বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পদ্মা সেতুতে বিপত্তি, সাংবাদিকতার দায়

  •    
  • ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৫:০৬

২০১২ থেকে ২০১৭ সময়ে এই সেতু প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা ছিল বেশ ‘চমৎকার’। আমরা যেভাবে পদ্মাসেতু প্রকল্পের ‘দুর্নীতি’ তুলে ধরতে মরিয়া ছিলাম- সেটা বলতে গেলে অনেকটাই মানুষকে প্রাণপণ বোঝানোর চেষ্টা যে, ‘বিশ্বাস করেন, হইলেও হইতে পারে’- টাইপ একটা বিষয়।

পদ্মা বহুমুখি সেতুর সবশেষ স্প্যানটি বসানো হয়েছে ১০ ডিসেম্বর। অর্থাৎ সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণ শেষ। এবার খুঁটিনাটি কাজ শেষ করে সেতু চালু করার আনুষ্ঠানিকতা- তাও অবশ্য বছর দেড়েকের পরিক্রমা। কিন্তু বাস্তবেই পদ্মা নদীর বুকে বাংলাদেশ নিজের টাকায় একটা ব্রিজ বানাল, অবিশ্বাস্য! কেনো একটা সেতু নির্মাণ নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হয়ত আর হয়নি দেশের ইতিহাসে। পদ্মা সেতু ঘিরে কিসের এই আবেগ, কিসের এত যন্ত্রণা? - মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার, মর্যাদার প্রশ্ন, প্রশ্ন ছিল সক্ষমতা নিয়ে।

ভাবুন তো একবার- একপক্ষে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে গোপালগঞ্জের শেখ হাসিনা, সঙ্গে রাজপথের দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রবীণ সহযোদ্ধারা, ‘ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ’ সরকারি কর্মকর্তার দল আর প্রতিপক্ষ বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মোহাম্মদ ইউনুস, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, ওবামা প্রশাসনের একাংশ এবং তাদের বিশ্বজোড়া প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলোর সমালোচনা ও রাজনৈতিক কানেকশন। শেখ হাসিনা মূলত একাই লড়লেন, অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জনগণের সমর্থন ছিল, কিন্তু বিরোধিতাও কম ছিল না। জেদ, পদ্মার বুক চিরে যে সেতু বানানো হবে সেটা বানানো হবে ‘টাকা’ দিয়ে।

বলতে চাইছি বাংলাদেশের নিজের পকেটের টাকায় এত বড় সেতু বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়াটা ২০১৩ সালেও অনেকের চোখেই ‘আহাম্মকি’ ছাড়া কিছু না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সহযোগীরা ব্যাপক সমালোচনায় মুখর। সভা-সমাবেশে বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়ার প্রতিশ্রুতি তারা ক্ষমতায় গেলে পদ্মায় দুটি সেতু গড়বেন। শেখ হাসিনার সরকার কতটা ‘দুর্নীতিবাজ’ তার ফিরিস্তি বয়ানেও পিছপা নন। সব সমালোচনা উপেক্ষা করে জেদি শেখ হাসিনা অটল। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন হলো সত্যি!

পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্পের নির্মাণ যজ্ঞের একজন সাক্ষী হয়ত আমিও, দূরতম অর্থে হলেও। পেশাগত কারণেই- সাংবাদিকতা। ২০০৯ সালের ভোটে জিতে আওয়ামী লীগ শাসন ক্ষমতায়। ২০১১ সালে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি হয় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকার সঙ্গে। এরপরই ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে ঘুষ লেনদেন চেষ্টার অভিযোগে জেগে ওঠে দেশ ও বিশ্বের সংবাদ মাধ্যম। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ওঠায় সরকার বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে। দায়িত্ব পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে আমার সহকর্মী রিশাদ হুদা তখন দুর্নীতি দমন কমিশনে ঘোরাফেরা করা তরুণ রিপোর্টার। তার হাতে চলে আসে তদন্তের বেশ কিছু নথি, বিশেষত কানাডার পারমর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন-এর কর্মকর্তা ‘রমেশ শাহর ডায়েরির পাতা’। যার ওপর ভিত্তি করে পরে দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ফলাও সংবাদ প্রচার হয়। দেশের মানুষ অনেকটাই ‘নিশ্চিত’ হয়ে যায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান সরাসরি দুর্নীতিতে জড়িত। বিশ্বব্যাংকের চাপের মুখে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন আবুল হোসেন। মামলা হয় প্রকল্পে জড়িত সরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তদন্তে নামে কানাডার সরকারও।

আমরা জাগ্রত, শিহরিত, পদ্মা সেতু নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কানাডার আদালত রায় দেয় পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। আর তাতেই যেন পানি ঢালা হয় জ্বলন্ত উনুনে। তবে ২০১২ থেকে ২০১৭ সময়ে এই সেতু প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা ছিল বেশ ‘চমৎকার’। আমরা যেভাবে পদ্মাসেতু প্রকল্পের ‘দুর্নীতি’ তুলে ধরতে মরিয়া ছিলাম- সেটা বলতে গেলে অনেকটাই মানুষকে প্রাণপণ বোঝানোর চেষ্টা যে ‘বিশ্বাস করেন, হইলেও হইতে পারে’- টাইপ একটা বিষয়।

আবুল হোসেন, আবুল হাসানরা এখনও সেই ‘ধাক্কা’ সামলে উঠতে পারেন নাই। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম অভিযুক্তদের কাউকেই সেসময় একটুও ছেড়ে কথা বলেনি। কানাডার আদালতের রায়ের পর অবশ্য এই জোশ আর কাজ করেনি। তবে সে সময়ের সাংবাদিকতা নিয়ে দায় স্বীকার করার মনোভাবও কারো ভেতরে দেখা যায়নি বলেই মনে হয়। অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার দায় স্বীকার করিনি, তাতে অবশ্য পদ্মা সেতুর নির্মাণ থেমে থাকেনি।

শেখ হাসিনা যা করে দেখালেন তা ক্রিকেটে স্লগ ওভার ব্যাটিংয়ের মতো। বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবি আর এডিবি সরে যাওয়ার পর মালয়েশিয়ার সরকার আগ্রহ দেখায়, কিন্তু শর্ত মানার মতো ছিল না। চীন এগিয়ে আসে। কিন্তু ঋণচুক্তির শর্ত নিয়ে দর কষাকষিতে তারাও সরে পড়ে। বঙ্গবন্ধু কন্যা ঘোষণা দেন বাংলাদেশ নিজের টাকায় সেতুটি নির্মাণের। আর তাতেই দেশ-বিদেশে হাসির রোল, ফেসবুক-টুইটারে ট্রল। ‘দুর্নীতির অভিযোগগ্রস্ত’ সহকর্মী আর সহমর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি এগিয়ে চললেন সেতুর পথে। লাইমলাইটে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে যেসব বাধা পেরুতে হয়েছে তার সবকিছু লিখে বোঝানো হয়ত সম্ভব না। শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদের তখন মাত্র প্রথমটি পার হচ্ছে। তখনও বিডিআর বিদ্রোহের ‘আফটার এফেক্ট’ চলছে। মাঠে বিরোধীরা দারুণ সক্রিয়, জ্বালাও-পোড়াও আর ককটেল বোমা তো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের অনেকটা জুড়েই সংবাদ মাধ্যমে আলোচনায় ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নেয়ার পরেও শেখ হাসিনা বা তার সরকার রেহাই পায়নি এই বিতর্ক থেকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা, সংবাদ মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ প্রচার, জনগণের একাংশের অসন্তোষ এবং সর্বোপরি সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে বাধাগুলো ছোট নয়। এই সেতু প্রকল্প ঘিরে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ, উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পরিচিত সবচেয়ে বড় ঋণদাতা- বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে টানাপোড়েন, বড় দাতা সংস্থাগুলোর সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিশ্ব ক্ষমতার কেন্দ্র ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব- মোটের ওপর শেখ হাসিনা কীভাবে এসব সামলেছেন একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন।

শেখ হাসিনা করে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন আর গড়ে চলেছেন একের পর এক উদাহরণ- তবু আমরা খুবই সন্দেহপ্রবণ জনগণ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মেয়ে এগিয়ে গেছেন তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে। সেতু প্রকল্পের বাজেট বেড়েছে হু হু করে। বাংলাদেশ টাকা জুগিয়ে গেছে। এক-দুই টাকা না, হাজার হাজার কোটি টাকা (৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি) পদ্মার পানিতে ঢেলে এই সেতুকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। গত ১২ বছরে (২০০৮-২০২০) বাংলাদেশের যত অর্জন, তা কিন্তু এক কথায় অনন্য! অবশ্য এর পেছনে সবচেয়ে বেশি যারা অবদান রেখে যাচ্ছেন- দেশের কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিক তাদের আমরা গোণায় ধরি না। আর এই কৃষক-শ্রমিক গোষ্ঠীর শ্রম-ঘামকে কিছুটা হলেও সাফল্যে অনুবাদ করার যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা।

টানা তৃতীয় মেয়াদে তার সরকার এখন মধ্যবর্তী সময় পার করছে। অর্থনীতির সূচকে এরইমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পেছেন ফেলেছে- ভারতকেও অস্বস্তিতে রেখেছে। এই যে এগিয়ে চলা- এরজন্য দরকার ছিল একটি দৃঢ় নেতৃত্ব, শেখ হাসিনা সেটাই দিয়েছেন দেশের মানুষকে, অন্তত তার সমর্থকদের। দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির বাংলাদেশ নিয়ে তার যে অভিযাত্রা, বলতে গেলে শ্রমজীবীদের সঙ্গে নিয়ে একাই ঢেকে ফেলেছেন সব সমালোচনা। তাই পদ্মাসেতুর মূল কাঠামো সম্পূর্ণ হওয়ার পর একটি বিজয় অর্জিত হয়েছে তার। তারপরেও সন্দেহ রয়ে গেছে সমালোচকদের, ‘জোড়াতালি’র সেতু হয়ত টিকবে না- পুরো টাকাটাই জলে গেল।

দেখা যাক, আমরাও অপেক্ষায় আছি দেখার জন্য। তবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই, পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে যে লড়াই তাতে জিতে গেছেন শেখ হাসিনা। বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের জন্য সক্ষমতা প্রমাণের সবচেয়ে বড় প্রতীক হয়ে উঠেছে পদ্মা সেতু। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়ানোর যে প্রয়াস তাতে আরেকটি অর্জন এই সেতু।

লেখক: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর