বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এই দুঃসাহসের শিকড় কোথায়

  • লীনা পারভীন   
  • ১১ ডিসেম্বর, ২০২০ ২২:৩১

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে কয়জন চেনে এদেশে? অথচ তারাও এখন আলোচনার বিষয়। কেন? কারণ, এর নেতা মামুনুল বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে সাগরে ভাসিয়ে দেবেন। ধৃষ্টতারও একটা সীমা থাকে কিন্তু এই বাবুনগরী বা মামুনুলরা সেই সীমা লংঘন করেছে।

২০১৩ সাল থেকেই মূলত হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠনটির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি। এর আগে তাদের অস্তিত্ব কোথায় কেমন করে ছিল, সেটি জানার আগ্রহও হয়নি কখনও। মূলত জামায়াত ইসলামীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার যখন ধুলায় মিশে যাবার পথে, তখনই সেই ধুলা থেকে দৃশ্যপটে চলে এল হেফাজতে ইসলাম নামক ধর্মীয় সংগঠনটি। যদিও প্রথম থেকেই বলার চেষ্টা করেছে যে তারা রাজনৈতিক কোনো দল নয় বা রাজনৈতিক কোনো এজেন্ডা তাদের নেই, কিন্তু তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড আমরা রাজনীতিভিত্তিক দেখেছি এবং কোন সে রাজনৈতিক আদর্শ সেটিও আজ দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার।

বাংলাদেশে ইসলামকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করে আসা মৌলবাদী দলগুলোর নেতৃত্বে ছিল জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ, যারা পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতা বিরোধী একটি দল হিসাবে চিহ্নিত এবং যুদ্ধাপরাধী দল হিসাবে প্রমাণিত। এই দলটির শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবার পর আমরা ভেবেইছিলাম যে, এই দেশ থেকে অন্তত ধর্মীয় উগ্রবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির পতন শুরু হলো। কিন্তু না। ঘটনা মোড় নিল হেফাজতের রূপে।

বর্তমান সরকার নানা আপস রফার মাধ্যমে হেফাজতের নেতাদের সঙ্গে এতদিন সমঝে চলে এলেও সেটি বোধ হয় আর রক্ষা করতে পারছে না তাদের। শেখ হাসিনাকে কওমী জননী উপাধি দেয়ার মাধ্যমে এক ধরনের শান্তির বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছিল শফী হুজুরের দল। এই ধরনের উগ্রবাদীদের সঙ্গে মুক্তমনাদের বন্ধুত্ব হয় না সেটি আমরা বলেছি অনেকবার। সরকার তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যা করার করেছে। বাড়তে বাড়তে সেই ছোবল এবার এসেছে জাতির পিতার ওপর।

সাহস এবং আস্কারা এতটাই বেড়েছে যে হেফাজতের মতো একটি চুনোপুটি দলও হুংকার দেয় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেওয়ার। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে কয়জন চেনে এদেশে? অথচ তারাও এখন আলোচনার বিষয়। কেন? কারণ, এর নেতা মামুনুল বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে সাগরে ভাসিয়ে দেবেন। ধৃষ্টতারও একটা সীমা থাকে। কিন্তু এই বাবুনগরী বা মামুনুলরা সেই সীমা লংঘন করেছে। কিন্তু এতদিনেও আমরা সরকারের দিক থেকে কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না।

বাস্তবে এই মৌলবাদের লম্ফন কেবল এই সরকারের আমলে প্রশ্রয় পেয়েছে তা নয়। এর ইতিহাস আরও আগের। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আশ্রয়-প্রশ্রয় মূলত দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। জিয়া এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের এই দল সারা দেশে তাদের রাজত্ব কায়েম ও পোক্ত করতে ব্যবহার করেছিল জামায়াতসহ আরও কয়েকটি মৌলবাদী দলকে। তারই ফসল আজকে ভোগ করতে হচ্ছে। বারেবারে মৌলবাদীরা আঘাত করতে চেয়েছে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর। তাদের সমস্যা আমাদের বাঙালিয়ানায়, তাদের সমস্যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। তাদের চুলকানি বঙ্গবন্ধু ও তার চেতনায়। বারেবারে এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

বাংলাদেশ কোন নীতিতে চলবে সেটি নির্ধারিত হয়েছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মাধ্যমে। কোন আদর্শের রাষ্ট্র হবে বাংলাদেশ, সেটির ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন জাতির পিতা একটি সংবিধানের মাধ্যমে, যে সংবিধান একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকে স্থাপন করেছে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান থেকে যদিও আমরা এখন অনেকটাই সরে এসেছি, তারপরও সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে বাংলাদেশ একটি ইসলামি রাষ্ট্র বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এদেশের আইন বা নিয়ম-নীতি। বঙ্গবন্ধুর অবমাননা মানে সেই সংবিধানকে অবমাননা করা। বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করা মানে এই মানচিত্রের গায়ে আঘাত করা। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই মানচিত্রের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস এই মাটিতে কারও হতে পারে না। অধিকার নেই কারও সেখানে হাত দেয়ার।

অথচ আমরা দেখলাম বাবুনগরী ও মামুনুল সেই সাহস দেখিয়েছে। বীরদর্পে এখনও বলে বেড়াচ্ছে, ঘুরে ফিরছে এই মাটিতে। এখনও কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না এটি একটি বিস্ময়কর বিষয়। কুষ্টিয়ায় জাতির পিতার নির্মীয়মান ভাস্কর্য ভেঙে দিয়েছে মামুনুল, বাবুবনগরীর শিষ্যরা। এই দুঃসাহস হজম করা মানে জাতির পিতার আদর্শ থেকে বিচ্যুতি। এই বাংলায় এমন বিচ্যুতি মেনে নেয়া যায় না। এই দেশ সবার। এই মাটিতে মিশে রয়েছে প্রতিটি ধর্ম-বর্ণের মানুষের রক্ত।

মৌলবাদকে উপড়ে ফেলার এটাই সময়। ধর্মকে আশ্রয় করে যারাই রাজনীতি করতে চাইবে তাদেরই নিষিদ্ধ করতে হবে আইন করে। ধর্মের নামে, অনুভূতির নামে, ভাস্কর্যকে ইস্যু করে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা যারাই করবে, তাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে শক্ত হাতে। আর আপস নয়। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষলে সেই সাপ একদিন হৃষ্টপুষ্ট হয়ে আপনাকেই ছোবল দেবে।

বর্তমানে ক্ষমতায় যারা আছে তাদের কাছেই আমাদের প্রত্যাশা। আওয়ামী লীগ না করলে আর কেউ করবে না। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির শেষ আশ্রয়স্থল এই আওয়ামী লীগ। এই দেশ থেকে মৌলবাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে জনগণ আপনাদের পাশে আছে। অবিলম্বে হেফাজতসহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোর রাজনীতিকে আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং ভবিষ্যতেও যাতে আর কেউ ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করতে না পারে সেই রাস্তাও বন্ধ করতে হবে। মাদ্রাসার কোমলমতি শিশুদের ব্যবহার করে তারা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালিত করছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে বাঁচাতে হবে সেসব শিশুদেরও। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলমান ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বাংলাদেশের ভবিষ্যত এইসব শিশু, কিশোররা। তাদের নৈতিক শিক্ষার দিকে নজর না দিলে ভবিষ্যত অত্যন্ত খারাপ। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের রাজনৈতি কর্মকাণ্ডে যেন ব্যবহার না করতে পারে সেদিকে সরকারের নজরদারি বাড়ানো উচিৎ।

ভাস্কর্য তো উছিলা মাত্র। এদের উদ্দেশ্য এই দেশকে অস্থিরতার মধ্যে নিয়ে যাওয়া। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিতি দেয়া। উন্নয়নের চাকাকে সচল রাখতে হলে নজর দিতে হবে এই ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকেও। কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি দেশ শক্ত মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়াতে পারে না। দরকার একটি সুস্থ ও সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশ, যেখানে সকল মানুষের সমান বিচরণ থাকবে।

তাই অবিলম্বে মৌলবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি রাখলাম। আমার দেশ, আমার মাটি মৌলবাদের আখড়া হতে পারে না।

লীনা পারভীন: কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর