আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিদিন যেভাবে মূর্তি (স্ট্যাচু) এবং ভাস্কর্য (স্কাল্পচার) আলাদা জিনিস বলে ব্যাখ্যা বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে তাতে মূর্তি নিয়ে তারা বেশ বিপাকেই পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। মৌলবাদী গোষ্ঠী রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু বা মূর্তি তৈরির বিরোধিতা শুরু করলে শুরু হয়েছে এই শিল্প মাধ্যমটি নিয়ে অ্যাকাডেমিক (!) আলোচনা।
তো, আম জনতার মনে তো প্রশ্ন জাগে আসলে ঘটনা কী? মূর্তি আর ভাস্কর্যের মধ্যে আসলে পার্থক্যটা কোথায়? কেননা, বছর কয় আগে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে একটি ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে শুরু হয় আস্ফালন। সেটি গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি নাকি সুবিচারী বাঙালি নারীর ভাস্কর্য তা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। সুপ্রিম কোর্টের সেই ভাস্কর্যের সুরাহা হয়েছে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে। তার নির্মাতা ভাস্কর মৃণাল হক গত হয়েছেন।
একটু ঘাটাঘাটি করে দেখলাম- মূর্তি আর ভাস্কর্যের মধ্যে পার্থক্য টানা একটা বেকায়দা ব্যাপার। আমার বলতে বা বুঝতে ভুল হতে পারে- শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধারা ক্ষমা করবেন। যদ্দুর বুঝলাম, ভাস্কর্য বা স্কাল্পচার হচ্ছে ত্রি-মাত্রিক শিল্প, সেটা পাথর কেটে কিংবা ছাঁচে ফেলে তৈরি করা হয়। এর মধ্যে বাস্তবিক কোনো কিছু – যেমন কোনো ব্যক্তি, প্রাণী বা পৌরাণিক চরিত্রের ভাস্কর্যকে মূর্তি বলা হয়। আর কল্পিত কোনো কিছুর ভাস্কর্য হচ্ছে শুধুই ভাস্কর্য, একটি শিল্প। মূর্তি বা স্ট্যাচু কোনো শিল্পকর্ম নয়। তবে কোনো কোনো মূর্তি একাধারে ভাস্কর্যও। উদাহরণ হিসেবে মিকেলেঞ্জেলোর ডেভিডের উদাহরণ আসে- পৌরাণিক চরিত্র ডেভিডের এই মূর্তি ভাস্কর্যের ধ্রুপদী উদাহরণ হয়ে আছে। ঠিক এমনই ওয়াশিংটন ডিসিতে আব্রাহাম লিংকনের ভাস্কর্যকে তার মূর্তিও বলা হয়ে থাকে।
এই মূর্তি (স্ট্যাচু) আর ভাস্কর্যকে (স্কাল্পচার) আলাদা করার ব্যাপারটা খুব বেশি দিনের নয়; মূলত ফরাসি ভাস্কর রদাঁর সময় থেকে। তার বিখ্যাত ভাস্কর্য বিভ্রান্ত মুখের ভাবুক (দ্য থিংকার) তৈরিতে ভাস্কর্য তৈরির শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা, অর্থাৎ পাথর বা শক্ত কিছু খোঁদাই করে অবয়ব বের করে আনা, হয়নি। এটা তৈরি করা হয়েছে কাঁদামাটির ছাঁচ তৈরি করে ব্রোঞ্জের কাস্টিং করে।
সে যাই হোক, সংজ্ঞা অনুসারে- ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্যকে মূর্তি বা স্ট্যাচু বলাই দস্তুর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্ট্যাচু বললে তেমন একটা গায়ে লাগে না। কিন্তু মূর্তি বললেই বিপদ। কেননা এই মূর্তির সঙ্গে রয়েছে নিরাকার সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসীদের ধর্ম হিসেবে ইসলামের মূর্তিপূজা-বিরোধী অবস্থান। মক্কা বিজয়ের পর পবিত্র কাবা শরিফে থাকা বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি গুড়িয়ে দেওয়া ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ফলে মূর্তি ভাঙার মধ্যে একটি জেহাদি জোশ পায় ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা একটি গোষ্ঠী।
এখানে বলে রাখা ভালো, মূর্তি মানেই তা পূজা করা নয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবদেবীদের যে মূর্তি তৈরি করেন তাকে প্রতিমা এবং বিগ্রহ বলা হয়। তাই স্ট্যাচুকে মূর্তি বললেই স্পর্শকাতর হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই।
তো, ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু তৈরি নিয়ে হঠাৎ করেই সরব হয়ে উঠেছে একটি গোষ্ঠী। মওলানা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের দ্বিধাবিভক্তি এবং আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্নিতরা একটি অংশের নেতৃত্ব সংহত করার সঙ্গে এর যোগসূত্র খুবই স্পষ্ট। হেফাজতে ইসলামের নানা আবদার মেনে নিয়ে নিজেদের ইসলামের ঝাণ্ডাধারী বলে প্রমাণ করার চেষ্টারত আওয়ামী লীগের জন্য এটা এসেছে শেল হয়ে।
এই টানাপড়েনের শুরু ২০১১ সালে সংবিধানে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী থেকে। রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ৭২-এর সংবিধানের জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি এই মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক রাষ্ট্রধর্মের বিধান বলবৎ রাখা হয়েছে। মলম হিসেবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে – সে কথাও যোগ করা হয়েছে।
তারপর নারী উন্নয়ন নীতিমালায় দেখা গেল নারীর উত্তরাধিকার প্রশ্নে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে সরকার। তারপরও হেফাজতে ইসলাম একে ইসলামবিরোধী বলে বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। হেফাজতে ইসলামের চাপের মুখে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করা হয়েছে। আর মাঝে মধ্যেই আমরা মদিনা সনদ অনুসারে দেশ পরিচালনার কথা শুনতে পাই, অথচ সেই সনদের মধ্য দিয়ে সবার মান-মর্যাদা ও ধর্মবিশ্বাসের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
হেফাজতে ইসলামসহ ধর্ম ব্যবসায়ীদের আমরা কখনই মাদ্রাসায় বলাৎকারের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিতে দেখি না। তাদের ওয়াজ মাহফিলে কখনও যাকাত আদায় করা নিয়ে কোনো বক্তব্য শুনবেন না। তারা কখনও হালাল রুজির কথা বলবে না। কোরআন শেখানোর বিনিময়ে অর্থ নেওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলা তো দূরের কথা।
যাই হোক, এই মূর্তি ইস্যুতে ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া আওয়ামী লীগ কোন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা বোঝা যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতার মূলমন্ত্র নিয়ে যে দল স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছে, সেই দল আজ জাতির জনকের স্ট্যাচু তৈরি নিয়ে মিন মিন করছে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মানুষকে মুক্তির চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলা আওয়ামী লীগ আজ মূর্তি আর ভাস্কর্যের পার্থক্য শেখাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর মতো হুংকার দিয়ে কেউ বলছে না: আমি আমার পিতার মূর্তি বানিয়ে দেশ ভরে ফেলব- তুমি কে হে?