করোনাভাইরাসের প্রভাবে গোটা বিশ্বের চালচিত্র বদলে যেতে বসেছে। অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি তো বটেই, মানুষের একেবারেই মানবিক বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলিও করোনার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকছে না। রোগ-ব্যাধির কারণে সৃষ্ট এমন দুর্যোগ এর আগেও পৃথিবীতে আঘাত হেনেছে; তবে করোনাভাইরাসের মতো করে এমন সর্বগ্রাসী প্রভাব এখন পর্যন্ত আর কোনোটিই ফেলেনি। করোনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে তাই ব্যাপক পরিসরে ভাবা দরকার।
করোনাভাইরাস প্রচণ্ড রকমের ছোঁয়াচে হওয়ায় এ নিয়ে ঝুঁকি বেশি। করোনার প্রভাবে এরই মধ্যে গোটা বিশ্বের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডল দারুণভাবে প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যখাত অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। শিক্ষাখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আজকের এই লেখা মূলত শিক্ষাখাত নিয়ে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়ার পর ঝুঁকি এড়াতে এ বছরের মার্চ মাসের শেষদিকে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে বার বার এই ছুটির সময় বাড়ানো হয়েছে। প্রথম কিছুদিন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও একাডেমিক কার্যক্রম চলেনি। এরপর যখন বোঝা গেল যে শিগগিরই করোনার কোনো সমাধান মিলবে না, তখন শিক্ষাখাতের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির কথা ভেবে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
এখানে কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখবার প্রয়োজন রয়েছে:
এক. করোনার ক্ষতি সামলাতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে বটে, তবে কত ভাগ শিক্ষার্থী এর সুফল নিতে পারছে? বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতজন শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস বা পরীক্ষার সুবিধা নেওয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা রাখে?
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় এখনও অনেক বেশি। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) থেকে ১ জিবি ডেটা কিনতে মোবাইল ফোন অপারেটরদের ব্যয় হয় ২৮ থেকে ৩০ পয়সা। আর এই ১ জিবি ডেটা গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে: গ্রামীণফোন ২৭৪.২৮ টাকায়, রবি ২১৩.০৬ টাকায়, বাংলালিংক ২০৯.০০ টাকায়, এয়ারটেল ২০৯.০০ টাকায় এবং টেলিটক ১৮০.০০ টাকায়। অর্থাৎ দেশের মোবাইল ফোন অপারেটররা গড়ে ২৬ পয়সায় কেনা ১ জিবি ডেটা তাদের গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে গড়ে ২১৭ টাকায়!
কেবল এই অযৌক্তিক উচ্চমূল্যই একমাত্র সমস্যা নয়; গোটা দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামো এখনও গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে সক্ষম নয়। দেশের অনেক স্থানে এখনও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই বা দুর্বল। ফোন কলে অস্পষ্ট আওয়াজ বা হঠাৎ লাইন কেটে যাওয়ার মত সমস্যা এখনও রয়ে গেছে; অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রেও এমন সমস্যার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে রয়েছেন। কাজেই অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়ে চলমান রয়েছে কেবল এতেই আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই; এই কার্যক্রম কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে, সেটিও নিরীক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
দুই. বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা কতটুকু এটিও একটি বড় চলক। সব স্তরের শিক্ষার্থী প্রযুক্তির ব্যবহারে সমানভাবে সক্ষম নয়; এক্ষেত্রে বয়স যেমন একটি বিবেচ্য, তেমনি সবাই প্রযুক্তি ব্যবহারে সমানভাবে আগ্রহী বা দক্ষ থাকে না। একই কথা শিক্ষকদের বেলাতেও প্রযোজ্য; সব শিক্ষক কি প্রযুক্তি ব্যবহারে সমানভাবে আগ্রহী বা সমান দক্ষ? নিশ্চয়ই নয়। সুতরাং অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে সত্যিকার অর্থে সফল করে তুলতে হলে এবং কাঙ্ক্ষিত মানে নিয়ে যেতে হলে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের আগ্রহ ও দক্ষতা কীভাবে বাড়ানো যাবে, সেটির উপায় সন্ধান করতে হবে।
তিন. গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষ করে শিশুদের জন্যে প্রযুক্তি তেমনটা সহজলভ্য নয় কিন্তু শহরাঞ্চলের জন্যে বাস্তবতা একেবারে উল্টো; শহরের শিশু-কিশোররা মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ বা এ ধরনের ডিভাইসের প্রতি রীতিমতো আসক্ত। গ্রামাঞ্চলের শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ ধরনের ডিভাইস ও ইন্টারনেটের মতো প্রযুক্তির অভিগম্যতা বাড়ানো দরকার। পক্ষান্তরে শহরাঞ্চলের শিশু-কিশোরদের মধ্যে এসব ব্যবহারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করাটা বরং চ্যালেঞ্জ। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসব ডিভাইস ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাত্রা অনেক বেড়েছে। আর শিক্ষার্থীরা এসবের কতটা সদ্ব্যবহার করছে, সেটিও নজরদারিতে রাখা দরকার।
চার. প্রযুক্তির অতি ব্যবহারের কারণে ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিজঅর্ডার বা ইন্টারনেট আসক্তিসহ নানা সমস্যা বাড়ছে এতে সন্দেহ নেই। এর পাশাপাশি চোখের সমস্যা, মাথা ব্যথা, বিষন্নতা, সহিংসতা বা মুটিয়ে যাওয়াসহ নানাবিধ জটিলতা বাড়ছে। প্রযুক্তির অতি ব্যবহার কেবল শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকদেরও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে সতর্কতা ও যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন।
পাঁচ. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের শারীরিক উপস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রমের বাড়তি কিছু সুবিধা থাকে, যা অনলাইন বা ভার্চুয়াল ক্লাসে থাকে না। মুখোমুখি যোগাযোগে একে অন্যের অবাচনিক সঙ্কেতগুলোকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, সঠিক বোঝাপড়া ও আস্থার সম্পর্ক তৈরির সুযোগ থাকে এবং শিক্ষার সুফল বৃদ্ধির সুযোগ ঘটে। অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চলছে বটে, তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী যে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পারছে না এবং এ কারণে উভয় পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক ও একাডেমিক প্রেক্ষাপটে যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, তা কীভাবে পূরণ করা যাবে এ নিয়েও ভাবা দরকার।
ছয়. মানুষ দিনের পর দিন ঘরে বন্দি থেকে অভ্যস্ত নয়। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কেবল যে পড়াশোনাই করে, তা নয় বরং এটি তাদের স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ারও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে শিশু-কিশোর বা তরুণ-তরুণীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে না পারার কারণে তাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব কারণে দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, সে দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।
সাত. করোনাকালে ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যে অভ্যস্ততা গড়ে উঠছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও সশরীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজির হয়ে শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্যে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে; বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই ভাবা দরকার।
সবার আগে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এ নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। আরও অনেকদিন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যাবে না এবং এমনটি করা উচিতও হবে না। তবে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার কোনো সুযোগ নেই, এটি আমাদের সবার বোঝা দরকার। এজন্যে শিক্ষার ক্ষতি সামলানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শরীর ও মনোজগতের ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও অভিভাবক, শিক্ষক ও নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে।
কেবল ক্লাস আর পরীক্ষা চলমান রাখাই শেষ কথা নয়; শিক্ষার্থীদের মনের অসুখ সামাল দেওয়া না গেলে শিক্ষার সুফল পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।