বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রাজপথে অস্তিত্বের আন্দোলন

  •    
  • ১১ ডিসেম্বর, ২০২০ ২০:৫৩

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি কোনো মুহূর্তে রাজনীতি ব্যর্থ হয়, তাহলে পরবর্তী শক্তি অত্যন্ত কালো একটি শক্তি। অর্থাৎ আফগানিস্তানের তালেবান, ইরানের খোমিনির দল বা মিশরের ব্রাদারহুডের মত কোনো শক্তি। এই শক্তির বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে, এই কোভিড-১৯ এর মধ্যে রাজপথে নেমেছিলেন দেশের প্রগতিশীল অনেক মানুষ এবং সরকারের যুব সংগঠন যুবলীগ। এরা রাজপথে নেমে আসাতে মৌলবাদীরা পিঠটান দিয়েছে। তবে তারপরেও সত্য হলো মুজিবশতবর্ষে তারা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙ্গতে সমর্থ হয়েছে। একে কোনোমতেই খাটো করে দেখার কারণ নেই।

ভারতের রাজধানী দিল্লিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনেকখানি অবরুদ্ধ করে রেখেছেন সে দেশের কৃষকেরা। তারা মোট ছয়টি দাবীতে আন্দোলন করছেন। তার প্রথমটি হচ্ছে সরকারকে কৃষিপণ্যের নূন্যতম ক্রয়মূল্য নিশ্চিত করতে হবে এবং সব কৃষিপণ্য সরকারকে কিনতে হবে। তাদের দ্বিতীয় দাবী, কৃষিপণ্য সংক্রান্ত স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে হবে।

ভারতের কৃষিপণ্য কেনাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে স্বামীনাথন কমিটি ২০১৮ সালে গঠিত হয়েছিল। কৃষকেরা সেটার বাস্তবায়ন চান। ওই কমিটির রিপোর্টে বলা আছে, শতকরা ৫০ ভাগ কৃষিপণ্য সরকারকে কিনতে হবে। তৃতীয় দাবী, বাতাসের দূষণ বন্ধ করার জন্য সরকার বর্তমানে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে।

মূলত, ভারতের পরিবেশবিদেরা মনে করেন, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের কৃষিপণ্যের গাছ, যেমন ধান বা গমের খড় পোড়ানো সহ অনান্য পণ্যের গাছ পোড়ানোর ফলে বাতাসে যে ধোঁয়া যায়, তা দিল্লির বাতাসকে দূষিত করে। এটাও এ মূহূর্তে পৃথিবীর সকলে জানেন, দিল্লির বাতাস পৃথিবীর দূষিত বাতাসের মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া দিল্লির আকাশের অবস্থা এই দূষিত ও ভারী বাতাসের জন্যে এমন হয় যে, মাঝে মাঝে সেখানে স্কুল বন্ধ করতে হয়। প্লেন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। তাই তৃতীয় দাবীটি কোনো মতেই কৃষকদের বাইরে খুব জনপ্রিয়তা ও সমর্থন পায়নি।

প্রথম ও দ্বিতীয় দাবির পক্ষে অনেকেরই সমর্থন আছে। বাস্তবে ভারতের মতো একটি বড় এবং জনবহুল দেশের জন্যে কৃষিপণ্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে কৃষিপণ্যের জন্যে সরকারকে অনেক বেশি ছাড় দিতে হয়। তাছাড়া সরকার যে নতুন আইন করেছে, সেখানে বেসরকারিভাবে কৃষিপণ্য কেনার যে বিষয়টি আসছে, সেটা পরীক্ষিত নয় বলে কৃষকেরা ভয় পাচ্ছেন।

কৃষকদের চতুর্থ দাবী, ডিজেলের দাম কৃষকদের জন্যে ৫০ ভাগ কম করতে হবে। কৃষকদের এই দাবি দৃশ্যত যৌক্তিক মনে হয়। তবে বাস্তবে এ নিয়ে সমালোচনাও আছে। কারণ সে দেশের কৃষকদের বেশ কিছু বিষয়ে সুবিধা ও ভর্তুকি দেয়া হয়। যেমন কৃষকদের ইনকাম ট্যাক্সের বাইরে রাখা হয়েছে। তাছাড়া সার, কৃষি যন্ত্রপাতি, ও কৃষি স্থাপনায় ভর্তুকি দেয়া হয়। এবং তাদের ঋণে এবং রপ্তানিতেও ভর্তুকি আছে। এর বাইরে তাদের আর যে দুটি দাবি, তা ইউনিয়ন ও অনেকখানি রাজনীতি সংক্রান্ত। কৃষির সঙ্গে খুব বেশি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এই কোভিড-১৯ এর মধ্যে এবং যেখানে দিল্লিতে কোভিডের অবস্থা বেশ খারাপ, সেখানে হঠ্যাৎ কৃষকেরা এই রাজপথ উত্তপ্ত করে তুলেলন। ভারতের বিরোধী দলগুলো এ আন্দোলনকে সমর্থন দিলেও তারা যে আন্দোলনের উদগাতা এবং তাদের নির্দেশে আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে, এমনটি বলার কোনো সুযোগ নেই। বরং বলা যেতে পারে, সরকার অনেক বেশি তাড়াহুড়ো করে নতুন কৃষিপণ্য আইন পাস করাতে এবং সেখানে বেসরকারি পর্যায়ে সুবিধা বাড়ানোতে কৃষকদের মধ্যে এই অনাস্থা তৈরি হয়েছে।

নতুন আইন সম্পর্কে অবশ্য সেদেশের প্রধান মন্ত্রী মি. নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, পুরাতন আইন দিয়ে আগামী দিনে পথ চলা যায় না। তবে এরপরেও ভারতের কৃষকদের এ অবিশ্বাসের কারণগুলো মোটা দাগে বলা যায়, ভারতে শুরু থেকেই মিশ্র অর্থনীতি। অর্থাৎ সরকারি খাত এবং ব্যক্তিখাত পাশাাপাশি চলে। এবং কৃষিসহ অনেক বড় বড় বিষয়গুলো সেখানে দীর্ঘদিন সরকারের হাতে ছিল। নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হবার পরে মনমোহন সিংকে অর্থমন্ত্রী করা হয়। এবং তিনিই সেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করেন। তবে তারপরেও সত্য, আমেরিকা বা কানাডার মতো শতভাগ মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশেও কৃষিপণ্যে বিপুল ভর্তুকি দেয়া হয়। সেখানে ভারতের মতো দরিদ্র দেশের দরিদ্র কৃষকদের বাঁচাতে হলে সরকারের কল্যাণ ও সুবিধার হাত কৃষকদের ওপর অনেক বেশি দিতে হবে। তাছাড়া আরও একটি বিষয় এ উপমহাদেশের দেশগুলোর মনে রাখা দরকার: এই উপমহাদেশের কৃষকেরা যত বেশি পরিশ্রম করে ফসলের দাম যত কম পান, এমনটি পৃথিবীতে কোথাও নেই। আর তার বিনিময়ে সরকার থেকে কৃষকদের সেভাবে কোনো সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় না। তাই দিল্লির চারপাশের রাজপথে যে কৃষকেরা এসেছেন, তাদের দাবির সমালোচনা যতই করা হোক না কেন, তাদেরকে আধুনিক যুগের দিকে যতই এগিয়ে যেতে বলা হোক না কেন, বাস্তবে তারা অনেক বেশি বঞ্চিত মানুষ। তাই সত্য অর্থে দিল্লির রাজপথে এখন বঞ্চিত মানুষেরা। তারা তাদের অস্তিত্বেও জন্যেই রাজপথে এসেছেন। আবার তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সেদেশের অস্তিত্ব অনেক খানি জড়িত।

অন্যদিকে এই উপমহাদেশের আরেক দেশ পাকিস্তানের রাজপথেও এখন প্রায় প্রতিদিন চলছে মিছিল মিটিং। ওই দেশে জামায়াতুল ওলেমা- ই- ইসলামের নেতা মওলনা ফজলুল হকের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট। সেখানে পাকিস্তানের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল যথাক্রমে নেওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ এবং বিলওয়াল ভুট্টোর পিপলস পার্টিও রয়েছে। এবং এখানে মওলনা ফজলুল হক, নওয়াজ শরিফ এবং বিলওয়াল ভুট্টো থাকা সত্ত্বেও আরো একজন যিনি নেতা হিসেবে বেরিয়ে আসছেন, তিনি মরিয়ম শরিফ অর্থাৎ নেওয়াজ শরিফের মেয়ে। তাদের আন্দোলনের ফলে ইতোমধ্যে ইমরান সরকার অনেকখানি নত হয়েছে। ইমরান খান ইতোমধ্যে সেদেশের সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্টদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, তিনি শুধু মাত্র নেওয়াজ শরিফের ওই রিকন্সিলিয়েশান আইন ছাড়া আর সব কিছু নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি। কিন্তু তার ওই আহবানে কোন সাড়া দেয়নি পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) বরং তারা আগামী ৩১ তারিখের মধ্যে সংসদ থেকে পদত্যাগ করার জন্যে প্রত্যেকটি দলের এমপি তাদের নিজ নিজ দলীয় প্রধানের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্য, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইমরান খান সরকারকে তারা বিদায় করবেন। রাজপথে তাদের মিছিল ও সভাগুলোতে অসংখ্য মানুষ আসছে। ১৪৪ ধারা জারি করেও ইমরান সরকার তাদের কোনো মিছিল বা সভা ঠেকাতে পারছে না। এখন তিনি বলছেন, কোভিডের সময় যেখানে হাসপাতালের সিটগুলো ভরে উঠছে, সেখানে বিরোধী দলের এভাবে জনসমাগম করা উচিত হচ্ছে না।

তবে পাকিস্তানের এবারের এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নতুন মাত্রা এনেছেন নওয়াজ শরিফ এবং তার মেয়ে মরিয়ম । তারা দুজনই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বলছেন। এবং অনেক স্পষ্ট করে বলছেন। সেদিক থেকে বিলওয়াল ভুট্টোর সুর একটু নরম। বাস্তবে এই উপমহাদেশের তিনটি দেশের ভেতর দুটো দেশ অর্থাৎ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি নষ্ট করেছে সামরিক শাসকেরা। তারা একদিকে যেমন গণতন্ত্রের ভিত্তি নষ্ট করেছে, তেমনি দুটি দেশেই মৌলবাদের জম্ম দিয়েছে। এখানে শুধু ভিন্ন হলো ভারতে ধর্মীয় মৌলবাদ এসেছে একটি বিশেষ ধর্মীয় সংগঠনের দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে। অর্থাৎ আজ ভারতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিজেপি ক্ষমতায় থাকার পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দীর্ঘ প্রচেষ্টা। অন্যদিকে পাকিস্তান যে পুরোপুরি মৌলবাদী দেশ হয়ে গেছে, তার মূলে সামরিক বাহিনী। নওয়াজ শরিফ ও তার মেয়ে এবার এই সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে হাত দেবার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এর থেকে এই মুভমেন্টের ভেতর অনেকে ক্ষীণ হলেও একটা আশা দেখছেন, এরা জয়ী হলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। অর্থাৎ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসর মৌলবাদীদের থেকে দেশ কিছুটা হলেও মুক্তি পেতে পারে। যদিও সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক শাসকদের তৈরি মৌলবাদীরা গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে রাস্তায়। তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে শুধু বাঙালি জাতির অস্তিত্বে টান দিয়েছে তা নয়, তারা বাঙালি সংস্কৃতিতেও আঘাত করেছে। তাদের এ উত্থান এও বলে দেয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি কোনো মুহূর্তে রাজনীতি ব্যর্থ হয়, তাহলে পরবর্তী শক্তি অত্যন্ত কালো একটি শক্তি। অর্থাৎ আফগানিস্তানের তালেবান, ইরানের খোমিনির দল বা মিশরের ব্রাদারহুডের মত কোনো শক্তি। এই শক্তির বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে, এই কোভিড-১৯ এর মধ্যে রাজপথে নেমেছিলেন দেশের প্রগতিশীল অনেক মানুষ এবং সরকারের যুব সংগঠন যুবলীগ। এরা রাজপথে নেমে আসাতে মৌলবাদীরা পিঠটান দিয়েছে। তবে তারপরেও সত্য হলো মুজিবশতবর্ষে তারা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙ্গতে সমর্থ হয়েছে। একে কোনোমতেই খাটো করে দেখার কারণ নেই।

তাই দেখা যাচ্ছে, এই উপমহাদেশের রাজপথ আন্দোলনে ব্যস্ত। আর সে আন্দোলনের ধারা ভিন্ন হলেও সবখানে একটি অস্তিত্বেও লড়াই আছে। যেমন ভারতের কৃষকদের অস্তিত্বের সঙ্গে সেদেশের অস্তিত্ব গাঁথা। অন্যদিকে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক মুভমেন্ট যদি জয়ী হয়ে সেদেশের রাজনীতিকে সামরিক বাহিনীর কবল থেকে বের করতে পারে এবং তাদের পাপেট ইমরানকে উৎখাত করতে পারে, তা ওই দেশ শুধু নয় পৃথিবীর জন্যে একটা সুসংবাদ এবং তাদের জন্যে অস্তিত্বেরও বিষয়। কারণ, দীর্ঘদিন সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলে ওই দেশের ধংস অনিবার্য। অন্যদিকে বাংলাদেশের মৌলবাদীরাও বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত করেছে। তাই এই মৌলবাদীদেরও বাংলাদেশকে রুখতে হবে তার অস্তিত্বের স্বার্থে।

এ বিভাগের আরো খবর