচাবাজার, কলকারখানা, শপিংমল হলো দৈনন্দিন বিষয়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো পুস্তক প্রকাশনীগুলোর বন্ধু নাই। এগুলো খোলা রাখা আর কয়েক লাখ লোকের সমাগমের ভেতর দিয়ে পুস্তক বিপণন উৎসব করা যে এক না, তা এদের কে বোঝাবে। দুটোকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নাই। তাই যদি থাকতো, তবে সারা দুনিয়ায় আরো অন্যান্য যে মেলা হয়, তাও সচল থাকতো।
যে সকল লেখক-প্রকাশক প্রকৃত বাস্তবতাকে আড়াল করে তুলনা করছেন যে, ‘সব খোলা, তবে বইমেলা বন্ধের প্রস্তাব কেন’ – তারা মূলত ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থতাড়িত। সারা দুনিয়া যখন মেলার মতো শৌখিন বিষয়াদি বন্ধ রাখছে, তখন আমাদের লেখকেরা মেলার পক্ষে সাফাই গাইছেন। এটা তাদের দ্বিচারিতা। সামান্য ৩০টা দিন লেখক হিসাবে মেলার মাঠে হাঁটা, গালগল্প মারা বা লেখকমঞ্চে বসার জন্য তাদের এ কী হাহাকার!
করোনায় দুনিয়ায় মানুষ যত সমস্যায় পড়েছে, তার বেশিরভাগই প্রযুক্তি দিয়ে সমাধান করা হয়েছে। দুনিয়ার সকল সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা নিজেদের এই সুযোগে আরেও বেশি প্রযুক্তিসক্ষম করে তুলছে। সেই হিসাবে করোনার কারণে মাঠের বইমেলাকেন্দ্রিক যে চ্যালেঞ্জ, তার একমাত্র সমাধান আমাদের প্রযুক্তির কাছে খুঁজতে হবে।
আপতভাবে ডিজিটাল বইমেলা হলে বইয়ের বিক্রি কমবে, তাতে সন্দেহ নাই। কেননা মানুষের অভ্যাস ভাঙতে সময় লাগে। দু কোটি টাকার বই বিক্রি করে দুই লাখ টাকার ভ্যাট প্রদানের সুযোগ থাকবে না। কিন্তু ডিজিটাল মেলার দীর্ঘমেয়াদি সুফল আছে। এর ভেতর দিয়ে পরবর্তীতে উন্নততর ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। অবকাঠামো উন্নয়নের অভিজ্ঞতা বাড়বে দেশীয় ডেভেলপারদের। দেশে ডিজিটাল পুস্তক মার্কেট মূলত ‘রকমারী ডট কম’ নামক মনোপলিতে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। বহু আবর্জনাই তারা সেরা সাহিত্য হিসাবে বেচতে পারছে। ভার্চুয়াল বইমেলা হলে প্রতিযোগিতামূলক ডিজিটাল প্লাটফর্ম তৈরির সুযোগ তৈরি হবে। এটা আশা জাগানিয়া। প্রত্যেক প্রকাশক অনলাইনে নিজেদের বই বিক্রির ভেতর দিয়ে নতুন এক অভিজ্ঞতা পাবেন।
শুরুতে বিক্রি বড় কিছু না হলেও, আগামীতে বড় বড় অনলাইন বইয়ের দোকানের সূচনা হতে পারে। প্রতিটা প্রকাশকের অনলাইন শপ থাকলে ক্রেতারা আরো ভালো সেবা ও মূল্য পাবেন বলে আশা করা যায়। এর থেকেও বড় কথা, পাঠক ও প্রকাশকদের যে ডেটাবেস তৈরি হবে, তা পুস্তক বাণিজ্য উন্নয়নে কাজে লাগবে। সমস্ত বাংলা বইয়ের তথ্যভাণ্ডার নেটে পাওয়া যাবে।
আমার অল্প কয়েকটা প্রস্তাব আছে যা এই অন লাইন বই মেলাকে সফল করতে পারে:
১. এটা সত্যি যে প্রকাশকেরা করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। বিক্রি যেহেতু অনলাইনে হবে, সেহেতু প্রতিটা বিক্রির হিসাবে থাকবে। প্রতি ইউনিট বই বিক্রির উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। তাতে বড় ও ছোট প্রকাশকেরা অনলাইনে বিক্রির ওপর জোর দেবেন। ফলে তারা নিজ দায়িত্বে ভার্চুয়াল মেলার প্রচার প্রচারণা চালাবেন।
২. অনলাইনে বিক্রির সঠিক হিসাব থাকবে। লেখকদের প্রাপ্তির হিসাব দৃশ্যমান থাকবে। রয়্যালিটির সাথে প্রকাশকের প্রাপ্ত প্রণোদনার অংশ যোগ হবে। এতে পরোক্ষভাবে লেখকেরা রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেতে পারে করোনার সময়ে।
৩. বই বিক্রির সঠিক হিসাবে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সরকারের প্রাপ্য সরাসরি সরকারি খাতায় চলে যেতে পারে।
৪. ডাক বিভাগ ও নতুন ডেলিভারি স্টার্ট আপ কোম্পানির মাধ্যমে ডেলিভারির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি এই খাতে জড়িতদের ভাগ্য উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হবে।
৫. পুস্তক বিপণনের লজিস্টিক, ওভারহেড ও দোকানে স্টক কস্ট কমার কারণে পাঠকেরা আরো কম দামে বই সংগ্রহ করতে পারবে।
৬. সারা বাংলাদেশব্যাপী বই ডেলিভারি নিশ্চিত করতে হবে।
৭. সরকারের তরফ থেকে সমগ্র দেশে প্রচারণার ভার নিতে হবে।
মহামারির সূত্র ধরে সুযোগ এসেছে ঐতিহ্যবাহী বইমেলাকে আরো যুগোপোযোগী করে তোলার। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, যে কোনো সংকট নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেয়। করোনার কারণে বইমেলাকে ঘিরে যে সংকট, সংশয় তৈরি হয়েছে, তার সমাধান আমাদের প্রযুক্তির সহায়তায় করতে হবে। চিত্তরঞ্জন সাহা মাটিতে চট বিছিয়ে যে মেলার সূচনা করেছিলেন, তা পরবর্তীতে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি আশা করি বর্তমান মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীসহ অন্যান্য সকলে বইমেলাকে ভার্চ্যুয়াল প্লাটফর্মে বর্ধিত করে ডিজিটাল বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে যুক্ত হবেন। মেলার পরিসর তখন আর বাংলা একাডেমি বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে না, সমগ্র বাংলাদেশ হয়ে উঠবে।
উদ্যানে গণজমায়েতের ভেতর দিয়ে বইমেলা করার বিপক্ষে আমি না। তবে এর ফলাফলকে সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা আপাতত তৈরি হয়নি আমাদের। এর বিকল্প হিসাবে অন্তর্জালের অমর একুশে বইমেলার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তার দীর্ঘমেয়াদি সুফলের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা দরকার।