বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রের উপর আঘাত

  • তাপস হালদার   
  • ৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ২০:০১

বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তি নন, স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র। যারা স্বাধীন বাংলাদেশে থেকে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে, মানচিত্রের উপর আঘাত করবে, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।

বঙ্গবন্ধু একটি ইতিহাস। বাঙ্গালি জাতির আবেগ, অনুভূতি ও একটি সত্তার নাম। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে, এ দেশের জনগণ থাকবে- ততদিনই তিনি অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, লাল সবুজের পতাকা, একটি মানচিত্র।

রাজধানীর ধোলাইপাড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে স্থাপিত ভাস্কর্যকে মূর্তি নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে। এরই মধ্যে কুষ্টিয়ার পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্যকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। ভাস্কর্যের পাদদেশে কালো পতাকা বেঁধে দেয় এবং কয়েক রাউন্ড গুলিও করে।

ওরা একদিনে এই ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস পায়নি। বিভিন্ন সময়ে ভাস্কর্য নিয়ে বিভিন্ন সরকার আপস করেছিল বলেই এদের আজ সাহস হয়েছে বাঙালি জাতির অস্তিত্বের উপর আঘাত করার। এদের মূল উদ্দেশ্য ভাস্কর্য নয়, দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকারকে বিব্রত করা। বাংলাদেশের অসাস্প্রদায়িক চেতনাকে বিনষ্ট করা।

ভাস্কর্য আর মূর্তি যে এক নয়, তা কি ধর্ম ব্যবসায়ীরা জানে না? নাকি জেনেও ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই তাদের সুপরিকল্পিতভাবে মিথ্যা প্রচারণা।

একটু জেনে নেই ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য। ভাস্কর্য (Sculpture) এক ধরনের শিল্পকলা বিশেষ। সব মূর্তিই যেমন ভাস্কর্য নয়, তেমন সব ভাস্কর্যকে মূর্তি বলা যায় না। ভাস্কর্য এক ধরনের শিল্প, যা মানুষকে ভাবতে ও সৌন্ধর্য উপলদ্ধি করতে বাধ্য করে। মূর্তি হলো যাকে পূজা করা হয়, যার কাছে প্রার্থনা করা হয়। যিনি ভাগ্য দেবতা, শক্তিদাতা। ভাস্কর্য হলো প্রাচীন শিল্পকলা, যা দিয়ে একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির নিদর্শন তুলে ধরা হয়।

মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে ভাস্কর্যের ঐতিহ্য আছে। ইরান, মিসর, ইরাকের জাদুঘরে অসংখ্য ভাস্কর্য আছে। ইরানের কবি ফেরদৌসি, ওমর খৈয়াম, নাদির শাহের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রাস্তায় শোভা পাচ্ছে। পিরামিডের জন্য মিসরের ঐতিয্য সারা বিশ্বে সমাদৃত। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে মাহমুদ মোকতায়ের বিখ্যাত ভাস্কর্য মিসরের রেঁনেসা। আফগানিস্তানে যখন তালেবানরা বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করেছিল তখন কিন্তু ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান পার্লামেন্ট নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব পাস করেছিল।

ইরানে আছে একটি বিশাল স্বাধীনতা স্তম্ভ, যার নাম ‘আজাদী’। রয়েছে কবি ওমর খৈয়াম ও মহাকবি ফেরদৌসির ভাস্কর্য। ইরাকে আছে অনেক ভাস্কর্য। বাগদাদ বিমানবন্দরে ডানার ভাস্কর্য। আল-মনসুর শহরে মনসুর ভাস্কর্যসহ সাধারণ সৈনিকদেরও অনেক ভাস্কর্য রয়েছে। পারস্যের কবি শেখ সাদীর মাজারের পাশেই তার একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য রয়েছে।

মুসলমানদের তীর্থস্থান খ্যাত সৌদি আরবের জেদ্দায় আছে একটি উটের ভাস্কর্য, অন্যটি হাত সদৃশ ভাস্কর্য। তুরস্কে আছে সে দেশের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের ঘোড়ার পিঠে নারী সহযোদ্ধাকে নিয়ে যুদ্ধংদেহী ভাস্কর্য। কয়েকদিন আগে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করছেন, তাদের রাজধানী আঙ্কারায় তারা বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করবে। সে সব দেশে সমস্যা না হলেও সমস্যা শুধু বাংলাদেশে।

এ দেশে বিভিন্ন সময়ে ভাস্কর্যবিরোধিতা করে মৌলবাদীরা সফল হয়েছে বলেই তাদের স্পর্ধা দিন দিন বেড়েই গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিমানবন্দর সড়কদ্বীপে লালন ভাস্কর্য তৈরি করেছিল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। ভাস্কর্য তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি অতিথিদের কাছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি তুলে ধরা। কিন্তু নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই তখন কওমি মাদ্রাসার কিছু ছাত্র আন্দোলন ও হুমকির মুখে সরকার ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়। সে ভাস্কর্যে ছিল বাংলার লোক সংস্কৃতির বাহক একতারা দোতারা হাতে পাঁচজন বাউলের মুখাবয়ব, যার নাম রাখা হয়েছিল ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ লালন ভাস্কর্য।

মতিঝিলের বক ভাস্কর্যটিকে প্রকাশ্য দিবালোকে দড়ি বেঁধে ভাঙ্গতে দেখছে গোটা দেশবাসী। এই কয়েক বছর আগে সুপ্রিম কোর্টে ন্যায় বিচারের প্রতীক একটি ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক তুলে তারা সফলও হয়েছে। একটি বাঙালি নারীর এক হাতে দাঁড়িপাল্লা, অন্য হাতে তলোয়ার এবং চোখ বাঁধা- যা ন্যায় বিচারের প্রতীক। ভাস্কর্যটি মৌলবাদীরা গ্রিক দেবী প্রচার করে সেটিকে সরাতে বাধ্য করেছিল। ভাস্কর্যটিকে কোনো পূজা করার কিংবা শক্তির উৎস মনে করা হয় না- সেজন্য কোনো মতে তাকে মূর্তি বলা যায় না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ভাস্কর্য, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলা, স্বাধীনতা ভাস্কর্য, শিখা চিরন্তনসহ বাঙালি জাতির গর্বের ও আবেগের স্থানগুলোকে সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে এসব বিষয়ে কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের গায়ে হাত দিয়েছে তাদেরসহ হুকুমদাতাদের দ্রুত আইনে বিচার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মৌলবাদী শক্তিকে এখনই পরাজিত করতে হবে। তাদের আর বাড়তে দেয়া যাবে না।

বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তি নন, স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র। যারা স্বাধীন বাংলাদেশে থেকে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে, মানচিত্রের উপর আঘাত করবে, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

এ বিভাগের আরো খবর