সময় পেরিয়ে এলাম অনেকটা । ব্যক্তিজীবনে বদল এসেছে । রাষ্ট্রীয় জীবনও সিকস্তি পয়স্তি পেরিয়ে নিয়েছে চলতি রূপ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তির লগ্নে এসে, মনে পড়ল রজতজয়ন্তি উদযাপনের সময়ের কথা।
আনকোরা তারুণ্য তখন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েরও গোড়ার সময়। গণমাধ্যমে তুমুল ব্যস্ত সময় পার করছি। রজত জয়ন্তিকে সামনে রেখে পুরো দেশ মেতে উঠেছিল উৎসবে।
এখন যে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসকে সামনে রেখে শহরে গ্রামে নানা আকারের পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় পতাকাওয়ালা, সেই রেওয়াজটা সম্ভবত সেই বিজয়ের সেই রজত জয়ন্তি থেকেই শুরু হয়েছিল।
আমি সেই সময় একটি প্রভাবশালী দৈনিকে কাজ করি, আরেকটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিকে কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, দুটোর জন্যেই লেখা তৈরি করতে ঢাকার বাইরে যাই। ঘুরে বেড়াই শহর গ্রাম। পুরো দেশ বিজয় উল্লাসে রঙিন। একাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম আমরা এর আগে এমন বিজয় উৎসব দেখিনি। গ্রামে-গঞ্জে জমির আইলে আইলে যেন বিজয় উদযাপনের আয়োজন। সব শ্রেণির মানুষের মুখেই ভাসছিল উৎসবের আনন্দ।আনন্দের সেই প্লাবন ছটা নিয়ে ঢাকায় ফিরে বিজয়ে একদিন আগে। মনে হলো এসে যোগ দিলাম বিজয়ের মহাসমুদ্রে।
মাঠে ময়দানে দেখা বিজয় উৎসবের প্রস্তুতি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলাম। বিবিসিও আমার কাছ থেকে শুনে নিয়েছিল সেই উদযাপনের আখ্যান।
পথে পথে আমি শুধু উদযাপনের প্রস্তুতিই দেখিনি, দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে জন মানুষের বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি।
মুক্তিযুদ্ধ যে জনযুদ্ধ ছিল, ওই যুদ্ধে কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া বাকি সব বাঙালিই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সমাজ কেমন ছিল, বিভিন্ন পেশার মানুষের অংশগ্রহণের বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা যেন নতুন ভাবে দেখা শুরু হলো। কারণ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতাকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধকে যেমন নতুন প্রজন্মের কাছে ‘গণ্ডগোল’ বলে উপস্থাপন করা হয়েছে বা তাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। ইতিহাসও লেখা হচ্ছিল বিকৃত ভাবে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের পর সেই বিকৃতির ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের মুক্তি ঘটে। ফলে ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা ও বিজয়ের রজতজয়ন্তি উদযাপন ছিল মুক্তিরই তুল্য।
সেই রজতজয়ন্তির উদযাপন থেকে সুবর্ণজয়ন্তিতে পৌঁছাতে গিয়েও স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফালন দেখতে হয়েছে। শহীদ ও মুক্তিযাদ্ধা পরিবারদের বাস্তু ও দেশচ্যুত হতে হয়েছে। জীবনও কম মানুষকে দিতে হয়নি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো নতুন করে তারা স্বাধীনতা ও দেশবিরোধিতা, বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধিতা এবং সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বীজ বপন করতে শুরু করে। নতুন প্রজন্ম ছিল তাদের সেই বীজতলা।
গৌরবের বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শক্তি কখনও নতজানু ও গতিহীন হয়নি। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রুদ্র ঝড় সেই বীজতলার ফলন বিনষ্ট করতে সক্ষম হয়। আনন্দ সংবাদ হল, সেই বীজতলাতেই বেড়ে উঠে স্বাধীনতাবিরোধী ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করা প্রজন্ম। ওই প্রজন্মের শক্তিতেই আওয়ামী লীগ সরকার প্রণোদিত হয় বিচার ও শাস্তি প্রক্রিয়া শেষ করতে।
এখন যখন স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তি পালন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তখন স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ আত্মশুদ্ধি, বিশেষ করে ভেতরকার অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটির ক্ষমতায় থাকার ধারাবাহিকতায়, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধারে অনুপ্রবেশকারীরা দলটিকে ঘিরে ধরেছে।
বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা আদর্শের জায়গাটিতে থাকছে না। হয়ে গেছে প্রদর্শনের। বঙ্গবন্ধুর ছবি বা তাকে নিয়ে লেখা বই সামান্য পার্কিং বিড়ম্বনা এড়াতেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করলে, দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন বেকার হয়ে পড়ত এতদিনে।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভের পেছনে যুক্তি আছে, এত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক তাকে হত্যার পর কোন গুহায় গিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। এখন যারা জিকির করছেন বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যার, কোনো ক্রান্তিকালে তাদের কি পাওয়া যাবে এমন নিবেদিত ভূমিকায়? এই প্রশ্নের উত্তর ও বাস্তবতা খুঁজে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তি ও মুজিব বর্ষে আদর্শের পরিশোধন প্রয়োজন।
লেখক: তুষার আবদুল্লাহ, গণমাধ্যম কর্মী